সারভাইকাল ক্যান্সার (জরায়ুমুখের ক্যান্সার) কি?
সারভাইকাল ক্যান্সার হল জরায়ু অথবা গর্ভাশয়ের সর্বনিম্ন অংশ, সার্ভিক্সের মধ্যের অঙ্গ কোষগুলির অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। সারভাইকাল ক্যান্সার বিশ্বব্যাপী মহিলাদের চতুর্থ সবচেয়ে বেশী হওয়া ক্যান্সার। প্রতি দু’মিনিটে পৃথিবীতে একজন মহিলা সারভাইকাল (জরায়ু মুখের) ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন বা মারা যাচ্ছেন। যথাসময়ে চিকিৎসা করা গেলে বা আগাম সাবধানতা বজায় রাখলে জরায়ু মুখের ক্যান্সারের শিকার হতে হবে না মহিলাদের। ডাক্তাররা জানাচ্ছেন, সারভাইক্যাল ক্যানসার ১০০ শতাংশ প্রতিরোধযোগ্য।

হিউম্যান পেপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি)-এর হানাতেও এই অসুখ দানা বাঁধে শরীরে। তবে এই ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করা ছাড়াও সারভাইকাল ক্যানসারের আর একটি প্রধান কারণ অসুরক্ষিত যৌন সম্পর্ক। ২০ বছরের কম বয়সিদের এই রোগ সাধারণত হয় না। সাধারণত ৩৮ থেকে ৪২ বছর বয়সিরাই এই রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। বয়স ৬০ পেরলেও এটি হতে পারে, তবে সংখ্যা তুলনামূলক কম।

এইচপিভি হানা দিলে এর কোনও বাহ্যিক চিহ্ন থাকে না। সাধারণত, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দেড় থেকে দু’বছরের মধ্যেই এই ভাইরাস থেকে শরীরকে মুক্ত করে। কিন্তু কোনও ভাবে তা না করতে পারলে ক্যানসারের শিকার হতে হয়।

সারভাইকাল ক্যান্সার (জরায়ুমুখের ক্যান্সার) এর প্রধান লক্ষণ এবং উপসর্গগুলি কি কি?
এই ক্যানসারের জন্য নির্দিষ্ট কোনও অঞ্চল সীমাবদ্ধ নয়। বরং জরায়ুর যে কোনও অংশেই এই ক্যানসারের হানা লক্ষ করা যায়। প্রাথমিক পর্যায়ে সারভাইকাল ক্যান্সারের উপসর্গগুলি কেউ বুঝে উঠতে পারে না। সারভাইকাল ক্যান্সার বাড়তে থাকলে, উপসর্গগুলি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। উপসর্গগুলি হল:

  • মাসিকের সময় অথবা যৌন সঙ্গমের পরে অনিয়মিত বা অস্বাভাবিক যোনি-সংক্রান্ত রক্তপাত
  • মেনোপজের পরেও হঠাৎই রক্তপাত
  • কোমরে ব্যথা, তলপেটে, পায়ে ব্যথা
  • ক্লান্তি
  • ওজন কমা
  • খিদে কমে যাওয়া
  • সাদা বা দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব বা যোনির অস্বস্তি
  • উভয় পায়ের মধ্যে ফোলাভাব।


সারভাইকাল ক্যান্সার (জরায়ুমুখের ক্যান্সার) এর প্রধান কারণগুলি কি কি?
সারভাইকাল ক্যান্সার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) সংক্রমণের কারণে হয় যা যোনি-সংক্রান্ত, মৌখিক বা মলদ্বার-সম্পর্কিত সেক্সের মাধ্যমে এক ব্যক্তির কাছ থেকে অন্য ব্যক্তির কাছে যেতে পারে। ক্যান্সারের সম্ভাবনা বাড়ানোর অন্য কিছু কারণগুলি হল:

  • ধূমপান
  • কম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা
  • ৫ বছরের বেশি সময় ধরে জন্ম নিয়ন্ত্রক ওষুধের ব্যবহার
  • ৩ জনের বেশি বাচ্চার জন্ম দিলে


সারভাইকাল ক্যান্সার (জরায়ুমুখের ক্যান্সার) নির্ণয়:
এক্ষেত্রে গোড়ার দিকে লক্ষণ অথবা উপসর্গগুলি থাকে না; নিয়মিত চেক-আপ সার্ভিকাল ক্যান্সার সনাক্ত করতে সাহায্য করতে পারে। ৩০ থেকে ৪৯ বছর বয়সী প্রত্যেক মহিলার জন্য অন্তত একবার স্ক্রীনিংয়ের পরামর্শ দেওয়া হয়। রোগনির্ণয়সংক্রান্ত পদ্ধতিগুলি হলো:

  • শারীরিক পরীক্ষা এবং চিকিৎসার ইতিহাস: রোগীর সাধারণ ইতিহাস এবং পরীক্ষা করা হয়।
  • শ্রোণী পরীক্ষা: সংক্রমণ বা রোগের লক্ষণের জন্য যোনি এবং জরায়ুর পরীক্ষা করা।
  • পেপ পরীক্ষা: কোনও রোগ, সংক্রমণ বা ক্যান্সারের সম্ভাবনা সনাক্ত করতে সার্ভিক্স থেকে কোষ সংগ্রহ করা।
  • এইচপিভি পরীক্ষা: এইচপিভি টেস্টিং, কোষের আণুবীক্ষণিক পরীক্ষা এবং অ্যাসিটিক অ্যাসিডের মাধ্যমে চাক্ষুষ পরিদর্শন।
  • এন্ডোসার্ভিক্যাল কারিটেজ : এন্ডোসার্ভিক্যাল ক্যানেলের মধ্যে ক্যান্সারের লক্ষণ সনাক্ত করতে।
  • কল্পস্কোপি: যোনি এবং সার্ভিক্সের অস্বাভাবিক এলাকাগুলি পরীক্ষা করতে।
  • বায়োপসি: সার্ভিকাল টিস্যু ক্যান্সারের লক্ষণগুলির সন্ধানে নেওয়া হয়।


সারভাইকাল ক্যান্সার (জরায়ুমুখের ক্যান্সার) এর চিকিৎসা পদ্ধতি:
ক্যান্সারের তীব্রতার উপর নির্ভর করে ডাক্তার মোনোথেরাপির বা ড্রাগের সমন্বয় থেরাপি দিতে পারে।
স্ট্যান্ডার্ড থেরাপিগুলি হলো:

  • সার্জারি:
  1. কোনিসেশন: সার্ভিক্সে একটি শঙ্কু আকৃতির টিস্যু বের করা হয়।
  2. টোটাল হিস্টেরেক্টমি: সার্ভিক্স সহ সমগ্র জড়ায়ু অস্ত্রোপচার করে অপসারণ করা হয়।
  • রেডিয়েশন থেরাপি: ক্যান্সার সংক্রান্ত কোষগুলিকে মেরে ফেলতে করতে হাই-এনার্জি রেডিয়েশন গুলির ব্যবহার হয়।
  • কেমোথেরাপি: ক্যান্সার কোষগুলিকে থামাতে অথবা হত্যা করতে ওষুধের ব্যবহার হয়।
  • টার্গেটেড থেরাপি: ক্যান্সার কোষগুলি সনাক্ত এবং লক্ষ্য করে এমন মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডির ব্যবহার হয়।
  • এইচপিভি টিকা ৯ থেকে ২৬ বছর বয়সের মেয়েদের জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়, কারণ এই টিকাগুলি লাইসেন্সযুক্ত, নিরাপদ এবং কার্যকরী। যেহেতু ক্যান্সার বিকাশের জন্য কয়েক বছর সময় নেয়, এটি প্রতিরোধ করা যেতে পারে।


যেভাবে নিজের যত্ন নিবেন:

  • সার্ভিক্সের সাধারণ পরিবর্তনগুলি পর্যবেক্ষণ করতে একটি আয়না এবং ফ্ল্যাশলাইট ব্যবহার করে নিজেকে পরীক্ষা করা।
  • সার্ভিকাল ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে কনডমের মত ওষুধ মুক্ত গর্ভনিরোধক পদ্ধতি ব্যবহার করা।
  • এইচপিভি সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে একাধিক সঙ্গীর সাথে যৌন সংসর্গ এড়িয়ে চলা।
  • কোনো সহ-সংক্রমণ এড়ানোর জন্য স্বাস্থ্যকর অবস্থা বজায় রাখা।
  • রোগের অবস্থা জানার জন্য নিয়মিতভাবে পরীক্ষা করা উচিত। নির্ণয়ের পরের ২ বছরের জন্য প্রতি ৩ থেকে ৪ মাসে পরীক্ষা করা হয়।


সার্ভিকাল ক্যান্সারকে সামাজিক কলঙ্ক হিসাবে বিবেচনা করা উচিত নয়, এবং ক্যান্সারের স্ক্রীনিং এবং প্রাথমিক সনাক্তকরণের জন্য একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করা দরকার। নিয়মিত চেক-আপের সাহায্যে সার্ভিকাল ক্যান্সার প্রতিরোধ করা যেতে পারে।


শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে