জরায়ুর ফাইব্রয়েড কি?
টিউমার শব্দটি শুনলে বেশিরভাগ মানুষের মনেই ক্যান্সারের আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। তবে ইউটেরাসের টিউমার জানলে সে মাত্রা কয়েক গুন বেড়ে যায়। জরায়ু বা ইউটেরাসের মধ্যে বিনাইন (ক্যান্সার নয়) টিউমারকে মেডিকেল সাইন্সের ভাষায় বলে ইউটেরাইন ফাইব্রয়েড। এটির উৎপত্তি স্থান জরায়ুর পেশি। কিন্তু জেনে রাখুন, এই টিউমার থেকে ক্যান্সার হয় না। বিশ্বের প্রায় সাড়ে ৬ শতাংশ মহিলার জরায়ুতে ফাইব্রয়েড আছে। কিন্তু এর সুনির্দিষ্ট উপসর্গ না থাকায় এবং এই রোগ সম্পর্কে সঠিক ধারনা না থাকায় তা সনাক্ত করা কঠিন ছিল। বর্তমান বিশ্বের নারীরা আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি সচেতন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে তাই এখন রোগও দ্রুত নির্ণয় হচ্ছে। চলুন জেনে নিই জরায়ুতে ফাইব্রয়েড নিয়ে বিস্তারিত।

জরায়ুর ফাইব্রয়েডের উপসর্গ:
অনেক সময় দেখা যায় জরায়ুতে ফাইব্রয়েড রয়েছে তবুও অনেক মহিলা কোনও উপসর্গ অনুভব করেন না। যাই হোক, অনেক মহিলাদের ক্ষেত্রে, জরায়ু-সংক্রান্ত ফাইব্রয়েডগুলি অস্বস্তিকর বা বেদনাদায়ক উপসর্গ ঘটাতে পারে। যেমন-

  • রজঃস্রাব বা মাসিক এর মধ্যবর্তী সময়ে রক্তপাত (মেট্রোরেজিয়া বা জরায়ু থেকে অস্বাভাবিক, দীর্ঘস্থায়ী এবং অনিয়মিতভাবে হওয়া অত্যধিক রক্তপাত, স্পটিং বা মহিলাদের নিয়মিত মাসিকের সময়ের বাইরে অপ্রত্যাশিত রক্তপাত অথবা স্বাভাবিক মাসিকের সময় ছাড়া মধ্যবর্তী সময়ে রক্তপাত হিসাবে পরিচিত)।
  • অত্যধিক রক্তপাত অথবা বেদনাদায়ক রজঃস্রাব।
  • অ্যানিমিয়া অর্থাৎ, রজঃস্রাব বা মাসিকের সময় অত্যধিক রক্তপাতের কারণে হিমোগ্লোবিন বা লোহিত (লাল) রক্তকোষগুলি হ্রাস (কম হওয়া)।
  • মূত্রথলির উপরে ফাইব্রয়েডের দ্বারা ঘটা চাপের কারণে প্রস্রাবের অত্যধিক পুনরাবৃত্তি।
  • ঢিমে ব্যথা হওয়া ধরণের পিঠের নীচের অংশে ব্যথা।
  • অসুবিধাজনক মল বা পায়খানার নড়াচড়া অথবা কোষ্ঠকাঠিন্য।
  • পেটে (তলপেট) “ভরাভাব”-এর একটা অনুভূতি। কোনও কোনও সময় এটাকে “পেলভিক প্রেসার”ও বলা হয়।
  • যৌনমিলন কালীন ব্যথা।
  • জননতন্ত্রে সমস্যা যেমন বহুবার গর্ভস্রাব, গর্ভাবস্থায় সময়ের আগেই প্রসব বেদনা, এবং বন্ধ্যাত্ব।
  • সন্তানের জন্মদান এবং গর্ভাবস্থা সম্পর্কিত সমস্যাগুলি, যেমন প্রসবের সময় সিজারিয়ান সেকশন-এর (অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে মায়ের পেট কেটে বাচ্চা প্রসব করানো) প্রয়োজনের সম্ভাবনা বেড়ে যাওয়া।


জরায়ুর ফাইব্রয়েডের কারণ:
জরায়ুর ফাইব্রয়েডের সুনির্দিষ্ট কারণ সম্পর্কে এখনও কিছু জানা যায়নি। তবে কয়েকটি ‘রিস্ক ফ্যাক্টর’ থাকলে অসুখের ঝুঁকি বেশি। বাড়িতে মা, মাসি, দিদি-সহ অন্যদের এই সমস্যা থাকলে রোগের ঝুঁকি তুলনামূলক ভাবে বেশি। ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোন মাসিক ঋতুচক্রের সময় জরায়ুর লাইনিং অর্থাৎ আবরণকে উদ্দীপিত করে। এর ফলে ফাইব্রয়েড তৈরি হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে, এছাড়া ছোট ফাইব্রয়েড বেড়ে উঠতে সাহায্য করে এই সব স্ত্রী হরমোন। এই কারণেই সন্তান ধারণের বয়সে ফাইব্রয়েডের ঝুঁকি বাড়ে। মেনোপজের সময় থেকে এগুলি শুকিয়ে ছোট হয়ে যায়।

পার্থক্যমূলক রোগলক্ষণ নির্ণয়:
অন্যান্য স্বাস্থ্য পরিস্থিতিগুলি যা জরায়ুর ফাইব্রয়েডগুলির মত একই প্রকারের উপসর্গগুলি নিয়ে হাজির হতে পারে সেগুলো হলঃ

  • অ্যাডিনোমায়োসিস: জরায়ুর ভিতরের আস্তরণের (এন্ডোমিট্রিয়াম) দ্বারা জরায়ুর পেশীবহুল স্তরের মধ্যে (মায়োমিট্রিয়াম) এক অস্বাভাবিক অনুপ্রবেশ।
  • প্রেগন্যান্সি (গর্ভাবস্থা)
  • এক্টপিক প্রেগন্যান্সি: জরায়ুর গহ্বরের বাইরে যে গর্ভাবস্থা ঘটে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ফ্যালোপিয়ান টিউবগুলিতে।
  • এন্ডোমিট্রিয়াল পলিপঃ জরায়ুর ভিতরের আস্তরণ থেকে একটা ছোট বৃদ্ধি প্রসারিত হয়ে বেরিয়ে আসা।
  • এন্ডোমিট্রিয়াল হাইপারপ্লেজিয়া: জরায়ুর ভিতরের আস্তরণের (এন্ডোমিট্রিয়াম) একটা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি।
  • এন্ডোমিট্রিয়োসিস: জরায়ুর বাইরে অবস্থিত স্থানগুলিতে জরায়ুর ভিতরের আস্তরণের টিস্যুগুলি বৃদ্ধি পায়।
  • এন্ডোমিট্রিয়াল ক্যান্সার: জরায়ুর ভিতরের আস্তরণ থেকে উদ্ভূত ক্যান্সার।
  • ওভারিয়ান ক্যান্সার: এক ধরণের ক্যান্সার যা ওভারি বা ডিম্বাশয়ে সৃষ্টি হয়।
  • ইউটেরাইন সারকোমা: জরায়ুর পেশীগুলি কিংবা টিস্যুগুলি যা জরায়ুকে অবলম্বন দেয় তার ক্যান্সার।
  • ইউটেরাইন কারসিনোসারকোমা: জরায়ুসংক্রান্ত একটা বিরল ধরণের ক্যান্সার।


জরায়ুর ফাইব্রয়েড নির্ণয়ে করণীয়:
জরায়ুতে ফাইব্রয়েড রোগটি পুরোপুরি বংশগত না হলেও একই পরিবারে লক্ষ্য করা যায়। ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরনের মাত্রা কম, বেশি হলে ইউটেরাসের ফাইব্রয়েডের সম্ভবনা বাড়ে। অধিক ওজনও এই রোগের একটি কারণ। সেক্ষেত্রে সন্দেহ হলে একজন স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। পেলভিক এক্সাম, আল্ট্রাসনোগ্রাফি, সিটি স্ক্যান ও এমআরআই ইত্যাদির মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করা হয়ে থাকে।

জরায়ুর ফাইব্রয়েডের চিকিৎসা:
ইউটেরাসের ফাইব্রয়েডের নানা রকমের চিকিৎসা আছে। রোগের ধরন ও উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। অনেকের চিকিৎসা প্রয়োজনই হয় না। কারণ যদি কোন কষ্টকর উপসর্গ না থাকে, মেনোপজের পরে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোনের পরিমাণ কমে যায় এবং ফাইব্রয়েডগুলোও ছোট হয়ে যায়, উপসর্গ এমনিতেই চলে যায়। অনেক ক্ষেত্রে অল্প মাত্রার কন্ট্রাসেপটিভ পিল বা অন্য ওষুধ দিয়েও চিকিৎসা করানো হয়।

কিছু ক্ষেত্রে ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারির মাধ্যমে সমস্যা দূর করা যায়। তবে অধিক গুরুতর সমস্যা যাদের, তাদের হিস্ট্রেক্টমি বা ইউটেরাস কেটে বাদ দিতে হয়। অবশ্য ইদানিং পেট না কেটেই ট্রান্সভ্যাজাইনাল বা ল্যাপারোস্কোপিক হিস্ট্রেক্টমি করা হয়।

জরায়ুতে ফাইব্রয়েডের কারণে ইনফার্টিলিটি হলে প্রথমে ল্যাপারোস্কোপিক বা হিস্টেরোস্কোপিক পদ্ধতিতে ফাইব্রয়েডকে কেটে বাদ দিতে হবে। এরপর ইনফার্টালিটির চিকিৎসা শুরু করতে হবে। হতাশ হওয়ার কিছু নেই। পরিশেষে, ইউটেরাসের ফাইব্রয়েড একটি সহজ নিরাময় যোগ্য রোগ। ভয় না পেয়ে সঠিক সময়ে সুচিকিৎসকের পরামর্শ নিন। ভালো থাকুন, নিরাপদে থাকুন।

জরায়ু ফাইব্রয়েড প্রতিরোধে:
সমীক্ষায় জানা গিয়েছে যে অল্প বয়সে মেনার্কি হলে, ওজন বেড়ে গেলে, ভিটামিন ডি ঘটিত অভাব হলে, রেড মিট খেলে ও মদ্যপান করলে জরায়ুর ফাইব্রয়েডের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই এই সমস্যা প্রতিরোধ করতে অল্প বয়স থেকেই নিয়মিত শরীরচর্চা ও সঠিক ডায়েট করে ওজন ঠিক রাখুন। ঋতু সংক্রান্ত যে কোনও সমস্যা হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।


শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে