প্রশ্ন: তাবলীগের এই মেহনত ইলিয়াস সাহেব উদ্ভাবন করেছেন। এটাতো ইলিয়াসি তাবলীগ। রাসূলের তাবলীগ নয়। তাবলীগের এই পদ্ধতি কি বিদআত নয়?

উত্তর:

তাবলীগ এবং বিদআত কোনটির সাথে পরিচিত না হলেই এমন প্রশ্নের উদ্রেক হতে পারে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি শরীয়তকে উপলব্ধি করেছেন এবং তাবলীগ ও বিদআত চিনতে পেরেছেন তার মাঝে এমন প্রশ্নই আসতে পারে না। এজন্য খুব বড় মানের পণ্ডিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। বরং তাবলীগ ও বিদ‘আতের সাধারণ বুঝ থাকাই যথেষ্ট।

প্রথমে তাবলীগ শব্দের সাথে একটু পরিচিত হয়ে পরে আমরা বিদ‘আত নিয়ে কিঞ্চিত আলোকপাত করব। ইনশা-আল্লাহ। আমরা জানি যে, “তাবলীগ” আরবী শব্দ, যার অর্থ পৌঁছে দেয়া, প্রচার করা। আরবী “তাবলীগ” শব্দ মুল থেকে কুরআন পাকে একাধিক জায়গায় ক্রিয়াপদ ব্যবহার করা হয়েছে। নবী করীম - صلى الله عليه و سلم- কে উদ্দেশ্য করে কুরআনে বলা হয়েছে,

﴾ يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ ﴿

অর্থাৎ “হে রাসুল, আপনি তাবলীগ করুন (পৌছে দিন) আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার উপর যা অবতীর্ণ হয়েছে। আর যদি আপনি এরূপ না করেন, তবে আপনি তার পয়গামের তাবলীগ করলেন না ( পৌছালেন না ) ... । ( সুরা মায়েদা: ৬৭ )

শুধু আমাদের নবী করীম - صلى الله عليه و سلم- নন, বরং রিসালত প্রাপ্ত সব নবীরই মূল উদ্দেশ্য বা কাজই ছিল দ্বীনের তাবলীগ বা প্রচার প্রসার। নবীদেরকে প্রেরণের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে দ্বীনের তাবলীগ করা। নবীগণের সুন্নাত বা কর্ম পরিচয় দিতে গিয়ে আল্লাহ বলেন, 

﴿ الَّذِينَ يُبَلِّغُونَ رِسَالَاتِ اللَّه وَيَخْشَوْنَهُ وَلَا يَخْشَوْنَ أَحَدًا إِلَّا اللَّهِ وكَفَى بِاللهِ حَسِيْبًا ﴾

“ যারা আল্লাহর পয়গামের তাবলীগ করে (প্রচার করে) এবং তাকে ভয় করে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করে না। আর হিসাব গ্রহণের জন্য আল্লাহ যথেষ্ঠ ”। (সুরা আহযাব:৩৯)

অপরদিকে নবী করীম - صلى الله عليه و سلم- এরশাদ করেন, " بلغوا عنى ولو أية ". 

অর্থাৎ আমার পক্ষ হতে একটি আয়াত হলেও তাবলীগ কর তথা পৌঁছে দাও। ( বুখারী, হাদীস নং: ৩২৭৪ ) 

নবী করীম - صلى الله عليه و سلم- এর একটি বাণী জানা থাকলেও তার তাবলীগ করা, যে ব্যক্তি জানে না তার কাছে তা প্রচার করার দায়িত্ব এই উম্মতের সকলের।

এভাবে একাধিক আয়াত ও হাদীসে তাবলীগের নির্দেশ এসেছে। কুরআন ও হাদীস এর ফযিলতে ভরপুর। সব নবীদের প্রধান কাজই ছিল মানুষকে দ্বীনের প্রতি আহবান, আর এই আহবানের নামই তাবলীগ। তাই আল্লাহ প্রদত্ত দায়িত্ব যা মৌলিকভাবে নবীদের উপরেই আরোপ করা হয়েছিল, শেষ নবীর পর কোন নবী আসবেন না বিধায় এ গুরুভার উম্মতে মুহাম্মদির উপর দেয়া হয়েছে। মূলত এই দায়িত্বই এই উম্মতকে অন্য উম্মতের উপর মর্যদায় নিয়ে গেছে। অন্য উম্মতের ইবাদত বেশি থাকা সত্ত্বেও তাদের চেয়ে এই উম্মতের শ্রেষ্টত্বের প্রধাণ কারণই হলো তাবলীগ বা দ্বীনের দাওয়াতি কাজ করা। যেমন আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের এরশাদ,

كُنتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللَّهِৃ ( آل عمران:১১০ ) 

“ তোমরা সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত, মানবজাতির কল্যাণের জন্যই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎকাজের আদেশ প্রদান করবে ও অন্যায় কাজ হতে বাধা প্রদান করবে এবং আল্লাহর উপর ঈমান আনবে।...” (আলে-ইমরান, ১১০)।

কিন' সর্বদাই দ্বীনের প্রধান গুরুভার মুষ্টিময় কিছু মানুষের মাধ্যমেই প্রতিষ্টিত হতে দেখা গেছে। বিশেষ করে কোন কোন গুরু দায়িত্ব যখন সবাই ভুলে যায় এবং সেই দায়িত্বের চেতনাই মন থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায় তখন হাতেগুণা এক দুই জন এই দায়িত্বের জন্য দণ্ডায়মান হন। যাদের সুত্র ধরেই ঐ কাজের চেতনা অন্যের মাঝে ফিরে আসে। এই এমন একটি কাজ হলো তাবলীগ। মানুষ দ্বীন ও দ্বীনের কাজ ভুলে গিয়ে একাকার হয়ে গেল, দ্বীন মুষ্টিমেয় মানুষের মাঝে সীমাবদ্ধ হয়ে গেল, পুরোহীতদের ন্যায় কিছু মানুষ দ্বীন পালন করে, খানকা বসায়, আর বাকীরা তাদেরকে হাদীফা তুহফা দিয়ে দুয়া নিয়েই দ্বীনদ্বারিত্বের ঢেকুর তুলে, এমন নাজুক পরিসি'তিতে আল্লাহ তায়ালা ইলিয়াস রাহ. এর মত ব্যক্তিত্বের ভিতর দ্বীনের তাবলীগের চিন্তা মাথায় ঢুকিয়ে ব্যতিব্যস্ত করে ফেলেন। তার মাঝে উম্মতকে নিয়ে চিন্তা শুরু হয়। নিজের জীবন কুরবান করে মানুষের মাঝে তাবলীগের স্পৃহা তৈরী করেন। শুরু হয় দ্বীনের মেহনত। কালেমা জানে না অথচ মুসলমান, কালেমা শিখতে থাকে। বে-নামাজী নামাজী হতে থাকে। দ্বীনী ইলমের প্রতি বিদ্ধেষী ইলমের প্রতি আগ্রহী হতে থাকে। সিনেমা মুখি মানুষগুলো মসজিদ মুখি হতে থাকে। স্কুল কলেজ মুখি লোকগুলো মাদ্রাসা মুখি হতে থাকে। পাশ্চাত্য সভ্যতায় আকৃষ্ট লোকগুলো সেই সভ্যতা ঘৃণাভরে ছেড়ে দিয়ে মুহাম্মাদ সা. এর সভ্যতার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে নিজের জীবনে তা আনতে থাকে। শুরু হয় পরিবর্তন। বে-দ্বীন দ্বীনদার হওয়ার এই দৃশ্যকে কেবল অন্ধই অস্বীকার করতে পারে। অমুক দলের ঝাকুনির কারণে রানা প্লাজার ধ্বংস হয়েছে এমন প্রলাপ যারা বকতে পারে তারাই অস্বীকার করতে তাবলীগের মেহনতের ফলাফল। এগুলোইতো ছিল নবীদের কাজ। তাই নবীদের কাজকে যারা নিজের জীবন বিলিয়ে আন্‌জাম দেন তাদের কর্ম নিয়ে ব্যঙ্গ করা নবীদের কাজ নিয়ে ব্যঙ্গ করার নামান্তর।

একটি বাস্তব ঘটনা শুনুন, সিলেটের জনৈক পীর সাহেব যিনি তাবলীগের বিরোধিতা করতেন। তার এক বিশেষ মুরীদকে তাবলীগওলারা অনেক বুঝিয়ে এক চিল্লার জন্য নিয়ে চলে যায়। তাবলীগে যাওয়ার পর পীরতন্ত্রের অসারতা তার বুঝে আসে। একমাত্র নবীর সুন্নাতই মুক্তির পথ তার মাথায় ঢুকে। নবীর সুন্নাত ছাড়া সমস্ত তরীকাই গোমরাহী সে বুঝতে পারে। মুরীদ টাকা পয়সাওয়ালা এক বিশেষ ব্যক্তি হওয়ায় পীর সাহেব পূর্বের মত নিজেই তার বাড়ীতে যান। তাবলীগে যাওয়ার কারণে পীর সাহেবের রাগ বহাল আছে। বাড়ীতে গেলে পীরদের স্বভাবজাত অনুযায়ীই এলাকার অন্যান্য মুরীদরা সমবেত হন। পীর তার সেই পূর্বের ভক্তকে ডাক দেন। ডাক দিলে তিনি সামনে এসে বসেন। এবার শুরু হয় পীর সাহেবের ধমক। তিনি নিশ্চুপ। মাথা নিচু করে শুধু পীর সাহেবের কথা শুনছেন। শেষ পর্যন্ত পীর সাহেব বলেই ফেললেন, তুই কাফের হয়ে গেছিস। মুরীদ একথা শুনে বললেন, হুজুর তাহলে এখন কি করতে হবে? পীর সাহেব বললেন আবার কালেমা পড়ে মুসলমান হও। মুরীদ: কালেমাটি বলে দিন। পীর সাহেব: ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ’ পড়। মুরীদ: হুজুর এটা পড়ে হব না অন্যটা বলুন। পীর সাহেব এবার জোরে ধমক দিয়ে, বেয়াদব, দেখছ! তোমরা তাবলীগে গিয়ে কত বেয়াদব হয়েছে, এটা ছাড়া আবার মুসলমান হয় নাকি। তখন মুরীদ একটু জোরেই বলল, হুজুর, এটাই যদি আবার পড়তে হয় তবে, আপনি এক নাম্বার কাফের, তাবলীগওয়ালারা দুই নাম্বার কাফের, আমি তিন নাম্বার কাফের। আমিতো তাবলীগে গিয়ে এতদিন এই কালেমাটার উপরই মেহনত শিখেছি। সাথে সাথে হৈ চৈ শুরু হয়ে মজলিস ভেঙ্গে যায় এবং চিরদিনের জন্য পীর সাহেবের সাথে তার সম্পর্ক নষ্ট হয়।

ঠিক একইভাবে তাবলীগের কাজ যদি দ্বীনের কাজ বা নবীর কাজ না হয় তা হলে দ্বীনের কাজ আর কি?

হ্যাঁ ইলিয়াস রাহ. নবী নন। তার কাজ নবীদের মত ভুলের উর্দ্ধে হবে এমন নয়। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত নবীরা ছাড়া কাউকেউ ভুলের উর্দ্ধে মনে করেন না। কোন কাজের বাস্তব কোন ভুল শরীয়তের বাস্তব বিচারে ধরা পড়লে তার অনুসরণ কেউ আপনাকে করতে বলবে না। এমন অনেক সংশোধনী তাবলীগের মেহনতের ভিতর এসেছে। তবে এ ক্ষেত্রে এটাও খেয়াল রাখতে হবে যে, আমি যেটাকে ভুল মনে করলাম সেটা যে বাস্তবেই ভুল হবে এমন নাও হতে পারে। এই কাজটা ভুল বলে আমার কাছে তো ওহী নেই। আমার বুঝ মতে ভুলটাই যে প্রকৃতপক্ষে ভুল বা কুরআন হাদীস মতে ভুল হবে এমন নয়।

এবার আসি তার একাজকে বিদআত বলা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত এ প্রসঙ্গে।

বিদ‘আত সম্পর্কে অজ্ঞতা অনেক সময় যেমন অনেক বিদ‘আত বুঝতে দেয় না, এর বিপরীত আবার অনেক সময় বিদ‘আত নয় এমন অনেক জিনিষকে আমরা বিদ‘আত বলে ফেলি। বিদ‘আত সম্পর্কে যিনি সঠিক জ্ঞান রাখেন তিনি বাস্তব বিদ‘আতকে বিদঅত বলে পরিহার করেন, আর যা বিদ‘আত নয় এমন কাজকে বিদ‘আত বলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেন না। পক্ষান্তরে বিদআত সম্পর্কে অজ্ঞ ব্যক্তিদের দুই প্রান্তে বসবাস। একদল বিদ‘আত না চিনে বিদ‘আতে লিপ্ত হয়। আরেক বিদ‘আত নয় এমন কর্মকে বিদ‘আত বলে মুসলিমদের মাঝে বিভ্রান্তি, অনেক্য, পরস্পরের অবমূল্যায়ন সৃষ্টি করেন। উভয়টাই অজ্ঞতার কারণ। যে রাসুল ৎ বলেছেন,

: ্র مَنْ أَحْدَثَ فِى أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ গ্ধ.

“রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, আমাদের এই দ্বীনে যে ব্যক্তি নতুন কিছু উদ্ভাবন করবে তা প্রত্যাখ্যাত।”

যে রাসুল সা. বলেছেন, “প্রত্যেক বিদআত গোমরাহী এবং প্রত্যেক গোমরাহী জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত”। সহীহ ইবনু খুযায়মাহ, নবীজী সা. এর খুতবার গুণাবলী অনুচ্ছেদ, নং ১৮৭৫) 

যে রাসুল সা. বিদআতে লিপ্ত ব্যক্তিকে হাওযে কাওসারের পানি পান করতে না দিয়ে তাড়িয়ে দিবেন, তাঁর পবিত্র মুখ থেকেই পবিত্র বাণী উচ্চারিত হয়েছে,

্র مَنْ سَنَّ فِى الإِسْلاَمِ سُنَّةً حَسَنَةً فَعُمِلَ بِهَا بَعْدَهُ كُتِبَ لَهُ مِثْلُ أَجْرِ مَنْ عَمِلَ بِهَا وَلاَ يَنْقُصُ مِنْ أُجُورِهِمْ شَىْءٌ وَمَنْ سَنَّ فِى الإِسْلاَمِ سُنَّةً سَيِّئَةً فَعُمِلَ بِهَا بَعْدَهُ كُتِبَ عَلَيْهِ مِثْلُ وِزْرِ مَنْ عَمِلَ بِهَا وَلاَ يَنْقُصُ مِنْ أَوْزَارِهِمْ شَىْءٌ গ্ধ.

“ কেউ ইসলামে কোন ভাল কাজ চালু করল অতঃপর তার এই কাজের উপর আমল করা হলে আমলকারীর মতই তার আমলনামায় প্রতিদান লিখা হবে, তবে আমলকারীর প্রতিদান থেকে কমানো হবে না। এভাবে কেউ ইসলামে কোন মন্দ কর্ম চালু করলে এবং এরপর আমল করা হলে আমলকারীর গোনাহর পরিমাণ তার কাধে চাপানো হবে, আমলকারীর গোনাহ কমানো ছাড়া। (মুসলিম:৬৯৭৫)।

তাই আমাদেরকে বুঝতে হবে বিদ‘আত কি? রাসূল সা. এর পরে আবষ্কার হলেই তা তিরস্কারযোগ্য বিদ‘আত হবে এমন নয় বরং প্রশংসনীয় কর্মও হতে পারে যেমনটি আমরা উপরোক্ত হাদীস থেকে বুঝতে পারলাম। তবে বিদআতের সঠিক ধারণা না থাকার ফলে কেউ নতুন কাজের প্রশংসার হাদীসকে নিজের আবিস্কৃত প্রকৃত বিদ‘আতের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেন এবং বিভিন্ন বাহানায় বিদআতে লিপ্ত হন। আবার কেউ কেউ প্রকৃত বিদআতের হাদীসগুলোকে যে কোন প্রশংসনীয় কাজে লাগান। উভয়টিই হাদীসের অপপ্রয়োগ।

এবার আমরা দেখি বিদআত কি? উলামায়ে বিভিন্ন ভাবে এর সংজ্ঞা দিয়ে থাকেন। সহজ কথায় দ্বীনের মধ্যে নতুন কোন কর্মের সৃষ্টি যা মানুষকেই রাসূলের সুন্নাত তরীক্বা বা পদ্ধতি থেকে সরায় তাই বিদআত। যেমন আল-ই‘তিসামে লিখেন,

" البدعة طريقة في الدين مخترعة تضاهي الشرعية يقصد بالسلوك عليها ما يقصد بالطريقة الشرعية ".(الاعتصام، الباب الأول في تعريف البدع وبيان معناها...،১-২৬)

“বিদ‘আত হচ্ছে, দ্বীনের মধ্যে আবিষ্কৃত পদ্ধতি, যা শরয়ী পদ্ধতির সামঞ্জস্য, এই পদ্ধতির উপর চলার সেই উদ্দেশ্য যা শরয়ী পদ্ধতির উপর চলার উদ্দেশ্য ।”(আল-ই‘তিসাম,বিদআতের সংজ্ঞা ও তার অর্থ..., ১/২৬)

মোট কথা দ্বীনের যে কাজে রাসূল সা. এর যে পদ্ধতি রয়েছে তাকে ঐ পদ্ধতি ছেড়ে অন্য পদ্ধতিতে করা, যা দ্বীন নয় তাকে দ্বীন ভেবে করা বিদআত। একটি ছোট উদাহরণ যেমন, রাসূল সা. তার উপর দুরুদ পড়তে বলেছেন, সাহাবারা একাকি যার যার মতে দুরুদ পড়তেন। এখন আমরা সমবেত হয়ে তালে তাল মিলিয়ে দুরুদ পড়লে ইবাদতে তাদের পদ্ধতি থেকে সরে গেলাম এটাই বিদআত। রাসূল নিয়্যাত মনে মনে করতেন, কখনো মুখে উচ্চারণ করতেন না। আমরা মুখে নিয়্যাত করা নেকী বলে আমল শুরু করলে, তিনি যা করতেন না তা করতে লাগলাম ইত্যাদি। এভাবে রাসূল সারা জীবন যিকর করলেন “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” আমি বিভিন্ন যুক্তি দেখিয়ে শুধু ‘ইল্লাল্লাহ’ শুরু করে দিলাম, এটা আমাকে ইবাদতের মূল অবস'া থেকে বা রাসূলের অনুসরণ থেকে ফিরিয়ে দিল।

পক্ষান্তরে যে কাজ আমাকে রাসূলে সুন্নাতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে তা নতুন হলেও বিদআত নয়। বরং হাদীসে প্রশংসনীয় কাজের অন্তর্ভুক্ত। যেমন, ইলমের অর্জনের জন্য সাহাবাদের সময় মাদ্রাসা ছিল না। এখন আমি একটি মাদ্রাসা ও তার বিভিন্ন সিস্টেম তৈরী করলাম যাতে মানুষ ইলম অর্জন করতে পারতে। আমার এই কর্ম নতুন তবে তা বিদআত নয়, কেননা এই কাজ আমাকে মূল ইবাদত ইলম অর্জন থেকে সরাচ্ছে না বরং তার কাছে নিয়ে যাচ্ছে। আরেকটি উদাহরণ দেখুন, কুরআন তেলাওয়াত একটি ইবাদত। সাহাবারা কুরআন সরাসরি পড়ে শিখতেন। তাদের সময় কায়েদা ছিল না। আমি একটি কায়েদা বানালাম। এটি আমাকে মূল ইবাদতে নিতে সাহায্য করে। তাই এই কাজটি নতুন কাজের প্রশংসনীয় হাদীসে এটি অন্তর্ভুক্ত।

এবার আসি ইলিয়াস রাহ. এর পদ্ধতিতে। দাওয়াতের ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্দেশ হিকমাত অবলম্বন করে দাওয়াত দেয়া। হিকমাত অবলম্বন না করলে নবীরাও সফল হতে পারেন না সে ক্ষেত্রে উম্মত সফল হওয়া দুরের কথা। হিকমতের কার্যকারিতার একটু উদাহরণ পেশ করছি।

হুদাইবিয়ার সন্ধির চুক্তিনামার সবকটি চুক্তি বাহ্যত মুসলমানদের বিপক্ষে থাকায় মুসলমানরা মনে মনে খুব ক্ষুব্ধ ছিলেন। অনেক আশা আকাংখা নিয়ে উমরা করতে এসে কাফেরদের একগুঁয়েমির সামনে পরাজিত হয়ে তারা চলে যাবেন এটা তাদের মন কোন অবস'ায়ই মেনে নিচ্ছিল না। উমরাহ না করেই মাথা কামিয়ে হালাল হওয়ার জন্য রাসূল সা. তাদেরকে নির্দেশ দিলেন। কিন' কেউ কোন কথা শুনছে না। কেউ মাথা কামাচ্ছে না, সবাই বসে আছে। নবীর নির্দেশ না শুনার কি পরিণতি তা যেন তাদের মনেই নেই, বরং এই ভয়াবহ পরিণতিতে রাসূল নিজেই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। অবশেষে ভিতরে গিয়ে তার স্ত্রী উম্মে সালামার কাছে পেরেশানির কথা ব্যক্ত করলে উম্মে সালামা বলেন, আপনি তাদেরকে কিছু না বলে নিজে প্রথমে মাথা কামিয়ে ফেলুন। রাসূল তাবুর বাহিরে এসে নাপিত ডেকে তার মাথা কামাতে বললেন। এ দেখে সব সাহাবা মাথা কামানো আরম্ভ করে দিলেন। এখানে আমাদের মূল বুঝার বিষয়টি হচ্ছে: আগেরটি ছিল নবীর নির্দেশ যা মান্য করা সবার উপর ওয়াজিব, কিন' কেউ মানছেন না। পরেরটি নবীর কর্ম। করা ওয়াজিব নয় করলে ভাল না করলে কোন অসুবিধা নেই। কিন' ওয়াজিবটি কেউ মানেননি। আর যা ওয়াজিব নয় তা সবাই আমলে এনেছেন। এটাই ছিল সেই পরিসি'তির ক্ষেত্রে হিকমত অবলম্বন। যা এসেছিল একজন স্ত্রীর মাথায় যে স্বামীর চেয়ে মর্যাদায় নিম্নে, একজন নারীর মাথায় যে পুরষের চেয়ে মর্যাদায় নিচে, একজন উম্মতির মাথায় নবী সাথে যার তুলনা হয় না।

এই হিকমাত অবলম্বন করে তাবলীগ করা সবার জন্য জরুরী। রাসূল সা. যাকে যে শব্দে যেভাবে যে সময়ে দাওয়াত দিয়েছেন ঠিক ঐভাবে, ঐ সময়ে, ঐ শব্দে, ঐ ভাষায় তাবলীগ করা জরুরী নয়। কেননা তাবলীগ মূল ইবাদত নয় বরং তা মূল ইবাদতে নিয়ে যাওয়ার রাস্তা। যেমন, সালাত মূল ইবাদত, এখানে হেরফের করার সুযোগ নেই। মসজিদে সালাত আদায় করতে যাওয়াও একটি ইবাদত তবে তা মূল নয়। এরও একটি সওয়াব আছে। রাসূল সা. 

হেটে বা উটে চড়ে গেলে আমি আপনি রিক্সায় বা সাইকেলেও গেলেও মসজিদের যাওয়ার সওয়াব পাব। এখানে রিক্সা চড়া মূল ইবাদতে সালাতে কোন হেরফের হচ্ছে না।

সংক্ষিপ্ত এই আলোচনা থেকে আশাকরি বিবেকমান ব্যক্তি মাত্রই বুঝতে পারবেন যে, দাওয়াত বা তাবলীগের বিভিন্ন পদ্ধতি বা কার্যক্রম অবলম্বন করা বিদআতের আওতাভুক্ততো নয়ই, বরং এটি শরীয়তের মূল ইবাদতে সবাইকে নিয়ে যাচ্ছে তাই তা একটি প্রশংসনীয় কর্ম। যার প্রশংসা রাসূল সা. নিজে তাঁর হাদীসে করেছেন।

.

পোস্টটি লিখেছেন: 

বিশিষ্ট গবেষক

আলেম

 মুফতি মুস্তাফা সোহাইল হেলালি হাফিযাহুল্লাহ। 


শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে