বেলস পালসি (ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালাইসিস) কি?
বেলস পালসি এক ধরনের প্যারালাইসিস বা পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগ। এটি এমন একটি অবস্থা, যার ফলে মুখের পেশিগুলো দুর্বল হয়ে যায় বা এক পাশে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়। যখন মুখের পেশির সঙ্গে যুক্ত নার্ভ বা স্নায়ুগুলো নষ্ট হয়ে যায়, তখনই এমনটি ঘটে। তবে, এই পেশীগুলি সাময়িকভাবে আক্রান্ত হয় এবং চিকিৎসার ফলে এই অবস্থা সাধারণত পুরোপুরি নির্মূল হয়ে যায় বা সেরে যায়। স্কটল্যান্ডের একজন সার্জন স্যার চার্লস বেল এই রোগ প্রথম আবিষ্কার করেন। তাঁর প্রতি শ্রোদ্ধা রেখে, এ রোগের নাম দেওয়া হয় বেলস পালসি (Bell’s Palsy)।

বেলস পালসির প্রধান লক্ষণ এবং উপসর্গগুলি কি?

  • বেলস পালসির কারণে সাধারণত মুখের এক পাশের পেশী আক্রান্ত হয়। এবং খুবই কম (প্রায় ১%) ক্ষেত্রে মুখের দু’পাশের পেশী আক্রান্ত হয়।
  • মুখের ওই পাশে ব্যথা হতে পারে, বিশেষ করে চোয়াল এবং মাথাতে।
  • পেশী দুর্বল হয়ে যাওয়ার কারণে চোখের পাতা ঢুলে পড়ে বা বন্ধ হয়ে আসে এবং মুখের এক কোণ থেকে লালা ঝরতে থাকে।
  • জিভের সামনের অংশের স্বাদের অনুভূতির উপর প্রভাব পড়তে পারে।
  • মুখের মাংসপেশি সামান্য ঝুলে যাওয়া।
  • খাওয়া দাওয়া করতে সমস্যা।
  • মুখের ভাব প্রকাশে অক্ষমতা, যেমন হাসি বা ভ্রূকুচি।
  • মুখের দুর্বলতা, মুখের অনাক্রান্ত দিকে পেশী সংকুচিত হয়ে যাওয়া বা বাঁকা হয়ে যাওয়া।
  • শুকনো চোখ এবং মুখ।
  • চোখ বন্ধ করতে না পারা।
  • মাথাব্যথা।
  • শব্দ সংবেদনশীলতা।
  • জড়িত দিকে চোখ জ্বালা।


বেলস পালসির ঝুঁকিতে কারা বেশি আছে?
গর্ভবতী মহিলা, ডায়াবেটিস রুগী, ফুসফুসের সংক্রমণ আছে এমন ব্যক্তি, উচ্চ রক্তচাপ ভুগছেন এমন রুগী, অতিরিক্ত মোটা ব্যক্তি, রোগটি পরিবারের কারো হয়েছিল এমন ব্যক্তিরা এই রোগ হবার ঝুঁকিতে বেশি থাকেন।

বেলস পালসি হওয়ার প্রধান কারণগুলি কি?
বেলস পালসি হওয়ার সঠিক কারণ এখনো পর্যন্ত অজানা রয়েছে; তবে, বলা হয়ে থাকে যে বিভিন্ন রকম ভাইরাল বা বিষাক্ত সংক্রমণের কারণে রোগটি হয়ে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে হার্পিস সিমপ্লেক্স, হার্পিস জোস্টার, এইচআইভি, সাইটোমেগালোভাইরাস এবং এপস্টাইন বার ভাইরাস।

রোগের ঝুঁকির কারণগুলির মধ্যে রয়েছে:

  • ডায়াবেটিস
  • গর্ভাবস্থা
  • মধ্য কর্নে ইনফেকশন
  • ঠান্ডা জনিত কারনে
  • আঘাত জনিত কারন
  • মস্তিস্কের স্ট্রোক জনিত কারন
  • ফেসিয়াল টিউমার
  • কানের অপারেশন পরবর্তী ফেসিয়াল নার্ভ ইনজুরি
  • এই রোগের পারিবারিক ইতিহাস
  • যেকোনো কারণ, যা মুখের স্নায়ুর উপর কোনোরকম ট্রমা বা আঘাত, জ্বালা বা কোনো ক্ষতি সৃষ্টি করে তাই বেলস পালসি ঘটাতে পারে।


বেলস পালসি কিভাবে নির্ণয় করা হয়?

  • এই রোগ নির্ণয়ের জন্য শারীরিক পরীক্ষা, ইমেজিং এবং রক্ত পরীক্ষার প্রয়োজন।
  • উপসর্গগুলির উপর ভিত্তি করে ডাক্তার মুখ পরীক্ষা করবেন, এবং চোখের পাতা ঢুলে যাচ্ছে কি না, লালা ঝরে পড়ছে কি না প্রভৃতি লক্ষণগুলি পরীক্ষা করে দেখবেন।
  • এমআরআই বা সিটি স্ক্যানের মতো ইমেজিং প্রযুক্তি মুখের স্নায়ুগুলির অবস্থা দেখতে সাহায্য করে।
  • যদি চিকিৎসক ভাইরাল সংক্রমণ সন্দেহ করেন, তাহলে তা নিশ্চিত করতে রক্ত পরীক্ষাও করা হয়।
  • স্ট্রোক, লাইম রোগ এবং ব্রেন টিউমারের মতো অবস্থাকে বাদ দেওয়ার উপর এই রোগের নির্ণয় নির্ভর করে।


বেলস পালসির চিকিৎসা:
বেলস পালসির চিকিৎসা অনেকটাই চিহ্নিত করা কারণগুলি বা ঝুঁকির কারণগুলির উপর নির্ভর করে। ঠিক কী কারণে বেলস পালসি হয়েছে, সেটা নির্ণয় করে সঠিক চিকিৎসা দিলে রোগটি ভালো হয়। ভাইরাসের কারণে হলে অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ দেওয়া হয়। মারাত্মক ক্ষেত্রে ট্রমার কারণে স্নায়ু সংকুচিত হয়ে গেলে অপারেশনেরও প্রয়োজন হতে পারে। তবে ওষুধের পাশাপাশি এই রোগের মূল চিকিৎসা হলো নিয়মিত ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে পেশির ব্যায়াম করা। একজন বিশেষজ্ঞ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক রোগীর অবস্থা বুঝে প্রয়োজনীয় ফিজিওথেরাপি দিয়ে থাকেন।

কেউ বেলস পালসিতে আক্রান্ত হলে করণীয়:

  • শীত বা ঠাণ্ডা আবহাওয়া থেকে দূরে থাকতে হবে।
  • আইসক্রিম ও ফ্রিজের ঠাণ্ডা খাবার একদম খাওয়া যাবে না।
  • ঘরের বাইরে গেলে বা রোদে গেলে চোখে সানগ্লাস ব্যবহার করতে হবে। চোখে যাতে ধুলাবালি ঢুকতে না পারে, সে জন্য সতর্ক থাকতে হবে।
  • রাতে ঘুমানোর সময় আক্রান্ত চোখের ওপর রুমাল বা নরম কাপড় দিয়ে রাখতে হবে, যাতে কোনো কিছু চোখের মধ্যে না পড়ে।
  • ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে।


বেলের পালসির সম্ভাব্য জটিলতাগুলি কী কী?
বেশিরভাগ বেলস পালসির রুগী জটিলতা ছাড়াই পুরোপুরি স্বাভাবিক ও সুস্থ হয়ে উঠে। তবে গুরুতর বেলস পালসির ক্ষেত্রে কিছু জটিলতা দেখা দিতে পারে। যেমন:

  • মুখের পেশী নিয়ন্ত্রণকারী সপ্তম ক্রেনিয়াল নার্ভ স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
  • চোখে অতিরিক্ত শুষ্কতা দেখা দিতে পারে যা চোখের সংক্রমণ, আলসার, এমনকি অন্ধত্ব হতে পারে।
  • সিঙ্কাইনেসিস হতে পারে। এটি এমন একটি অবস্থা যাতে দেহের একটি অংশকে নড়াচড়া করালে অন্য অংশ অনিচ্ছাকৃতভাবে সরে যায়। যেমন- কেউ হাসলে তার চোখ বন্ধ হয়ে যায়।

শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে