মূত্রথলির ক্যান্সার কাকে বলে?
পেটের উপরিভাগে পেছনের দুই দিকে দুটি কিডনি বা বৃক্ক থাকে। এখানে রক্ত শোধন করে প্রস্রাব তৈরি হয় এবং রক্তের দূষিত পদার্থ, গ্যাস প্রস্রাবের সঙ্গে মিশে ইউরেটার দিয়ে মূত্রথলিতে গিয়ে জমা হয়। ৩০০ মি.লি. জমা হলে প্রস্রাবের অনুভূতি হতে থাকে। ৪৫০ মি.লি. পর্যন্ত মানুষ প্রস্রাব না করে থাকতে পারে, তবে ব্যাথা অনুভূত হতে থাকে। এই প্রস্রাবের থলিতে বিভিন্ন রোগের মতো ক্যান্সারও হতে পারে। মূত্রথলিতে এই রোগ সংক্রমণ খুবই সহজ। কারণ প্রস্রাবের রাস্তা দিয়ে সহজেই কোনো জীবাণু কিংবা ভাইরাস প্রবেশ করতে পারে।

ব্লাডার বা মূত্রথলির ক্যান্সার সাধারণত ৫০ থেকে ৭০ বছর বয়েসের মানুষদের মধ্যে বেশী দেখা যায়। ব্লাডার ক্যান্সার ব্লাডারের ভিতরের আস্তরণে কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির ফলে হয়ে থাকে। ক্যান্সারের ১৫% ক্ষেত্রে তামাকের সেবনের ফলে ব্লাডার ক্যান্সার দেখা যায়। ব্লাডার বা মূত্রথলি থেকে টিউমার বাদ দেওয়ায় (ট্রান্স ইউর‍েথ্রাল রিজেকশন অফ ব্লাডার টিউমার বা টিইউআরবিটি) বেশিরভাগ ব্লাডার ক্যান্সারের ক্ষেত্রে উন্নতি লক্ষ্য করা যায়। যাইহোক, ৫০%-এর বেশি ক্ষেত্রে ক্যান্সার পুনরায় ফিরে আসে, যার মধ্যে ২০% ক্ষেত্রে, ক্যান্সার ব্লাডার সংলগ্ন শরীরকলায় ছড়িয়ে পড়ে (পেশী-আক্রমণকারী ব্লাডার ক্যান্সার)। টিইউআরবিটি, কেমোথেরাপি এবং রেডিয়েশন থেরাপি হল খুব সাধারণভাবে ব্যবহৃত চিকিৎসার বিকল্পগুলি, যা ক্যান্সারের স্তর অনুযায়ী প্রয়োগ করা হয়।

মূত্রথলির ক্যান্সারের প্রধান লক্ষণ ও উপসর্গগুলি কি কি?
এইসব লক্ষণ ও উপসর্গগুলি থাকলে মূত্রথলির ক্যান্সার বা ব্লাডার ক্যান্সার হয়েছে বলে সন্দেহ করা হয়:

  • হেমাচুরিয়া বা মূত্রের সাথে রক্তপাত, সাধারণত এক্ষেত্রে কোন ব্যথা থাকে না। মূত্র মরিচা রঙের বা গাঢ় লাল রঙের হতে পারে
  • বেশি বেশি মূত্রত্যাগ
  • হঠাৎ মূত্রত্যাগের তাড়না অনুভব
  • মূত্রত্যাগের সময় ব্যথা বা জ্বালা অনুভব করা
  • পিঠে ব্যথা, হাড়ে ব্যথা, ওডেমা বা পায়ে ফোলাভাব দেখা যায়, যখন ক্যান্সার মুত্রথলি থেকে বাইরে ছড়িয়ে পড়ে
  • ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ার পর ওজন হ্রাস পায়।


হেমাচুরিয়ার (মূত্রের সাথে রক্তপাত) অন্যান্য কারণগুলি হল:

  • মূত্রনালীর সংক্রমণ
  • মাসিক
  • কিডনিতে পাথর
  • যৌন সংসর্গ
  • রক্ত-পাতলা করার ওষুধ (অ্যান্টি-কোয়াগুল্যান্টস)
  • প্রস্টেট গ্রন্থির বেড়ে যাওয়া


মূত্রথলির ক্যান্সারের প্রধান কারণগুলি কি কি?
ব্লাডার ক্যান্সারের ক্রমবিকাশের কারণগুলি হল:

  • তামাক সেবন
  • অ্যানালিন ডাই এবং বেঞ্জিডাইনের মতো রাসায়নিকের ব্যবহার, যেগুলি ব্যবহার করা হয় রঙ, বস্ত্র, রাবার, প্লাস্টিক প্রভৃতি প্রস্তুতিতে।
  • রেডিওথেরাপির দ্বারা অন্ত্রের ক্যান্সারের চিকিৎসার ফলে
  • কেমোথেরাপি চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধের ফলে
  • অন্যান্য আরো কিছু কারণ যেমন ব্লাডারে সংক্রমণের ফলে (সিস্টোসোমাইটিস), ডায়াবেটিস, দীর্ঘকালস্থায়ী ক্যাথারাইজেসন এবং ৪৫ বছর বয়েসের আগে মেনোপজ।


মূত্রথলির ক্যান্সার নির্ণয় ও চিকিৎসা কিভাবে হয়?
পুঙ্খানুপুঙ্খ শারীরিক অবস্থার ইতিহাস এবং শারীরিক পরীক্ষার পরে, এইসব পর্যবেক্ষণগুলির দ্বারা ব্লাডার ক্যান্সারের রোগ নির্ণয় হয়:

  • ব্লাডারের ভিতরের টিউমারটি দেখার জন্য সিস্টোস্কপি করা হয়।
  • সিস্টোস্কপি করার সময় যে শরীর কলা নেওয়া হয়, তা অনুবীক্ষণ যন্ত্রের নীচে রেখে দেখা হয় কোন স্তরে ও ক্রমে ক্যান্সারটি আছে।
  • কম্পিউটারাইজড টোমোগ্রাফি স্ক্যান এবং ম্যাগ্নেটিক রিজোনেন্স ইমেজিং দ্বারা টিউমারটির সম্পূর্ণ চিত্র পাওয়া যায়।
  • ইন্ট্রাভেনাস ইউরোগ্রাম দ্বারা ব্লাডারের এক্স-রে চিত্র নেওয়া হয়, যেখানে মূত্রনালী দিয়ে রঙ বাহিত করে টিউমারটি সনাক্ত করা হয়।
  • মূত্রের নমুনা অনুবীক্ষণ যন্ত্রের নীচে পরীক্ষা করে তাতে ক্যান্সারের কোষ আছে কিনা দেখা হয়।
  • টিউমার মার্কার টেস্ট (ব্লাডার টিউমার অ্যান্টিজেন) করা হয় দেখার জন্য যে ক্যান্সার কোষ প্রোটিন বা অ্যান্টিজেন নিঃসৃত করছে কিনা।


ব্লাডার ক্যান্সার, যেটি মূত্রথলির সঃম্পূর্ণ ভিতরের আচ্ছাদনে সীমাবদ্ধ থাকে তাকে নন-মাসেল-ইনভেসিভ ব্লাডার ক্যান্সার বলে, কিন্তু যদি ক্যান্সার ব্লাডারের খুব গভীরে ছড়িয়ে পড়ে (পেশীর স্তর, চর্বি এবং সংযোগকারী কলাগুলির দ্বারা) এবং মূত্রথলির আশেপাশের অঙ্গগুলিতে, তখন তাকে পেশী-আক্রমণকর ব্লাডার ক্যান্সার বা মাসেল-ইনভেসিভ ব্লাডার ক্যান্সার বলে। ক্রমবিভাগ দ্বারা ক্যান্সার কতটা ছড়িয়ে পড়েছে, তা জানা যায়। উচ্চ-ক্রমযুক্ত ক্যান্সার নিম্ন-ক্রমযুক্ত ক্যান্সারের চেয়ে বেশি মাত্রায় ছড়ায়।

ব্লাডার ক্যান্সারের চিকিৎসা, তার স্তর ও ক্রম ভেদে স্থির করা হয়। এর মধ্যে আছে:

  • টিইউআরবিটি
  • যদি মূত্রথলিতে ক্যান্সার অগভীর স্তরে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে টিউমারটি বাদ দিতে সার্জারি করা হয়। নিম্ন-ক্রমের নন-মাসেল-ইনভেসিভ ব্লাডার ক্যান্সারে সার্জারিতে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়।
  • কেমোথেরাপি: টিইউআরবিটি-র পরে পুনরায় ক্যান্সার না হবার জন্য কেমোথেরাপির ওষুধ ব্লাডারে সরাসরি সূঁচ প্রয়োগের দ্বারা প্রবেশ করানো হয়। ডাক্তার নিম্ন ও মধ্য ঝুঁকিপূর্ণ ক্যান্সারের ক্ষেত্রে কোন স্তরে ক্যান্সার আছে তার উপর নির্ভর করে কেমোথেরাপি নিতে বলেন।
  • রেডিয়েশন থেরাপি: উচ্চ-ক্রমযুক্ত ব্লাডার ক্যান্সারের ক্ষেত্রে, যেটা ছড়িয়ে পড়েছে তা নিরাময়ের জন্য কেমোথেরাপির সাথে রেডিয়েশন থেরাপিরও প্রয়োজন হয়।
  • ইমিউনোথেরাপি: কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্যান্সারের প্রথম দিকে চিকিৎসা টিইউআরবিটি-র পরে বিসিজি-র পরিবর্তিত রূপের একটি ওষুধ দ্বারা করা হয়।
  • বিসিজি-র চিকিৎসা দ্বারা ক্যান্সারের নিরাময় না হলে মূত্রথলি বা ব্লাডারের একটি অংশ বা পুরোটাই সার্জারির দ্বারা বাদ দেওয়া হয়।


মূত্রথলির ক্যান্সার প্রতিরোধের উপায়সমূহ:

  • ধূমপান পরিহার করতে হবে। আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটির তথ্যমতে, মূত্রথলির ক্যান্সার সংখ্যার প্রায় অর্ধেক এর কারণ এই ধূমপান।
  • রাবার, চামড়া, প্রিন্টিং, টেক্সটাইল বা রঙ এর কারখানায় কাজ করেন এমন‌ শ্রমিকদের মূত্রথলির ক্যান্সার ঝুঁকি বেশি। তাই এসকল শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরি করা অবশ্য কর্তব্য।
  • প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে। যা এই ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায় অনেকাংশে।
  • প্রচুর ফলমূল ও শাকসবজি খেতে হবে। স্বাস্থ্যকর খাবার যেকোন ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক।


আপনি ক্যান্সার সম্পর্কে সচেতন হন, নিজের ক্যান্সার সুচনাতেই শনাক্ত করার চেষ্টা করুন এবং সঠিক জায়গায় চিকিৎসা নিন।


শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে