শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে
Call

                           গড়তে হবে ‘চিন্তা স্কুল’

আমাদের দেশের শিক্ষাপদ্ধতি পরিবর্তনের কথা উঠলে স্বাভাবিক কারণেই দুটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। প্রশ্ন দুটি হল- ১. বর্তমানে প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতিতে পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তার কথা আসছে কেন, যেখানে আমাদের গ্র্যাজুয়েটরা বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সুনামের সঙ্গে উচ্চতর ডিগ্রি নিচ্ছে এবং বিদেশে যোগ্যতার সঙ্গে চাকরি করছে? এবং ২. পরিবর্তন করলে কী ধরনের সুবিধা হবে?

এটা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, আমাদের শিক্ষাপদ্ধতি, বিশেষ করে শিক্ষাদান পদ্ধতি ছাত্রদের তথ্য ও পরিসংখ্যান মুখস্থ করতে উৎসাহিত করে। বিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের ‘ক্রিটিক্যাল চিন্তা’ ও বুৎপত্তি অর্জনের দিকটি বিবেচনায় আনে না। শিক্ষার্থীদের ক্লাসে আস্থা ও দক্ষতার সঙ্গে প্রশ্ন করতে পারার এবং প্রশ্নের সুচিন্তিত উত্তর খুঁজে পাওয়ার দক্ষতা অর্জনের বিষয়টি মোটেই গুরুত্ব পায় না।

বর্তমানে শিক্ষা নিয়ে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে, যে শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষাপ্রাপ্তরা দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতে অবদান রাখতে পারে না, তেমন পদ্ধতির পরিবর্তন করতে হবে। আসলে স্কুল, কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শুধু জ্ঞান সৃষ্টি ও প্রদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না। শিক্ষকদের বড় দায়িত্ব শিক্ষার্থীদের চিন্তা করার ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা অর্জনে সক্ষম করে গড়ে তোলা। মনে রাখতে হবে, মুখস্থনির্ভর প্রশ্নের উত্তর দিয়ে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করা শিক্ষার্থীদের কর্মজীবনে সফল হওয়া নিশ্চিত করে না। এটাও বুঝতে হবে যে, শিক্ষার্থীদের চিন্তা করার ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা অর্জনে সক্ষম করে গড়ে তোলার কাজটি মোটেই সহজ নয়। এ কাজটি সঠিকভাবে করা যাবে যদি শিক্ষাদান পদ্ধতিতে যথাযথ পরিবর্তন আনা যায়।

দেখা যাক, আমরা স্কুল-কলেজে কিভাবে পড়াই এবং শিক্ষার্থীদের বিষয়ভিত্তিক অর্জিত জ্ঞান কিভাবে মূল্যায়ন করি। ক্লাসে এসে শিক্ষক তার কোসের্র কোনো একটি বিষয় নিয়ে বোর্ডে লেখেন এবং ব্যাখ্যা করেন। শিক্ষার্থীরা বিষয়টি বুঝছে কিনা বা তারা বিষয়টি নিয়ে কী ভাবছে সে ব্যাপারটি শিক্ষকের কাছে তেমন গুরুত্ব পায় না। ক্লাসে শিক্ষক আলোকপাত করে থাকেন বিষয়বস্তু ও প্রবলেম সমাধানের পদ্ধতি সম্পর্কে। শিক্ষার্থীদের কোনো একটি প্রবলেমের সমাধান ভিন্ন ভিন্নভাবে করতে পারার সক্ষমতা থাকতে পারে, কোর্স শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সেই সক্ষমতা কখনও যাচাই করেন না। স্কুল বা কলেজে বার্ষিক পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষকরা মূল্যায়ন করেন কারা মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে। বিষয়ভিত্তিক পরীক্ষায় তারা অধিকাংশ প্রশ্নই মুখস্থনির্ভর করে থাকেন।

মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রাপ্ত জিপিএ’র ভিত্তিতে কৃতকার্য শিক্ষার্থীদের কাউকে ‘উচ্চ অর্জনকারী’ আর অন্যদের ‘নিম্ন অর্জনকারী’ বলা হয়ে থাকে। যেসব শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়, তারা ‘খারাপ ছাত্র’র শ্রেণীতে তালিকাভুক্ত হয়। বিশিষ্ট দার্শনিক অধ্যাপক ড. রিউভেন ফিউয়ারস্টেন এভাবে শিক্ষার্থীদের শ্রেণী বিভাগকে যথাযথ নয় বলে যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করেছেন। পরীক্ষায় ভালো ফলাফলে ব্যর্থ শিক্ষার্থীরা উচ্চমাত্রায় চিন্তা ও কর্মক্ষমতা অর্জনে অক্ষম এটা বলা যাবে না। আসলে তাদের চিন্তা করার এবং বুদ্ধিমত্তার দক্ষতা এক ধরনের মানসিক কার্যকলাপ (mental activity) আর মন অভ্যাস (mind habit)।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেই শিক্ষার্থীদের চিন্তা করার এবং বুদ্ধিমত্তার দক্ষতা অর্জনের উপায় ও পদ্ধতি উদ্ভাবনের দায়িত্ব নিতে হবে। কিছু জ্ঞানীয় সরঞ্জাম ব্যবহারের মাধ্যমে ‘নিউর‌্যাল প্যাটার্নস’ তৈরি হবে, যার ফলস্বরূপ লার্নিং অধিকতর দক্ষ ও কার্যকর হবে।

এ ধরনের চর্চা সেই মনঅভ্যাস সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে, যা শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করবে স্বনির্দেশিত শিক্ষা ও বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মক্ষমতা অর্জনে। শিক্ষাবিষয়ক গবেষণা থেকে জানা যায়, শিক্ষার্থীরা যখন বুঝতে পারে তারা কিভাবে চিন্তা করতে ও শিখতে পারছে, তখন তাদের মধ্যে আরও বেশি অভিযোজন প্রবণতা বৃদ্ধিতে আগ্রহ সৃষ্টি হয়। এটা মানতে হবে যে, প্রতিটি শিক্ষার্থীর স্বভাবজাত সামর্থ্য আছে চিন্তা করার এবং তার চিন্তার পরিধি বিস্তার করার। বিদ্যায়তনের দায়িত্ব ছাত্রদের মধ্যে উচ্চ প্রত্যাশা, আকাক্সক্ষা ও জীবন দীর্ঘ শেখার (life long learning) মনোভাব তৈরি করা। এ বিষয়গুলো শিক্ষাদান পদ্ধতিতে সন্নিবেশিত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের ‘ক্রিটিক্যাল থিংকিং’ করার দক্ষতা অর্জনে ক্লাস শিক্ষকদের অগ্রণী ভূমিকা নিতে হয়।

শিক্ষাদান ক্ষেত্রে স্বীকৃত পদ্ধতিগুলো হচ্ছে- ক. চিন্তাভাবনামূলক প্রশ্ন দিয়ে ক্লাস শুরু করা আর আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেই প্রশ্নের সঠিক উত্তর খুঁজে পাওয়া, খ. ক্রিটিক্যাল থিংকিং সম্পর্কিত অনুশীলনে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি দেয়া, শিক্ষার্থীরা যা পাবে রিডিং অ্যাসাইনমেন্ট বা বাড়ির কাজ অথবা ক্লাসে প্রদর্শিত ভিডিও থেকে, গ. প্রতিটি প্রজেক্টের জন্য ৫-৬ জন শিক্ষার্থীর একটি গ্রুপ করে দেয়া, ঘ. অন্য ক্ষেত্রে ৮ থেকে ১০ জনের একটি গ্রুপ করা এবং কোনো একটি বিষয়ের ওপর প্রত্যেককে এক লাইন লিখতে বলা, ঙ. চিন্তাভাবনাকে ছবির মাধ্যমে প্রকাশ করতে বলা এবং চ. ক্রিটিক্যাল থিংকিংকে শুধু এক ধরনের ক্রিয়াকলাপ না ভেবে কালচারে পরিণত করা।

বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ‘চিন্তা স্কুল’ (‘থিংকিং স্কুল’) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং দেশগুলো সুফল পাচ্ছে। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সিঙ্গাপুর তাদের যুবকদের শিক্ষার মাধ্যমে সৃজনশীল চিন্তা-দক্ষতা অর্জনের এবং জীবনব্যাপী জ্ঞান অন্বেষণে উদ্দীপনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ১৯৯৭ সালে থিংকিং স্কুল বা চিন্তা স্কুল প্রতিষ্ঠা করে। দেশটির সরকার চিন্তা ও সৃজনশীল দক্ষতা অর্জনের উদ্দেশ্যে প্রাইমারি স্কুল থেকে কলেজ পর্যন্ত কারিকুলাম ও মূল্যায়ন পদ্ধতির মৌলিক পর্যালোচনার কাজটি হাতে নেয়। শুরুতে চিন্তা স্কুল সম্পর্কে এবং শিক্ষাদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা কিভাবে ক্রিটিক্যাল থিংকিং করার ক্ষমতা অর্জনে সামর্থ্য হবে সে ব্যাপারে শিক্ষকদের প্রান্তীয় জ্ঞান থাকার কারণে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। পরে বিদেশ থেকে প্রশিক্ষক এনে তাদের দিয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভিয়েতনামও চিন্তা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছে। যেহেতু এ ধরনের কর্মকাণ্ডে শিক্ষদের প্রচুর সময় দিতে হয়, সেহেতু তাদের টিচিং লোডও কম।

আমাদের দেশে প্রতি বছর ২০-২৫ লাখ যুবক চাকরির বাজারে প্রবেশ করছে। এ দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে আগামীতে চাকরির ধরন কী হবে তা ধারণা করাও কঠিন। দেশে আইটি সেক্টর দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে, শিল্প-কারখানায় উচ্চপ্রযুক্তির প্রয়োগ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশেও চাকরির ধরন পাল্টাচ্ছে। আজ যে শিশু প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হয়েছে, সে ২০৪০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করবে। সে সময় চাকরির ধরন কেমন হবে তা কারও পক্ষে ধারণা করা সম্ভব নয়। কাজেই অনিশ্চিত ও প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল ভবিষ্যতে টিকে থাকার জন্য যে জ্ঞান ও দক্ষতার প্রয়োজন তা আমাদের সন্তানদের দিতে আমাদের দেশের বিদ্যালয়গুলোকে অবশ্যই দায়িত্ব নিতে হবে। কালবিলম্ব না করে দেশে চিন্তা স্কুল গড়তে হবে। সরকারকে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে। থিংকিং স্কুলের প্রবক্তাদের বা এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, সনাতনপন্থীরা এ ধরনের স্কুল প্রতিষ্ঠায় বাধা দেবে এবং বাধা আসতে পারে স্কুল ও কলেজের শিক্ষকদের কাজ থেকেও। শিক্ষকদের তখন অধিক সময় দিতে হবে এবং নতুন পদ্ধতিগুলো জানতে হবে ও অনুশীলন করতে হবে। কিভাবে সফলতা আসবে তা চিন্তাভাবনা করেই অগ্রসর হতে হবে। মনে রাখতে হবে, সফলতা আসবে যদি আমরা এটাকে ‘অ্যাড অন’ হিসেবে না করে ‘বিল্ড ইন’ হিসেবে বাস্তবায়িত করি। এম এম শহিদুল হাসান : উপাচার্য, ইস্ট ওয়েষ্ট ইউনিভার্সিটি

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ