শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে

সৌদি আরবের মদিনা শহর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে ওয়াদি-ই-আল বায়দা নামক পাহাড়ে ঘেরা এক উপত্যকা আছে, যাকে মানুষ ‘জ্বিনের উপত্যকা’ বা ‘ওয়াদি জ্বিন’ নামও ডাকে। উপত্যকার মাঝ দিয়ে দক্ষিন-পূর্ব দিকে একটা রাস্তা চলে গেছে মদিনা শহরে (উপরে ম্যাপ দেখুন)। আপাত দৃষ্টিতে ওই রাস্তার উপর দড়িয়ে দেখলে মনে হয় রাস্তাটির ঢাল উত্তর-পশ্চিম দিকে, অর্থাত ওয়াদি জ্বিন বরারবর রাস্তাটি ঢালু, আর মদিনা বরাবর রাস্তাটি উঁচু। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, এই জ্বিনের উপত্যকায় সবকিছু ঢালুর বিপরীত দিকে গড়ায়, মানে সাধারণ নিয়মের ঠিক উল্টো। এমনকি রহস্যঘেরা এই পাহাড়ে বন্ধ গাড়িও ঢালুর বিপরীতে মদিনা শহর বরাবর চলতে থাকে!

এসব অস্বাভাবিক ঘটনা দেখে স্থানীয় মানুষ ভেবে বসলো যে এটা কোনো জ্বিনের কাজ হবে! ওয়াদি-ই-আল বায়দা পাহাড়ে জ্বিন থাকে আর ওই জ্বিনই সবকিছুকে টেনে পবিত্র ভূমি মদিনার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। নির্বোধ লোকেরা এর ভেতরে আল্লাহর 'নিশানা' খোজার চেষ্টা করলো। আর এ খোঁজা খুঁজিতে নির্বোধ 'পাকি আদম'-রা সবার চেয়ে এগিয়ে। তারা এই ঘটনা ইউটিউব ভিডিও এবং বিভিন্ন ওয়েব সাইটের মাধম্যে ধার্মিক মানুষদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে লাগলো। এখন হাজার হাজার ধার্মিক মুসলমানগণ প্রতি বছর ওয়াদি জ্বীন এলাকায় যাচ্ছে জ্বিন এবং জ্বিনের কারসাজি দেখার জন্য!

আসলে ঘটনাটা কি? পবিত্র কোরানে জ্বীনের কথা উল্লেখ আছে। আমি বলছিনা যে জ্বীনের অস্তিত্ব নেই। তবে আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আসলেই কি ওই পাহাড়ে কোনো জ্বিন থাকে? নাকি ওই এলাকাতে যে অস্বাভাবিক ঘটনার বর্ণনা করা হচ্ছে তা নিতান্তই কোনো সাধারণ প্রাকৃতিক ঘটনা?

ওয়াদি জ্বিন এলাকার ঘটনাটা সম্পূর্ণই স্বাভাবিক একটি ঘটনা, যা ঘটছে বিজ্ঞানী নিউটনের আবিষ্কৃত 'অভিকর্ষতার সূত্র' অনুসরণ করেই। প্রাকৃতিক এই ঘটনাটি খুব সুন্দর করে আরেক বুদ্ধিমান মুসলমান ভাই মোহাম্মদ আলী তার ‘জ্বিন এন্ড ডেমন’ ওয়েব সাইট (www.jinndemons.com) এ সুন্দর করে ব্যাখ্যা করেছেন। ওয়াদি-ই-আল বায়দা উপত্যকা এলাকাটি পাহাড় দিয়ে এমন ভাবে ঘেরা যাতে করে উপত্যকায় দাড়িয়ে মনে হয় যে উপত্যকার ঢালটি মদিনার বিপরীতমুখী। আর তাই যখন থেমে থাকা কোনো গাড়ি আপনা আপনি রাস্তার ঢালের বিপরীতে মদিনা অভিমুখে চলতে শুরু করে তখন অবাক হওয়ারই কথা। প্রকৃতপক্ষে, রাস্তাটি কিন্তু মদিনা অভিমুখেই ঢালু। এটা ওয়াদি জ্বিন এলাকায় দাড়িয়ে বোঝা না গেলেও, অনেক উপর থেকে দেখলে ঠিকই বোঝা যায়। রাস্তাটি যে মদিনা অভিমুখে ঢালু তা প্রমান করার জন্য ওয়াদি জ্বিন-এ যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নাই। ঘরে বসে ইন্টারনেট এর মাধ্যমে ত্রি-মাত্রিক 'গুগল আর্থ' (Google Earth) সার্ভিস ব্যবহার করে তা সহজেই জানা যায়।

গুগল তার স্যাটেলাইট এর মাধ্যমে গোটা ভূপৃষ্ঠের ত্রি-মাত্রিক মানচিত্র তৈরী করেছে। ত্রি-মাত্রিক গুগল আর্থ সফটওয়্যার ব্যবহার করে ঘরে বসেই বিনা মূল্যে পৃথিবীর উপরিভাগের যে কোনো স্থানের উচ্চতা বা অবনতি এবং দূরত্ব নির্ণয় করা যায় খুব সহজেই। গুগল আর্থ এর সার্চ বক্স-এ আপনি যদি টাইপ করেন Wadi jinn বা এই জায়গার করডিনেইট (Coordinates) 24°43’21.65″N 39°26’57.67″E, তাহলে গুগল আর্থ সরাসরি আপনাকে নিয়ে যাবে ‘জ্বিনের উপত্যকা’ বা ‘ওয়াদি জ্বিন’ নামক জায়গাটিতে (উপরে ম্যাপ দেখুন)। ম্যাপটিতে হলুদ দাগে যে রাস্তা নির্দেশ করছে তা সেই রাস্তা যেখানে মনে হয়ে গাড়ি একা একাই ঢালের বিপরীতে মদিনা অভিমুখে চলতে পারে (তির চিন্হ মদিনা অভিমুখ নির্দেশ করে)।

এখন, আপনি যদি কম্পিউটার এর মাউস কার্সারটি 'ওয়াদি জ্বিন' এর উপর রাখেন তাহলে আপনি ওই জায়গার উচ্চতা পাবেন প্রায় ৯২৭ মিটার, অর্থাত এই জায়গাটি সুমদ্র সমতল থেকে ৯২৭ মিটার উপরে। এবার আপনি যদি কার্সারটিকে সরিয়ে রাস্তার উপর দিয়ে মদিনা অভিমুখে টেনে নিন তাহলে দেখতে পাবেন উচ্চতা ক্রমান্বয়ে কমছে। উদহারণ স্বরূপ ৭ কিলোমিটার দূরে লাল বৃত্ত এলাকায় উচ্চতা পাবেন ৬২১ মিটার (ম্যাপের নিচের দিকে ডায়নামিক বার এই সব মান প্রদর্শন করে)। অর্থাত, ৭ কিলোমিটার দূরের এই জায়গাটি 'ওয়াদি জ্বিন' থেকে ৩০৬ মিটার নিচু বা ঢালু। সুতরাং, কোনো গাড়ি বা বল বা কোকা কোলার ক্যান স্বাভাবিক ভাবেই 'ওয়াদি জ্বিন' থেকে মদিনা অভিমুখে গড়িয়ে পড়বে পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ বলের টানে। কিভাবে এই বল কাজ করে তা গ্যালিলিও এবং নিউটন দেখিয়ে গেছেন অনেক আগেই। এর জন্য জ্বিনের কারসাজির কোনো প্রয়োজন নাই।

আর তাছাড়া, 'ওয়াদি জ্বিন' এর মত জায়গা পৃথিবীতে রয়েছে অসংখ্য (লিংকটি দেখুন), যেখানে ভৌগলিক পারিপার্শিকতার কারণে মনে হয় গাড়ি বা গোলাকার কোনো কিছু গড়িয়ে ঢালের বিপরীত দিকে উঠে যাচ্ছে! এমনটি হয় একধরনের দৃষ্টিভ্রম থেকে। এ ধরনের জায়গাকে বালা হয় 'গ্রাভিটি হিল' অথবা 'মেজেস্টিক হিল'--- স্বাভাবিক ভাবেই 'ওয়াদি জ্বিন' ও একটি 'গ্রাভিটি হিল' অথবা 'মেজেস্টিক হিল', যেখানে জ্বিনের কোনো কারবার নাই।

আরবের হাবলাগুলা উটের সাথে থেকে থেকে গাঁধা হয়ে গেছে, আর তার সাথে যোগ হয়েছে পাকি মক্কেলগুলা! সময় এসেছে মুসলমানদের আরো স্মার্ট হওয়ার। মুসলমানদের এটা ভুলে গেলে চলবে না যে তাদের রয়েছে 'আল কোরান' যেটাতে রটনা বা Hoax এর কোনো স্থান নাই।

খোন্দকার মেহেদী আকরাম
শেফিল্ড
২০ নভেম্বর ২০১৪

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ