বটুলিজম কাকে বলে?
বটুলিজম হল বটুলিনাম টক্সিন দ্বারা ঘটিত এক ধরণের বিরল এবং সম্ভাব্য মারাত্মক ব্যাধি, এটি ক্লস্ট্রিডিয়াম বটুলিনাম (Clostridium botulinum) ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংঘটিত। ক্লস্ট্রিডিয়াম বটুলিনাম ব্যাকটেরিয়া হল একটি মাটি বাহিত জীবাণু যা সব কিছুর উপর প্রভাব বিস্তার করে ও একে দমন করা কঠিন। যেহেতু এই জীবাণু অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে সমৃদ্ধি লাভ করে, ক্যানড ফুড হল এই রোগজীবাণুর একটি শক্তিশালী প্রজনন স্থল। যখন বটুলিজমের জীবাণু একজন ব্যক্তিকে আক্রান্ত করে, এটি বটুলিনাম টক্সিন ছাড়ে যা প্যারালাইসিস বা পক্ষাঘাত এর কারণ ঘটায়, যা মুখমণ্ডলের থেকে শুরু হয়, তারপর তা গুরুত্বপূর্ণ ইন্দ্রিয় ও অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। রোগটি দুর্বলতা, ঝাপসা দৃষ্টি, ক্লান্তি এবং কথায় জড়তা দিয়ে শুরু হয়। এরপরে হাত, বুকের পেশী এবং পা দুর্বল হয়ে যেতে পারে। যদি টক্সিন বা বিষ শ্বাসযন্ত্র সংলগ্ন পেশীতে পৌঁছে যায় এটা শ্বাসযন্ত্রকেও বিকল করে দিতে পারে। যেহেতু বটুলিজমের প্রভাবে পক্ষাঘাত হতে পারে, তাই এটি একটি চিকিৎসাগত জরুরি অবস্থা।

বটুলিজমের বিভিন্ন প্রকার নিচে দেওয়া হল:

  • যদি কোনো খাদ্য বটুলিনাম টক্সিন দ্বারা সংক্রামিত হয় তবে খাদ্যবাহিত বটুলিজম দেখা যায়।
  • যখন রোগজীবাণু কোনও উন্মুক্ত ক্ষত-এর সংস্পর্শে আসে এবং ক্ষতে টক্সিন বা বিষ ঢালে ক্ষতবাহিত বটুলিজম দেখা যায়।
  • একজন নাবালক বা শিশু সংক্রামিত খাবারের মাধ্যমে এই রোগজীবাণু খেয়ে ফেললে নাবালক বটুলিজম দেখা যায়। নাবালক বটুলিজমের ক্ষেত্রে, রোগজীবাণু ও তার টক্সিন বা বিষ শিশুর মলের মধ্যেও রয়ে যায়।
  • পরিপাকক্রিয়া সংলগ্ন অংশে যখন রোগজীবাণু ছড়িয়ে পড়ে প্রাপ্তবয়ষ্কদের ইনটেস্টাইনাল কলোনাইজেশন হতে পারে। এই ধরণের বটুলিজম খুব বেশি দেখা যায় না।
  • বটুলিনাম টক্সিনের (বটক্স) বেশি মাত্রায় প্রয়োগের ফলে, থেরাপি নেওয়ার পরবর্তীকালীন সময়ে লেট্রোজেনিক বটুলিজম হতে পারে।


বটুলিজমের প্রধান লক্ষণ ও উপসর্গগুলি কি কি?
সংক্রমণ ঘটার ৬ থেকে ১০ দিনের মধ্যে উপসর্গগুলি দেখা দিতে থাকে। নাবালকদের ক্ষেত্রে ও খাদ্যবাহিত বটুলিজমের ক্ষেত্রে ১২ থেকে ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে সংক্রমণ লক্ষ্য করা যায়।

খাদ্যবাহিত বটুলিজমের উপসর্গগুলি হল:

  • বমি বমি ভাব
  • বমি
  • পেটে খিঁচ ধরা ও পরে কোষ্ঠকাঠিন্য
  • খাবার গিলতে সমস্যা/কথা বলতে সমস্যা
  • মুখে শুকনো ভাব
  • মুখের দু’পাশে দুর্বলতা
  • অস্পষ্ট বা ১টি জিনিসকে ২টি দেখা
  • ঝুঁকে পড়া চোখের পাতা
  • শ্বাসকষ্ট
  • সমস্ত শরীরে বিভিন্ন পেশীবর্গগুলিতে পক্ষাঘাত।


যদিও খাদ্যবাহিত, ক্ষতবাহিত, প্রাপ্তবয়ষ্কদের এবং লেট্রোজেনিক বটুলিজমের উপসর্গগুলি একই রকমের, ক্ষতবাহিত বটুলিজম ৪ দিন থেকে ২ সপ্তাহের মধ্যে প্রকট হতে পারে। ক্ষতবাহিত বটুলিজমের ক্ষেত্রে, যে স্নায়ু মস্তিষ্কের সাথে সুষুম্নাকাণ্ডের যোগাযোগ স্থাপন করেছে সেটিই প্রথম উপসর্গ অনুভব করতে পারে, পরে তা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।

নাবালক বটুলিজমের ক্ষেত্রে, শিশুটির কোষ্ঠকাঠিন্য, খেতে সমস্যা, পরিশ্রান্তি, বিরক্তি, ঝুঁকে পড়া চোখের পাতা, নিস্তেজ কান্না এবং মাথার উপর নিয়ন্ত্রণ না থাকা ও পেশীর দূর্বলতা-র কারণে অলস হাঁটাচলা দেখা যেতে পারে।

বটুলিজমের প্রধান কারণগুলি কি কি?
বটুলিজম বিশেষত হয় বটুলিনাম রোগজীবাণুযুক্ত খাবার খেলে অথবা সংক্রামিত মাটির সংস্পর্শে এলে। বটুলিজম বীজগুটি যা অন্ত্রের ভিতর বৃদ্ধি পায় তা বটুলিনাম টক্সিন নিষ্ক্রমণ করে। এই রোগজীবাণুর প্রধান খাদ্য উৎস হল বাড়ির ক্যানড খাবার বা বাজার থেকে আনা ক্যানড খাবার, যা যথাযথভাবে প্রক্রিয়াজাত করা হয় নি। এই টক্সিন বা বিষ সংরক্ষিত শাকসবজিতে অল্প মাত্রায় অ্যাসিড রূপে থাকে, যেমন, বীট, পালংশাক, মাশরুম এবং সবুজ বীনসে। ক্যানড টুনা মাছ, গাঁজান, ধোঁয়া ব্যবহার করে প্রস্তুত এবং নোনতা মাছ, মাংসজাতীয় দ্রব্য যেমন, হ্যাম এবং স্যসেজ প্রভৃতিতে এই বিষ থাকে।

ক্ষতবাহিত বটুলিজমের ঘটনা ঘটে যখন জীবাণু উন্মুক্ত ক্ষতস্থানে প্রবেশ করে। ক্ষতবাহিত বটুলিজমের সাধারণ একটি কারণ হল শরীরে সুঁচ প্রয়োগ করে মাদকের ব্যবহার। এক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়ার জীবাণু ক্ষতস্থানে প্রবেশ করে এবং অক্সিজেনের অভাবে টক্সিন ছেড়ে দেয়। এটি সরাসরি একজন থেকে আরেকজনের কাছে ছড়ায় না। সন্দেহজনক ব্যক্তির শরীরে টক্সিন বা ব্যাকটিরিয়া খুঁজে বের করে রোগ নির্ণয়ের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।

কিভাবে এর রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা হয়?
রোগ নির্ণয় করার জন্য, ডাক্তার আপনাকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন, গত কয়েকদিনে আপনি কি কি খেয়েছেন এবং আপনি কি এমন কোনো জিনিসের সংস্পর্শে এসেছিলেন যাতে আপনার শরীরের কোনও উন্মুক্ত ক্ষতস্থান দিয়ে এই রোগজীবাণু শরীরে প্রবেশ করতে পারে। ডাক্তার নিস্তেজ স্বর, পেশীর দূর্বলতা, ঝুঁকে পড়া চোখের পাতা অথবা পক্ষাঘাত হয়েছে কি না, তা পরীক্ষা করতে পারেন। নাবালকদের ক্ষেত্রে, ডাক্তার জানতে চাইতে পারেন যে শিশুটি মধু জাতীয় কিছু খেয়েছে কি না অথবা কোষ্ঠকাঠিন্য এবং আলস্যভাব আছে কিনা।

এরপর ডাক্তার পরীক্ষাগারে রক্ত, মল, বমি প্রভৃতি পরীক্ষা করতে বলতে পারেন এই বিষ আছে কি না তা জানতে। এই পরীক্ষার ফলাফলগুলি জানতে বেশ কয়েকদিন লাগতে পারে, তাই, যদি আপনার ডাক্তার সন্দেহ করেন যে আপনার বটুলিজম হয়েছে, তাহলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা শুরু করতে পারেন, ডাক্তার বিশেষ কিছু পরীক্ষা করতে বলতে পারেন, যেমন:

  • ব্রেন স্ক্যান
  • সুষুম্নাকাণ্ডের রসের পরীক্ষা
  • স্নায়ু এবং পেশীর কার্যকলাপের পরীক্ষা


বটুলিজম এর চিকিৎসাঃ
বটুলিজম রোগীদের যত দ্রুত সম্ভব একজন নিউরোলজিস্ট চিকিৎসকের অধীনে চিকিৎসা দেওয়া শুরু করে দিতে হবে। তবে চিকিৎসার লক্ষ্যমাত্রা হিসাবে (১) শ্বাস প্রশ্বাসে সাহায্য করা (২) এন্টিটক্সিন ব্যবহার করে প্যারালাইসিসের অগ্রগতি কমানো (৩) অন্যান্য সমস্যার প্রতিরোধ করা।

দূর্বলতা এবং শ্বাস প্রশ্বাসের সমস্যা একজন রোগীকে কয়েক ঘন্টার মধ্যে এতটা শংকটাপন্ন করে ফেলে যে, রোগীকে ICU তে রাখতে হয় এবং শ্বাস প্রশ্বাসে জন্য ভেন্টিলেটরের সাহায্যও নিতে হতে পারে। ICU তে এইসব রোগীদেরকে একদল চিকিৎসকের সমন্বয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকে।

বটুলিজম ডায়াগনোসিস হওয়ার সাথে সাথে অ্যান্টিটক্সিন দেওয়া শুরু করে দিতে হবে। অ্যান্টিটক্সিন বটুলিজম টক্সিনকে প্রতিরোধ করে, যাতে পরবর্তীকালে স্নায়ুর আর ক্ষতি না করতে পারে। যাইহোক, যে ক্ষতি আগে হয়ে গেছে অ্যান্টিটক্সিন তা সারাতে পারে না। অনেক সময়, খাদ্যবাহিত বটুলিজমের ক্ষেত্রে, ডাক্তার বমি হওয়ার জন্য বা পেট পরিষ্কার হওয়ার জন্য ওষুধ দিতে পারেন। উন্ড বটুলিজম না হলে এন্টিবায়োটিকের প্রয়োজন নেই।বাচ্চাদের ক্ষেত্রে Human Botulinum Immune Globulin-IV(BIG) ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়ে থাকে।

শ্বাস কষ্টের সমস্যা, প্যারালাইসিস, মাংশপেশির দূর্বলতা সহ অন্যান্য সমস্যার জন্য একজন গ্র্যাজুয়েট ফিজিওথেরাপিস্ট রোগীকে চিকিৎসা দিবেন।এছাড়াও এসব জটিলতার জন্য নার্সিং কেয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

বটুলিজম প্রতিরোধের উপায়:
মূলত সঠিকভাবে খাদ্য প্রস্তুত করার মাধ্যমেই প্রতিরোধ করা সম্ভব। খাবারকে ৫ মিনিটের বেশি সময় ধরে ৮৫° সেলসিয়াস (১৮৫° ফারেনহাইট) এর বেশি তাপমাত্রায় গরম করলে টক্সিন ধ্বংস হয়ে যায়। মধু এই জীবাণু ধারণ করতে পারে এবং একারণে ১২ মাসের কম বয়সী বাচ্চাদের মধু খাওয়ানো উচিত নয়।


শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে