পৃথিবীতে বিপুল সম্ভাবনার দ্বার খুলে যাচ্ছে আমাদের সামনে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি আমাদের শেষ পর্যন্ত কোন দিগন্তে নিয়ে যাবে সেটা ধারণার অতীত। এক পা দু পা করে আমরা সভ্যতার একেকটি স্তর পার হয়ে যাচ্ছি। প্রযুক্তি আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। আবার আমাদের কাছ থেকে নৈতিকতা ও মূল্যবোধে কেড়ে নিয়েছে। এ কথা আমি বলতে চাই না যে প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের অগ্রগতি আমাদের সমাজের জন্য অপ্রয়োজনীয়। সভ্যতার উন্নয়নে তথ্য প্রযুক্তির অবদান অপূরণীয়। কিন্তু আমরা কি কখনো অনুধাবন করে দেখেছি যে প্রযুক্তির অকল্যাণকর দিকগুলো আমাদের অবস্থান কোথায় নামিয়ে দিচ্ছে? অবশ্য এর জন্য আবিষ্কার ও আবিষ্কারক কোনোটিই অপরাধী নয়, অপরাধী হচ্ছি আমরা ব্যবহারকারীরা।
বর্তমানে পৃথিবীর ৪২.২ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহারের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। ধারণা করা হয় ২০১৭ সালের শেষ নাগাদ পৃথিবীর অর্ধেক লোক ইন্টারনেট সংযোগের আওতায় আসবে | বিটিআরসির (BTRC) হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যাবহারকারীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার কোটি। ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন কোটি। প্রতি ১২ সেকেন্ডে একটি করে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খোলা হচ্ছে যেটা বাংলাদেশের জন্মহারের চেয়েও বেশি।
আজকাল কিছু অপ্রাপ্তবয়স্ক ও নৈতিক জ্ঞানহীন মানুষের হাতে আক্রান্ত হচ্ছে আমাদের তথ্য প্রযুক্তি। অপরাধের একটা বড় অংশ এই সব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে কেন্দ্র করে সংগঠিত হয়। মানুষের আবেগ ও অনুভূতিতে আঘাত হানার মাধ্যম হিসেবে এখন ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ সাইটগুলোকে। মূল্যবোধ বিবর্জিত মানুষেরা প্রযুক্তিকে তাদের ভোগ ও আয়েশের ক্ষেত্র তৈরি করে ফেলেছে। তথ্য বিকৃতি, ব্যক্তিগতভাবে সমাজের কোনো মানুষকে হেয় প্রতিপন্ন করা, প্রতিকৃতির ব্যঙ্গাত্মক উপস্থাপন ইত্যাদি বিষয় সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে দেওয়া একটি নিত্যনৈমিত্তিক কাজে পরিণত হয়েছে। ব্যক্তি অথবা প্রতিষ্ঠানের তথ্য ও ছবি চুরি করে ব্ল্যাকমেল করার মতো ঘটনা অহরহ ঘটছে। অপরাধী চক্র তাদের অপরাধ কর্মকাণ্ড সংঘটিত করার জন্য ইন্টারনেটকে গোপনীয় মাধ্যম হিসেবে বেছে নেয়। ইন্টারনেট ব্যবহারকারী সহজে নিজের পরিচয় গোপন রাখতে পারে বলে কাউকে হুমকি দেওয়া, ভুয়া সম্পর্কের ফাঁদে ফেলে টাকা হাতিয়ে নেওয়া অথবা প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য ব্যক্তিগত অন্তরঙ্গ মুহূর্তের দৃশ্য ধারণ করে বিভিন্ন অনলাইন সাইটে ছড়িয়ে দেওয়া এসব কাজ অনায়াসে সম্ভব হয়।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে কম্পিউটারের তথ্য হ্যাকিং সম্পর্কিত ঘটনা বেশি ঘটছে। বিশেষ করে উঠতি বয়সী তরুণদের মধ্যে এই প্রবণতাটি বেশি লক্ষ্য করা যায়। তরুণদের পাশাপাশি বিভিন্ন মেইন স্ট্রিম মিডিয়াগুলোও নানাভাবে ব্যক্তিগত তথ্যের অপব্যবহারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় গত ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের তথাকথিত হ্যাকার গ্রুপ ব্ল্যাক হ্যাট হ্যাকার দ্বারা ভারতের প্রায় পঁচিশ হাজারেরও বেশি ওয়েবসাইট আক্রান্ত হয় | এগুলোর মধ্যে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ ওয়েবসাইটসহ বিএসএফের (Border Security Force) ওয়েবসাইটও ছিল। তা ছাড়া একই বছর কক্সবাজারের রামুতে ছড়িয়ে পড়া সহিংসতার পেছনে ফেসবুকের অপব্যবহারই দায়ী | বৌদ্ধ ধর্মের এক ব্যক্তির নাম দিয়ে খোলা ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে পবিত্র কোরআন শরিফের একটি অবমাননাকর ছবি প্রকাশ করা হয় | এই ঘটনার জের ধরে ওই এলাকায় সাধারণ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হন | অথচ পরবর্তীতে ছবিটির সত্যতা যাচাই সম্ভব হয়নি। অনুসন্ধান করে দেখা যায় ছবি প্রকাশকারী ব্যক্তির বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব নেই। এটা ছিল নিছক বানোয়াট এক ব্যাপার। সমাজে ঘটে যাওয়া এ ধরনের অপ্রত্যাশিত ঘটনা বস্তুত সামাজিক অবক্ষয়ের বহিঃপ্রকাশ। মূলত শুধু ইন্টারনেট নয় বরং প্রযুক্তির অন্যান্য খাতকে ব্যবহার করেও যেকোনো অপকর্ম খুব দ্রুত ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের প্রভাব, হাতে হাতে স্মার্টফোনের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ক্লিপস, গোপন ক্যামেরায় দৃশ্য ধারণ ইত্যাদি বিষয়গুলি আমাদের সমাজের অপরিণত বয়সের ছেলেমেয়েদের অশালীনতার দিকে ধাবিত করছে।