রক্তপাত কি?
শরীর থেকে রক্তের ক্ষতি বা হ্রাস ঘটলে তাকে রক্তপাত বলা হয়। শরীরের ভিতরে রক্তপাতকে বলা হয় অভ্যন্তরীণ রক্তপাত এবং শরীরের বাইরে রক্তপাতকে বলে বাহ্যিক রক্তপাত। আমাদের রক্ত শরীরের মধ্যে রক্ত ধমনী বা শিরাগুলির মধ্যে প্রবাহিত হয়; এই শিরা বা ধমনিগুলির মধ্যে কোনরকম ছিদ্র বা ফাঁকা জায়গা তৈরি হলে; রক্তপাত ঘটে। রক্তপাত কোন একটি রোগের লক্ষণ বা কোন আঘাতের কারণে হতে পারে। মাসিক রক্তপাত এবং সন্তান প্রসবের পর রক্তপাত হল স্বাভাবিক রক্তপাত।

রক্তপাতের প্রধান লক্ষণ কি?
রক্তপাত কোন রোগ বা চিকিৎসাগত কারণে হলে সেটা চিন্তার বিষয় হয়ে যায়। আমাদের শরীরে রক্ত জমাট বাঁধার একটি সাধারণ পদ্ধতি থাকে এবং যদিও রক্তপাত ঘটে, রক্ত জমাট বাঁধার কোন সমস্যা না থাকলে এটা স্বাভাবিক ক্ষমতার মাধ্যমে জমাট বেঁধে যায়। এবার রক্তপাতের কিছু সাধারণ লক্ষণ দেখে নেওয়া যাক।

  • শরীরের বহিরাগত রন্ধ্রগুলি যেমন মুখ, নাক, কান, মলদ্বার, মূত্রনালির মুখ বা ত্বকের উপরিভাগ দিয়ে রক্তপাত
  • জ্বর
  • হিমোগ্লোবিন কম থাকা
  • শরীরের প্রচন্ড ধাক্কা (যদি রক্তপাত বন্ধ না হয়) ঠান্ডা, ফ্যাকাশে, দুর্বল হৃদস্পন্দন দ্বারা চিহ্নিত করা হয়।


রক্তপাতের প্রধান কারণগুলি কি কি?
শারীরিক আঘাত বা দুর্ঘটনার ফলে মানসিক আঘাত ঘটলেও রক্তপাত হতে পারে। নিচে দেওয়া হল কয়েকটি আঘাতজনিত কারণ:

  • আঘাত, ত্বকের ওপর কালশিটে দাগ বা ক্ষতের ফলে সূক্ষ্ম নলগুলি ফেটে যায়
  • নাকে আঘাত বা অবচয় নাকে রক্তপাতের কারণ
  • মাথায় আঘাত লাগার ফলে ইন্ট্রাক্রেনিয়াল রক্তপাত হয়ে থাকে
  • বন্দুকের গুলির আঘাত


যখন কোন চিকিৎসাগত অবস্থার ফলে রক্তপাত ঘটে, তখন কারণগুলিকে চিকিৎসাগত কারণ বলে ধরে নেওয়া হয়। এর মধ্যে কয়েকটি কারণ হল:

  • তীব্র ব্রংকাইটিস
  • লিভার বা যকৃতের অকার্যকারিতা
  • প্লেটিলেটের কম গণনা বা কাউন্ট
  • ভিটামিন কে-র অভাব
  • ব্লাড ক্যান্সার বা অন্য কোন পরিণত ক্যান্সার
  • ভারি মাসিকের রক্তপাত
  • গর্ভপাত বা অ্যাবরশন
  • হেমোফিলিয়া- একটি জিনগত রোগ যেটা জয়েন্টগুলির মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত রক্তপাত ঘটাতে থাকে
  • কিছু রক্ত-পাতলা করার ওষুধও রক্তপাত ঘটায়।


রক্তপাত নিরাময়ে প্রাথমিক চিকিৎসা:
রক্তক্ষরণ নিরাময়ে প্রাথমিকভাবে আমারা কিছু পদক্ষেপ নিতে পারি, তা নিন্মে আলোচনা করা হল:

  • রোগীকে বসানো ও শোয়ানো যায় এমন স্থানে স্থানান্তর করতে হবে। এতে রক্তপাত আপনা-আপনি কমে যাবে।
  • যে স্থান হতে রক্তপাত হচ্ছে, সে স্থান হৃৎপিণ্ডের সমতার উপর তুলে ধরলে রক্তপাত অনেকটা কমে যাবে।
  • সামান্য কেটে গেলে ঐ স্থানে রক্ত জমাটবেঁধে আপনা-আপনি রক্তপাত বন্ধ হয়।
  • কাটা স্থানে বৃদ্ধাঙ্গুলির চাপ প্রয়োগ করলে অনেক সময় রক্তপাত বন্ধ হয়।
  • আহত অঙ্গের নড়াচড়া বন্ধ করতে হবে।
  • রক্তপাতের স্থানে বরফ ব্যবহার করতে হবে।
  • রক্তপাত বন্ধের জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চাপ দিতে হবে।
  • ক্ষতস্থান পরিষ্কার কাপড় বা ব্যাণ্ডেজ দিয়ে বাঁধতে হবে।
  • তাড়াতাড়ি ডাক্তারের কাছে বাহাসপাতালে নিতে হবে।
  • বেশি রক্তপাত হলে টুর্নিকেট ব্যবহার করতে হবে। টুর্নিকেট অর্থ হলো প্রাথমিক বাঁধনকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শক্ত করে তোলা। ক্ষতস্থান ঢিলা করে বেঁধে তার ভিতরে একটি কাঠি বা পেন্সিল ঢুকিয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে ঘুরালে বাঁধনটি ক্রমশ শক্ত হয়ে রক্তপাত বন্ধ হয়।


কিভাবে রক্তপাত নির্ণয় এবং চিকিৎসা করা হয়?

আঘাত বা আঘাতমূলক ক্ষেত্রে, আঘাতজনিত অঙ্গের বিভিন্ন স্ক্যান সাহায্য করতে পারে। অনেকসময় রক্ত পরীক্ষা না করলে অভ্যন্তরীণ রক্তপাত ধরা পরে না। কিছু সাধারণ নির্ণায়ক সরঞ্জাম এবং পদ্ধতির তালিকা নিচে দেওয়া হল:

  • হিমোগ্লোবিন বা হেমাটোক্রিটের মান দেখায় যে রক্ত পরীক্ষা
  • প্লেটলেটের গণনা
  • মল পরীক্ষা
  • এক্স-রে
  • সিটি স্ক্যান
  • আল্ট্রাসাউন্ড


চিকিৎসায় প্রাথমিকভাবে রক্তপাত আটকানো এবং একবার অন্তর্নিহিত কারণ নির্ণয় করা হলে, সেই অনুযায়ী চিকিৎসার পদ্ধতির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। রক্তপাত নিম্নলিখিত উপায়ে পরিচালিত করা যেতে পারে:

  • মাসিকে অধিক রক্তপাতের জন্য হরমোনগত চিকিৎসা।
  • আঘাত লাগলে রক্তপাত বন্ধ করার জন্য টরনিকেটের প্রয়োগ।
  • আঘাতজনিত রক্তপাত বন্ধ করতে সার্জারি।
  • রক্তপাতের ফলে ঘটা হাইপো টেনশন নিয়ন্ত্রণ করতে টিস্যু বা কোষগুলির মধ্যে অক্সিজেন এবং ইন্টারভেনাস তরলের প্রয়োগ।
  • অস্ত্রোপচারের ড্রেসিং: রক্তপাত বন্ধ করতে কোলাজেন-ভিত্তিক, ফাইব্রিন-ভিত্তিক এবং জেলাটিন-ভিত্তিক ড্রেসিং যার মধ্যে হেমোস্ট্যাটিক এজেন্ট রয়েছে।
  • ভ্যাসোকনস্ট্রিকটর: রক্ত ধমনীগুলি সঙ্কোচনের দ্বারা রক্তপাত বন্ধ করা এজেন্টের ব্যবহার, যেমন ব্লাডার বা মুত্রাশয়ের মধ্যে রক্তপাত ক্যান্সারের সঙ্গে যুক্ত থাকে। এখানে, রক্তপাতের জায়গায় এন্ডোস্কোপিও প্রদান করা যেতে পারে।
  • রেডিওথেরাপি: ফুসফুসে ক্যান্সার, ব্লাডার বা মুত্রাশয়ে এবং গ্যাস্ট্রোইন্নটেস্টাইনাল রক্তপাতগুলির ক্ষেত্রে।
  • রক্ত জমাটের সমস্যার ক্ষেত্রে ভিটামিন কে-র থেরাপি বা চিকিৎসা এবং ফাইব্রিনোজেন।
  • রক্ত জমাটকে বাড়াতে অ্যান্টিফাইব্রিনোলাইটিক।
  • প্লেটলেট সংমিশ্রন, জমানো প্লাজমা বা রক্তের পরিব্যাপ্তি বা ট্রান্সফিউশন।


অত্যধিক রক্তপাত, অভ্যন্তরীণ বা বহিরাগত, উভয়ক্ষেত্রেই মারাত্মক হতে পারে। অত্যধিক রক্তপাতের ক্ষেত্রে, ক্ষতির ভরপাইয়ের জন্য রক্তের টান্সফিউশন বা পরিব্যাপ্তি করা যেতে পারে।

একটি সাবধান বানী---যে কোন ধরনের রক্তের ক্ষতির ক্ষেত্রে অবিলম্বে মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। তাই, আপনার ডাক্তারের পরামর্শ নিন। সময়মত নির্ণয় এবং চিকিৎসা আপনার জীবন বাঁচাতে পারে।


শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে