বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুরুষ প্রজনন অক্ষমতা বা ইনফার্টিলিটির ব্যাপারটি আমাদের দেশে এড়িয়ে যাওয়া হয় অথবা যতটুকু মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন ঠিক সে রকম মনোযোগ দেওয়া হয় না। তাছাড়া সামাজিকভাবে আমরা ধরে নিই সন্তান না হওয়ার জন্য পুরুষদের কোনো সমস্যা থাকতে পারে না। অথচ দেখা গেছে যে অনেক ক্ষেত্রেই সন্তান না হওয়ার জন্য শুধু স্বামীর সমস্যাই দায়ী আর ক্ষেত্রবিশেষে স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীর সমস্যা যোগ হয়ে থাকে। সুতরাং এক্ষেত্রে শরণাপন্ন হওয়া উচিত এমন একজন চিকিৎসকের কাছে যার রয়েছে জ্ঞান, অভিজ্ঞতা এবং যিনি শুধু এ বিষয়েই নিবেদিত। এক্ষেত্রে ভালোভাবে চিকিৎসা করার জন্য একটি অত্যাধুনিক এবং স্পেশালাইজড পরীক্ষাগার প্রয়োজন। আর দরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটা চিকিৎসক দল। ভালো ফল পাওয়ার জন্য রোগীর মানসিক ব্যাপারগুলোও চিকিৎসার আওতায় আনা উচিত।
ক. শুক্রবাহী নালি অনুপস্থিত থাকা। এ অবস্থা সাধারণত জন্মগতভাবে দেখা দিয়ে থাকে।
খ. শুক্রবাহী নালি বন্ধ থাকতে পারে।
সেমিনাল ভেসিকেল, প্রোস্টেট ও অন্য কিছু গ্রন্থি থেকে নিঃসরণ নিয়ে গঠিত হয় সেমিনাল ফ্লুইড। এর ৩০% আসে সেমিনাল ভেসিকেল থেকে। সেমিনাল ভেসিকেলের নিঃসরণ শুক্রাণুকে শক্তি জোগায় এবং বীর্যের ক্ষারত্ব রক্ষা করে। কোনো কারণে এর মুখ বন্ধ হলে বা কার্যকারিতা কমে গেলে শুক্রাণু বেঁচে থাকতে পারে না বা নিষিক্ত করার ক্ষমতা হারায়। আবার প্রোস্টেট ও অন্যান্য গ্রন্থির সংক্রমণ হলেও বীর্যের মান পরিবর্তিত হয় এবং শুক্রগুলোর বেঁচে থাকা বা ডিম্ব নিষিক্ত করার ক্ষমতা কমে যায় বা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আবার সেমিনাল ফ্লুইড খুব ঘন হলে শুক্রাণুগুলোর জন্য স্ত্রী জননতন্ত্রে সঞ্চারিত হওয়া কষ্টকর হয়। ভালো শুক্রাণুগুলোকে প্রসেস করে আশপাশের কোষ বর্জ্য, মৃত শুক্রাণু ইত্যাদি থেকে আলাদা করা সম্ভব। তারপর এই ভালো শুক্রাণুগুলোকে জরায়ুতে স্থানান্তরিত করলে অনেক ক্ষেত্রেই কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায়।
এ অবস্থায় অণ্ডকোষে শুক্রাণু তৈরি হয় না। এ ধরনের সমস্যা জেনেটিক অথবা হরমোনজনিত কারণে হয়ে থাকে। বীর্যে শুক্রাণু না থাকা মানেই পিতৃত্ব অসম্ভব_ এটা ঠিক নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, টেস্টিকুলার ফেইল্যুর কেসগুলোতেও ১৫-৩৫% ক্ষেত্রে অণ্ডকোষ থেকে ফাইন নিড্ল্ এসপিরেশন বা বায়োপসি করে কিছু শুক্রাণু পাওয়া সম্ভব। আবার শুক্রবাহী নালি বন্ধ থাকার জন্য যদি বীর্যে শুক্রকীট না পাওয়া যায়, তাহলে অণ্ডকোষ বা এপিডিভাইসিস থেকে শুক্রাণু বের করে আনা এ পদ্ধতিকে ইন্ট্রা-সাইটোপ্লাজমিক স্পার্ম ইনজেকশন বলা হয়।
অণ্ডকোষে আঘাত পেলে, ইনফেকশন হলে, কোনো অপারেশন হলে এমনকি বড় ভেরিকোসিল হলে শুক্রাণুর বিরুদ্ধে শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হতে পারে। এই অ্যান্টিবডি নিষিক্তকরণ প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়ে থাকে। যেমন সারভাইক্যাল মিউকাস ভেদ করে জরায়ুতে যেতে, ডিম্বাণু সঙ্গে ফিউজ হতে এবং ডিম্বের বাইরের আবরণ ভেদ করে ভেতরে যেতে শুক্রাণুর জন্য সমস্যা হতে পারে।
ভ্যারিকোসিল হচ্ছে স্ফীত হয়ে যাওয়া রক্তনালি। এই নালি অণ্ডকোষ থেকে বাড়তি রক্ত নিয়ে যাওয়ায়, রক্ত জমে শুক্রাণু উৎপাদন ব্যাহত করতে পারে। একটা ছোট্ট অপারেশনের মাধ্যমে এই ত্রুটি দূর করা সম্ভব।
শুনতে অবাক লাগতে পারে, যারা নিঃসন্তান তাদের মধ্যে ৫% দম্পতির সন্তান না হওয়ার মূল সমস্যা হলো যৌন মিলনে সমস্যা। এর মধ্যে উলেল্গখযোগ্য হলো লিঙ্গ উত্থানে সমস্যা, তাড়াতাড়ি বীর্যস্খলন, বীর্যপাত না হওয়া, উল্টোপথে মূত্রথলিতে বীর্যপাত, সময়মতো যৌন মিলন না হওয়া এবং মাত্রাতিরিক্ত হস্তমৈথন। আমাদের দেশে প্রবাসীদের অনেকে ২/৩ বছর পরপর যখন সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ছুটিতে দেশে আসেন, তখন হয়তো ডিম্ব নিষিক্তকরণের জন্য উপযুক্ত সময় নয়। ফলে কাঙ্ক্ষিত সন্তান ধারণও হয় না।
যখন একটি বাচ্চার অণ্ডকোষ অণ্ডথলিতে না থেকে পেটের ভেতরে কোথাও থাকে, তাকে ক্রিপটঅরকিডিজম বলে। অণ্ডকোষ হচ্ছে খুব তাপ সংবেদনশীল। তাই এটা পেটে থাকলে এর শুক্রাণু উৎপাদন ক্ষমতা চিরতরে নষ্ট হয়ে যায়। জন্মের এক বছরের মধ্যে অপারেশন করে অণ্ডথলিতে না স্থাপন করলে প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়।
অনেক ওষুধ আছে যা আমাদের খুবই পরিচিত এবং আমরা প্রায়ই ব্যবহার করি কিন্তু এই ওষুধগুলো শুক্রাণু উৎপাদন ও কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়। ওষুধগুলো হচ্ছে কিটোকোনাজল, সালফাস্যালাজিন, স্পাইরোনোল্যাকটোন, ক্যালসিয়াম চ্যানেল বল্গকারস, অ্যালোপিউরিনল, ইরাইথ্রোমাইসিন, জেনটামাইসিন, মেথোট্রিকসেট, সিমেটিডিন ইত্যাদি। এছাড়া কিছু ওষুধ রয়েছে যা কি-না বীর্যপাতে সমস্যা করতে পারে। যেমন ক্লোরপ্রোমাজিন, হ্যালোপেরিডল, অ্যামিট্রিপটালিন, ইমিপ্রামিন, ফ্লুক্সোটিন, সারট্রালিন, ফেনোক্সিবেনজামিন, থায়াজাইড ইত্যাদি।
আমাদের মাথার মধ্যে অবস্থিত পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হরমোন না থাকলে বা অপর্যাপ্ত পরিমাণে নিঃসৃত হলে শুক্রাণু উৎপাদন ব্যাহত হয়। বীর্য পরীক্ষায় যদি অস্বাভাবিক রিপোর্ট পাওয়া যায় তাহলে হরমোন পরীক্ষা করাটা জরুরি।
অনেকেরই পুরুষ জননতন্ত্রে বিভিন্ন জীবাণু সংক্রমণ হয়। এ সংক্রমণ প্রোস্টেট, এপিডিডাইমিস-এ হতে পারে, এমনকি অণ্ডকোষেও হতে পারে। সাবালকত্বের পর যদি অণ্ডকোষে মাম্পস ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে, সে ক্ষেত্রে অণ্ডকোষ চিরতরে তার শুক্রাণু উৎপন্ন করার ক্ষমতা হারাতে পারে। ব্যাকটেরিয়া দিয়ে সংক্রমণ অথবা যৌনরোগের জন্য শুক্রবাহী নালি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাছাড়াও ইনফেকশন হলে সাদা রক্ত কণিকা তৈরি হয় যা শুক্রাণুর কর্মক্ষমতা ব্যাহত করে।
গবেষণায় দেখা গেছে, সিগারেটের মধ্যে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থগুলোর কারণে শুক্রাণুর ঘনত্ব ২৩% এবং এদের চলন ক্ষমতা ১৩% কমে যায়। তাছাড়া অস্বাভাবিক গঠন নিয়ে তৈরি শুক্রাণুর সংখ্যা বেড়ে যায়। ফলে পুরুষের প্রজনন ক্ষমতা কমে যায়। ধূমপানে ক্ষতিগ্রস্ত হয় হাইপোথেলামিক- পিটুইটারি- গোনাডোট্রপিক এক্সিস (হরমোন গ্রন্থির ধাপ) এবং লেইডিগ কোষ, যা কি-না অণ্ডকোষে পুরুষ হরমোন টেস্টোসটেরন তৈরি করে থাকে। এরপর যদি শিশু জন্ম নেয়, সেক্ষেত্রে শিশুর জন্মগত ত্রুটি এবং ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
মারিজুয়ানা, কোকেন ইত্যাদি মারাত্মকভাবে শুক্রাণুর সংখ্যা, চলন ক্ষমতা, স্বাভাবিক গঠন ইত্যাদি ব্যাহত করে।
পত্রিকায় প্রায়ই দেখবেন বিশেষ করে অ্যাথলেটসরা এনাবলিক স্টেরয়েড নেওয়ার জন্য বহিষ্কৃত হয়েছেন। এ জাতীয় ওষুধ শুক্রাণু তৈরির প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে, শুক্রকীটের সংখ্যা কমতে থাকে, অনেক ক্ষেত্রেই নির্বীজ হয়ে যায় ওষুধ সেবনকারী পুরুষটি।