শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে

Call

কৃষি জমিতে সাধারণত চুন ব্যবহার করা হয় কারণ , মাটির অম্লতা হ্রাসের জন্য ।

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ

যার ধন তার নয়, নেপোয় মারে দই -প্রবাদটির নতুন বিশ্লেষণ
নূরিতা নূসরাত খন্দকার

যার ধন তার নয়, নেপোয় মারে দই- এটি একটি অপভ্রংশ প্রবাদ। ভুলক্রমে এটিই বাগধারা প্রবচনে চলিত হয়ে আসছে। আচ্ছা বলুন তো ধন দৌলতে দই আসে কোত্থেকে? ধন আর দইয়ের রূপকার্থে লিঙ্ক কোথায়? আবার 'নেপো', যে শব্দটির কোনো আভিধানিক অর্থ নেই। অভিধানে যা আছে তা সবই আনুমানিক মাত্র। নফর থেকে নেপো, নৃপ থেকে নেপো। কেউ কেউ তো নাপিত থেকেও নেপো আসতে পারে বলে নাপিতের ধূর্ততা ইত্যাদি ব্যাখ্যাও করেছেন।

কিন্তু আমাদের মতন কিছু কৌতুহলির মনে এসব কোনো প্রচলিত ব্যাখ্যাই সায় দেয়নি যুক্তির দুর্বলতা হেতু। এ যুগে আমাদের কাছে একটি প্রশ্ন বারংবার থেকে গেছে। তা হলো ধন-নেপো-দই এই তিন শব্দের প্রত্নমিলন কোথায়? প্রথমত, নেপো শব্দের আভিধানিক অর্থগুলো আনুমানিক। দ্বিতীয়ত, ধনসম্পত্তির সাথে দইয়ের যোগাযোগটা একেবারেই খাপছাড়া। এই দই সন্ধানে আমি নিজেও ননিচোর গোপাল বা শ্রীকৃষ্ণের মিথ পর্যন্ত ভেবে ফেলেছি। যদি তাতে কোনো নেপো পাওয়া যায়! না। সেসব করতে গিয়ে গুড়ে বালিই জুটেছে। তবে চারিদিক থেকে ভাবনার গবেষণ চলছিলো বিস্তর। বিশেষ করে কলকাতার অগ্রজ বন্ধু শ্রদ্ধেয় ডঃ অসিত দাস এটি নিয়ে নানান দিকের ভাবনা প্রসরণ করে করে আমার মনোযোগ আকৃষ্ট করেছেন। অবশেষে তিনি একটি সমাধানও আনতে পেরেছেন। ঠিক যে অংশটি দইয়ের কারণে প্রশ্নবিদ্ধ ছিলো আমাদের কাছে, যা দুর্বোধ্য ছিলো ঠিক সেই অংশটিই আজ তাঁরই অনুসন্ধানে আবিষ্কৃত  হলো। ডঃ অসিত দাস তাঁর পোস্টে এটির যৌক্তিক সমাধান টেনেছেন। ব্যাখ্যাটির শিরোনাম এইভাবে দিয়েছেন, "নতুন আলোয় 'নেপোয় মারে দই'"।

বিশ্লেষণে তিনি লিখেছেন, "পুরো প্রবাদটি হল, "যার ধন তার ধন নয়, নেপোয় মারে দই(নেই পরমার্থদায়), এক পুরুষে করে টাকা, অন্য পুরুষ খায়"।
অনেক চেষ্টা করেও কেউ 'নেপো' শব্দটির প্রকৃত ব্যুৎপত্তি দিতে পারেননি। অভিধানে কেউ বলেছেন, নৃপ থেকে এসেছে, কেউ বলেছেন শব্দটি দেশি। আমিও অনেক দিক দিয়ে চেষ্টা করেছি, কিন্তু 'দই' কেন, তার ব্যাখ্যা পাইনি।
তাই মনে হচ্ছে, 'নেপোয় মারে দই' অংশটুকু পুরোটাই অপভ্রংশ। 'বিদ্যাস্থানে ভয়ে বচ'-র মত। আসলে ছিল 'বিদ্যাস্থানেভ্য এব চ'। আলোচ্য বাগধারাটিতে 'নেপোয় মারে দই'-এর প্রকৃত পাঠ 'নেই পরমার্থদায়'। 'পরমার্থদায়' হলেন সমস্ত ধনের অধিকারী ঈশ্বর বা মালিক। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, দই-এর চেয়ে, দায়-র সঙ্গে 'খায়' অন্ত্যমিল হিসেবেও লাগসই। 'নেই পরমার্থদায়'-এর মানে না বুঝেই গড়পড়তা বাঙালি 'নেপোয় মারে দই' করে নিয়েছে। যুগ যুগ ধরে চলেও আসছে। প্রবাদটিতে বলা হয়েছে, প্রকৃত মালিক না থাকায় স্বার্থান্বেষী, সুবিধাবাদীরা সম্পদ লোপাট করছে।"

অতএব আমরা যুক্তিতে একাত্ম হয়েছি, কালের প্রবাহে জনশ্রুতিতে ভাঙতে ভাঙতে 'নেপোয় মারে দই' অংশটি মৌখিক বাচনে এসে জটিল বাক্যাংশ নির্মাণ করেছে। যার ফলে 'নেপোয় মারে দই' -অংশটি ভিন্ন অর্থ বহন করছে। যার সাথে আদি বাক্যের কোনো সম্পর্কই স্থাপিত হয় না। ছন্দেরও ক্ষেত্রে সেহেতু খটকাও সৃষ্টি হয়েছে। প্রকৃত বাক্য ও অর্থ উদ্ধারে ডঃ অসিত দাস এঁর অনুসন্ধানমূলক প্রক্রিয়ায় আমি নিজেও এই উৎসাহিত হয়েছি। এবং তাঁর সাথে মতদ্বিমত, ঐক্যমত ভিত্তিক নিত্য আলোচনায় অংশ নিয়েছি। কিন্তু অর্থায়নের দিক দিয়ে আমার ব্যাখ্যাটি ভিন্ন হয়ে দাঁড়িছে অবশেষে। এবার আমার একান্ত যুক্তিগুলো মেলে ধরছি। হয়ত ভুলত্রুটিও থাকতে পারে আমার বিশ্লেষণে। যেহেতু গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি পাঠক ও গবেষকদের একান্ত বিষয় নয়। একান্ত ভাবনাকেও সার্বিক যুক্তিতেই প্রতিষ্ঠা করতে হয় সচেতন গবেষক হিসেবে।

খ. আমার একান্ত যুক্তি খণ্ডনঃ

মহাজাগতিক আধ্যািত্মিক ও প্রাকৃত জীবনের বাস্তবিকতার সাথে এই প্রবাদটির প্রচলন হওয়া প্রাচীন বঙ্গীয় সমাজে খুব স্বাভাবিকই ছিলো। এখানকার লোকজ ধর্মগুলো ছিলো বৈরাগ্য সাধনা, তন্ত্রসাধনার মূলে স্থিত। এখানে বৈরাগ্য ভাবনাই প্রকাশ পেত সবকিছুতে। গানের ক্ষেত্রে চর্যাপদ তা স্বীকার করে। আধ্যাত্মিক ভাব দর্শন লালিত সমাজে তাই, 'নেই পরমার্থদায়' বাক্যাংশই জুতসই বৈরাগ্য বাণী। ডাক্তার অসিত দাসের সাথে এই বাক্যাংশেরই অপভ্রংশ ঘটেছে,  সেই মতের সাথে আমি সম্পূর্ণ সহমত জানাচ্ছি।

তবে, অর্থ বিচারে আমার ভাবনার পার্থক্যটুকুই এখানে স্পষ্ট করবো। 'নেই পরমার্থ দায়'- অর্থায়নে ঈশ্বরেরও দায় নেই অর্থে বোঝানো হয়েছে বলে আমি মনে করছি। মানুষের সব ধনের মালিক ঈশ্বর, এটি বৈরাগ্য চিন্তা নয় বরং বৈদিক ভাবসম্পদ। কিন্তু তাও যদি হয়, তবে বৈদিক মতেও সেই ঈশ্বর এইসব বাহ্যিক ধন সম্পদের দায় বহন করে থাকবেন। কারণ বৈদিক ধারণায় কর্তৃত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কর্তৃত্ব বিচার্যে ঈশ্বরের পরেই পুরোহিত, পুরোহিতের পরেই রাজার অবস্থান। অর্থাৎ এখানে সকল ধন সম্পত্তির মালিক ঈশ্বর।

কিন্তু যদি প্রাচীন বাংলার বৈরাগ্য সাধনার পথ ধরে বলা হয়, তাহলে এই প্রবাদের প্রকৃত যুক্তি খণ্ডন সহজ হয়ে যায়। তাতে করে দেহতাত্ত্বিক ও আধ্যাত্মিক -দুই তন্ত্রের সাথেই প্রবাদটির যোগসূত্রও বেড়ে যায়। বাংলার লোক জীবনে বস্তু-জাগতিকতার মেলবন্ধনে আধ্যাত্মিকতার উন্মেষ ঘটেছে; ঠিক আজকের যুগে বাস্তবাদীতার প্যারালাল প্লাটফর্ম পরাবাস্তববাদীতাকে যেভাবে ব্যাখ্যা করা হয়, সেইভাবে। দেহকে সম্পদরূপে দেহধন, সাধের দেহ; আত্মার বসতি অর্থে দেহনগর; জীবনকাল অর্থে দেহঘড়ি - এইসব শব্দযুগলের ব্যবহার প্রাচীন বৈরাগ্য-সহজিয়া-বৈষ্ণব-বৈষ্ণব সহজিয়া বিভিন্ন মহাযানি তন্ত্র থেকে বিবর্তিত হতে হতে বর্তমানকালের বাউল সাধনার পদেও লক্ষ্য করা যায়।

প্রাচীন কাল থেকে এদেশের মূলধারার ভিত্তি প্রস্তুত হয়েছে (দেহ ও আত্মা চিন্তায় গড়ে ওঠা দেহতত্ত্ব ও আত্মতত্ত্ব মিলনে) আধ্যাত্মিকতায়। মহাপ্রেমবাদ এতোই এখানে প্রবল ছিলো যে, গুপ্তযুগের সংস্কৃত পণ্ডিত কবি কালিদাসও এর বাইরে যেতে পারেননি। মহাপ্রেমবাদের সম্মিলনে লক্ষন সেনের আমলেও গান্ধর্ব্ব সংগীতেও রচিত হয়েছে 'গীতগোবিন্দম' বৈষ্ণবপদাবলী। সেই মহাপ্রেমবাদ মূলত লোকজ দর্শনে নির্মিত বৈরাগ্য ধর্মাবলীর বয়ান থেকেই গৃহীত হয়েছে। বৈরাগ্যের মূল বিষয় হলো, আমরা আমাদের আত্মাকে বহন করি দেহের ভিতর। আত্মার বস্তুগত সম্পদ বা ধন হলো দেহ। কিন্তু এই ধনের উপর আত্মারও দায় থাকে না। একসময় দেহ মরে যায়।  দেহ মরে গেলে আত্মাকে নতুন ধন বা দেহপ্রাপ্ত হতে হয়। এই নতুন দেহপ্রাপ্তি প্রক্রিয়াচক্রে পরম (বা শক্তির আদিমূল মহাশক্তি) থাকে দায়হীন। মহাশক্তির অংশ হয়েও দেহের ধ্বংস নিশ্চিত। কিন্তু আত্মা অবিনশ্বর। তাই আত্মার বাহন প্রয়োজনে দেহযান বা ধন সৃষ্ট হলেও পরমার্থে সেই ধন আত্মারও নয়। তাই প্রকৃত যুক্তির নিমিত্তে এটিই মহাসত্য যে,  যার ধন তার নয়, নেই পরমার্থ দায়। ঈশ্বর শব্দটি প্রাচীন বাংলার শব্দ নয়। বাংলার প্রাচীন লোকগাথায় 'পরম' শব্দটিই বহুল ব্যবহৃত হয়েছে কখনও জাগতিক মহাশক্তির রূপক হিসেবে। কখনোবা স্রেষ্ঠ বা স্রষ্টা হিসেবে। আর্য কৃষ্টি বিস্তারের পর উপনিষদ ও বেদ প্রভাবে 'ঈশ' থেকে ঈশ্বর শব্দের বিবর্তন ঘটেছিলো।

গ.
পরিশেষে, যেকোনো প্রবাদবচন ও বাগধারার উৎপত্তি ঘটে সমাজ জীবনের উপকরণ থেকে। তাই আলোচ্য প্রবাদটিও কালের প্রবাহে শব্দগত আধুনিকতা ধারণ করলেও এটির প্রকৃত যুক্তিতে বৈরাগ্য সাধন বচনের উৎকৃষ্ট নিদর্শন। যেমন বর্তমানে 'বিসমিল্লায় গলদ' প্রচল প্রবাদটি দেখলে সহজেই বোঝা যায় এটি মুসলমান আমলে পরিবর্তিত হয়েছে। 'গোড়ায় গলদ' আদি বচন থেকে বাঙালি (মুসলিম) লেখকের মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়ে 'বিসমিল্লায় গলদ' হয়েছে। এটি অপভ্রংশ নয়, রূপান্তর। কিন্তু আলোচ্য বাগধারাটি একেবারে এতোটাই  অপভ্রংশ হয়ে আসছে যে, এর অর্থ শাব্দিক ভাবাদর্শনও অহেতুক এবং বাক্যগঠনেও অযৌক্তিকতা জুড়ে গেছে। তাই এর সমাধান আনা জরুরি হয়ে গেছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস বৈরাগ্য চেতনা বিশ্লেষণেই বাগধারাটি সম্পূর্ণ অর্থ যৌক্তিকতা বহন করে-

যার ধন তার নয়
ণৈ/ নেই পরমার্থ দায়।

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ