শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে
Call

“পবিত্র আশুরা কি?” ( প্রত্যেক মুসলমানের জানা অত্যন্ত প্রয়োজন) মুল আলোচনার পূর্বে প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ঃ-…………………… ইসলাম শুধুমাত্র একটি ধর্মের নাম নয়, একজন মানুষের জন্য পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যাবস্থার নাম ইসলাম। কোরআন, সুন্নাহ, ইজমা, কিয়াসের মাধ্যমে সেই জীবন ব্যাবস্থা পুঙ্খানুপুঙ্খ দিক নির্দেশনার ঘোষণা দিয়েছেন স্বয়ং মহান আল্লাহ্ পাক। তারই ধারাবাহিকতায় আসমান ও জমিন সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই মহাকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে আল্লাহর বিধানে আল্লাহর কাছে মাস গণনায় মাস ১২টি, তন্মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত, এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান; সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার কোরো না।’ (সূরা আত-তাওবা, আয়াত: ৩৬) আরবি চন্দ্রবর্ষ তথা হিজরি সনের প্রথম মাস হলো মহররম। ‘মহররম’ শব্দের অর্থ অলঙ্ঘনীয় পবিত্র। ইসলামে মহররম মাসটি অত্যন্ত মর্যাদাবান ও ফজিলতময়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা যে চারটি মাস সম্মানিত বলে ঘোষণা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর মুখ নিঃসৃত অমিয় বাণীর মাধ্যমে তা সুস্পষ্ট ও নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। বিদায় হজের ভাষণে সম্মানিত মাসগুলোকে চিহ্নিত করে তিনি বলেছেন, ‘তিনটি মাস হলো ধারাবাহিক জিলকদ, জিলহজ ও মহররম, অপরটি হলো রজব।’ (বুখারি) এ মাসগুলোকে ‘আশ-শাহরুল হারাম’ বা অলঙ্ঘনীয় পবিত্র মাস বলা হতো। এ চারটি মাসে যেকোনো ইবাদতের সওয়াব বৃদ্ধি পায়। তেমনি এ সময়ে পাপাচার করলে এর ভয়াবহ পরিণাম ও কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হয়। পূর্ববর্তী শরিয়তসমূহে এ মাসগুলোতে সব ধরনের যুদ্ধবিগ্রহ, ঝগড়া-ফ্যাসাদ, মারামারি, খুনোখুনি প্রভৃতি নিষিদ্ধ ছিল। যদিও হিজরি সালের ক্যালেন্ডার রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সময় থেকে প্রচলিত না হলেও দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.)-এর শাসনামলে ১৭ হিজরি বা রাসুলের ওফাতের সাত বছর পর থেকে প্রচলন করা হয়। যদিও মহানবী (সা.) ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের রবিউল আউয়াল মাসে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন, কিন্তু এর প্রস্তুতি এবং আকাবার শেষ বায়আতের পর নবী করিম (সা.) হিজরতের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর প্রথম যে চাঁদটি উদিত হয়েছিল, তা ছিল মহররম মাসের। অন্যান্য সাহাবায়ে কিরামের হিজরত মহররম থেকে শুরু হয়েছিল, তাই হিজরি সালের প্রথম মাস মহররম থেকে ধরা হলো। মুল প্রসঙ্গ ঃ- ………… মহররম মাসের ১০ তারিখকে আশুরা বলা হয়। আরবি ‘আশারা’ অর্থ দশ। সেই সুবাদে ওই তারিখ আশুরা বলে উল্লেখিত হয়ে আসছে। আর আমাদের প্রাণ প্রিয় নবী হুজুরে পাক হজরত মোহাম্মদ (সাঃ) তার জীবদ্দশায় এই আশুরার দিনটি অত্যন্ত গুরুত্বের সহিত ইবাদত বন্দেগির মাধ্যমে পালন করে গেছেন। যার কিছু প্রমাণ নিম্নরূপ, ১। ইসলাম-পূর্বকালে বিভিন্ন জাতি নানা কারণে আশুরার দিন রোজা রাখত। রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় হিজরত করে দেখতে পেলেন যে ইহুদিরা মহররমের ১০ তারিখ আশুরা দিবসে রোজা রাখছে। নবী করিম (সা.) তাদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা কোন দিন, যাতে তোমরা রোজা রেখেছ?’ তারা বলল, ‘এটা এমন এক মহান দিবস, যেদিন আল্লাহ তাআলা হজরত মুসা (আ.) ও তাঁর সম্প্রদায়কে নাজাত দিয়েছিলেন, ফিরআউনকে তার সম্প্রদায়সহ ডুবিয়ে মেরেছিলেন। তাই হজরত মুসা (আ.) শুকরিয়া হিসেবে এদিন রোজা রেখেছেন, এ জন্য আমরাও রোজা রাখি।’ এ কথা শুনে রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘তোমাদের চেয়ে আমরা হজরত মুসা (আ.)-এর অধিকতর ঘনিষ্ঠ ও নিকটবর্তী।’ অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সা.) রোজা রাখলেন এবং অন্যদের রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন।’ (বুখারি ও মুসলিম) ২। আশুরার দিন নফল রোজা রাখার ফজিলত সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে প্রশ্ন করা হলে তিনি ঘোষণা করলেন, ‘এ রোজা বিগত এক বছরের গুনাহের কাফ্ফারা হয়ে থাকে।’ (মুসলিম ও তিরমিজি) ৩। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রমযান ও আশুরায় যেরূপ গুরুত্বের সঙ্গে রোযা রাখতে দেখেছি অন্য সময় তা দেখিনি।’ -সহীহ বুখারী ১/২১৮ ৪। হযরত আলী (রা:) কে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেছিল, রমযানের পর আর কোন মাস আছে, যাতে আপনি আমাকে রোযা রাখার আদেশ করেন? তিনি বললেন, এই প্রশ্ন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট জনৈক সাহাবি করেছিলেন, তখন আমি তাঁর খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘রমযানের পর যদি তুমি রোযা রাখতে চাও, তবে মহররম মাসে রাখ। কারণ, এটি আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন আছে, যে দিনে আল্লাহ তাআলা একটি জাতির তওবা কবুল করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অন্যান্য জাতির তওবা কবুল করবেন।’- জামে তিরমিযী ১/১৫৭ ৫। মদিনায় আগমনের পর রমজান মাসের রোজা ফরজ হওয়ার পর তিনি ঘোষণা করলেন, ‘আমি আশুরার দিন রোজা রাখতে আদিষ্ট ছিলাম, অতএব এখন তোমাদের কারও যদি ওই দিন রোজা রাখতে ইচ্ছা হয়, তবে তা রাখতে পারো।’ আশুরার দিন রোজা রাখলে ইহুদিদের সঙ্গে সাদৃশ্য হয়ে যায় বিধায় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আগের দিন বা পরের দিন আরেকটি রোজা রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। ৬। অন্য হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমি আশাবাদী যে, আশুরার রোযার কারণে আল্লাহ তাআলা অতীতের এক বছরের (সগীরা) গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন।’- সহীহ মুসলিম ১/৩৬৭; জামে তিরমিযী ১/১৫৮ আশুরার রোযা সম্পর্কে এক হাদীসে আছে যে, ‘তোমরা আশুরার রোযা রাখ এবং ইহুদীদের সাদৃশ্য পরিত্যাগ করে; আশুরার আগে বা পরে আরো একদিন রোযা রাখ।’- মুসনাদে আহমদ ১/২৪১ ৭। নামাজ: হযরত আলী (রা:) হতে বর্ণিত: রাসুলে পাক (সা:) বলেন যে ব্যাক্তি মহররমের দশম রাত্র জেগে এবাদত করবে, আল্লাহ তাকে উত্তম জীবন দান করবেন। ……………………………………………………………………………………………।। আলহামদুলিল্লাহ উপরের আলোচনায় আমরা জানতে পারলাম যে, আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ নবী রাসুলে পাক (সাঃ) জীবদ্দশায় আশুরার দিনটি বিশেষ গুরুত্ব এবং তাৎপর্য সহকারে পালন করে গিয়েছেন শুধু মাত্র মহান আল্লাহ্র সন্তুষ্টি পাওয়ার উদ্দ্যেস্যে। এই দিনটির (বুজুর্গ দের ভাষ্যমতে এবং ভিন্নমতে) ঐতিহাসিক তাৎপর্য ঃ——— * আল্লাহপাক এ তারিখে আসমান, জমিন, লওহে কলম সৃষ্টি করেছেন এবং এই ১০ মহররম মহাপ্রলয় বা কিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে। * আল্লাহতায়ালা আদি পিতা হযরত আদম (আঃ)-কে ১০ মহররম দুনিয়ায় প্রেরণ করেন। * মুসলিম মিল্লাতের পিতা হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ঈমানের মহা কঠিন পরীক্ষা দিতে নমরুদের অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন ১০ মহররম। * ১০ মহররম খোদাদ্রোহী ফেরাউন বিপুল সেনাবাহিনী নিয়ে নীল দরিয়ার অতল তলে তুবে মরে আর হযরত মুসা (আঃ) বনি ইসরাইলদের নিয়ে পানির ওপর দিয়ে পার হয়ে যান। * হযরত ইউনুছ (আঃ) ৪০ দিন মাছের পেটে অবস্থানের পর ১০ মহররম নাজাত পেয়েছিলেন। * হিজরী ৬১ সনের ১০ মহররম ঐতিহাসিক কারবালার প্রান্তরে অত্যাচারী শাসক ইয়াজিদের বাহিনী কর্তৃক হজরত ইমাম হোসাইন রাঃ-কে যে নির্মমভাবে শহীদ করা হয়। এত গুলো ঘটনার সাক্ষীবহ এই দিন, রাসুল পাক (সাঃ)স্বয়ং নিজে যেই দিনে ইবাদত পালন করে এবং আমাদের কে পালন করতে বলে গেছেন সেই দিনটি তে কোন যুক্তিতে রাসুলের ওফাতের পরে সম্পাদিত শুধু মাত্র একটি ঘটনার জন্য শোকের মাস হিসেবে মাতমের সহিত, অনৈসলামিক নিয়মে পালন করা হয়? প্রিয় নবী সাঃ এর প্রাণ প্রিয় নাতী হত্যার শোকে মুসলান মানেই ব্যথিত এবং কেয়ামত পর্যন্ত তা যথাযোগ্য মর্যাদা এবং আল্লাহ্ প্রদত্ত বিধান অনুযায়ী তা স্মরণীয় এবং পালনীয় হয়ে আসবে এটা স্বাভাবিক। অথচ মহররম মাস এলেই এক শ্রেণীর মানুষ তাজিয়া, শোকগাঁথা পাঠ, শোক পালন, মিছিল বের করা, শোক প্রকাশ্যে নিজের শরীরকে রক্তাক্ত করা প্রভৃতি কাজ করে থাকেন। এ ধরনের কোনো রেওয়াজ ইসলামের কোথাও বর্ণিত হয়নি। এসব রসম-রেওয়াজের কারণে এ মাসটিকেই অশুভ মাস মনে করার একটা প্রবণতা অনেক মুসলমানের মধ্যেও লক্ষ করা যায়। কিন্তু নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং ইরশাদ করে গেছেন, ‘তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্কে নেই যারা মুখ চাপরায়, কাপড় ছিড়ে এবং জাহেলি যুগের কথাবার্তা বলে।’ অতএব শাহাদাতে হুসাইন (রা)কে কেন্দ্র করে কোনো ধরনের অনৈসলামিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত না হওয়া এবং সব ধরনের জাহেলি রসম-রেওয়াজ থেকে দূরে থাকা প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্য কর্তব্য। কেন না আল্লাহ্ প্রদত্ত বিধান পবিত্র কোরআন এবং রাসুলের সুন্নত ব্যাতিত কোন কিছুই ইসলামের মুল বিষয়ে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। আল্লাহ্ আমাদের সকল কে ইসলামের সঠিক জ্ঞান দান করুন এবং সেই অনুযায়ী আমল করার তৌফিক দান করুন। ( আমিন )

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ