হ্যাচারিতে উৎপাদিত পোনার গুণগতমানের ওপর নির্ভর করছে চাষের অধীনে মাছের উৎপাদনের সফলতা। হ্যাচারিতে উৎপাদিত পোনার গুণগতমান নির্ভর করে হ্যাচারির ব্রুড মাছের গুণগতমানের ওপর। এ ক্ষেত্রে সহজেই অনুমেয় যে, ভালোমানের পোনা উৎপাদনে ব্রুডমাছ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বড় আকারের মাছ হলেই কি ব্রুডমাছ হিসাবে ব্যবহার করা যাবে? প্রকৃতপক্ষে তা নয়। তা হলে ব্রুডমাছ মাছ বলতে কী বোঝায় সেটা জানা প্রয়োজন। একটি সুনির্দিষ্ট প্রজনন কর্মসূচির মাধ্যমে উৎপাদিত পোনা, অথবা প্রাকৃতিক উৎস থেকে সংগৃহীত পোনা, সঠিক ব্যবস্থাপনায় একটি নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত লালিতপালিত করার পর একটি নির্দিষ্ট ওজন লাভ করলে সেটাকে ব্রুডমাছ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া যেতে পারে।
মানসম্পন্ন ব্রুডমাছের বৈশিষ্ট্য হলোঃ
দেশে এরূপ কার্প হ্যাচারির সংখ্যা খুবই কম যেখানে ব্রুড উৎপাদনের নিজস্ব কর্মসূচি আছে বা উন্নত ব্রুড সংগ্রহের বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করা হয়ে থাকে। উপরে উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যযুক্ত ব্রুডমাছ হলেই ভালো পোনা পাওয়া যাবে। তবে, ব্রুডমাছের চাষ ব্যবস্থাপনাও এ ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। রেণু উৎপাদন মৌসুমে ভালো মানের পোনা মৌসুমের শুরুতেই প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য ব্রুডমাছ কীভাবে প্রতিপালন করা হবে বা প্রজনন মৌসুমের আগে বিশেষ করে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে ব্রুডের যত্ন কীভাবে নেয়া হবে সে বিষয়ে নিম্নে আলোচনা করা হলো।
১. ব্রুডমাছের পুকুর নির্বাচন সঠিকভাবে ব্রুডমাছ প্রতিপালনের ক্ষেত্রে পুকুর নির্বাচনের বিষয়ে সবিশেষ নজর দিতে হবে কারণ যে কোনো পুকুরে ব্রুড সংরক্ষণ বা প্রতিপালন করা যায় না। পানি আছে এবং মাছ বেঁচে আছে তার মানে এটা নয় যে, মাছ ভালো অবস্থায় আছে। ব্রুড মাছের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলো মাছ যাতে কোন অবস্থায় ধকলের সম্মুখীন না হয়। ব্রুড মাছের পুকুরের যে সব বৈশিষ্ট্য অবশ্যই থাকতে হবেঃ
২. পুকুর প্রস্তুতি পুকুর নির্বাচনের পর পুকুর ভালোভাবে প্রস্তুত করতে হবে। সেজন্য কতকগুলো কাজ করতে হবে। সেগুলো নিম্নরূপঃ
৩. ব্রুডমাছ মজুদ সার প্রয়োগের ৪-৫ দিন পর পুকুরে পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক খাবার তৈরি হলে একর প্রতি ৭৫০-৯০০ কেজি বাছাই করা বিভিন্ন প্রজাতির ব্রুড উপযোগী মাছ (প্রাকৃতিক উৎসের বা পরিকল্পিতভাবে উৎপন্ন) মজুদ করতে হবে । ব্রুড মাছের পকুরে অধিক ঘনত্বে মাছ রাখলে ডিম আসে দেরিতে, ডিমের পরিপক্কতা লাভ করতে বিলম্বে হয় ও হ্যাচারির মালিক লাভ থেকে বঞ্চিত হন। মাছে নানা প্রকার রোগ বিশেষ করে আরগুলাস সমস্যা এবং অক্সিজেন ঘাটতি দেখা দিতে পারে। স্থানীয় চাহিদার ওপর ভিত্তি করে ব্রুডমাছের প্রজাতি নির্বাচনে তারতম্য ঘটতে পারে। কাতল মাছের রেণুর চাহিদা বেশি থাকলে এবং দ্রুত ডিম আনতে পুকুরে কাতলের সাথে সিলভার কার্প মাছ না ছাড়াই ভালো। মৌসুমের শুরুতে রুই মাছে ডিম পাবার জন্য মজুদ ঘনত্ব কিছুটা কমাতে হবে এবং সে পুকুরে কাতল অথবা বিগহেড মাছ মজুদ না করা উত্তম।
৪. সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ প্রকৃতপক্ষে মা-মাছের পুষ্টির ওপর উৎপাদিত রেণুর জীবিত থাকা ও বর্ধনের হার অনেকাংশে নির্ভর করে। পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্যের প্রাচুর্যের পাশাপাশি মাছের পুষ্টি নিশ্চিত করার জন্য অবশ্যই সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে। খাদ্যে আমিষের পরিমাণ ২৫-৩০% থাকা বাঞ্চনীয়। খাদ্যের উপকরণ নিম্নরূপ হতে পারেঃ খাদ্য উপকরণসমূহ একত্রে মিশিয়ে বল বা পিলেট আকারে মাছের দৈহিক ওজনের ২-৩% হারে দৈনিক প্রয়োগ করতে হবে। অধিক শীতে এবং মেঘলা অবস্থায় খাদ্য কমিয়ে দিতে হবে। মাছ কতটুকু খাদ্য খাচ্ছে তা অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে। কারণ উচ্ছিষ্ট খাদ্য পচে পরিবেশ নষ্ট করলে পুকুরে ক্ষতিকর গ্যাসের সমস্যা দেখা দিতে পারে। পুকুরের গ্রাসকার্প মাছের জন্য ক্ষুদি পানা, নরম ঘাস বা কলাপাতা অবশ্যই দিতে হবে । গ্রাস কার্প মাছের ডিম আসা অনেকাংশে নির্ভর করে এ সকল খাদ্যের ওপর। খাদ্য তৈরিতে গরুর রক্ত ব্যবহার করলে খাদ্য পুষ্টিসমৃদ্ধ হয় এবং মাছের ডিম পুষ্ট হয় দ্রুত। ব্রুডমাছকে মাঝে মধ্যে খুদ সিদ্ধ করে খাবারের সাথে মিশিয়ে খাওয়ালে ভালো ফল পাওয়া যায়।
৫. পানি ব্যবস্থাপনা ব্রুড ব্যস্থাপনায় পুকুরের পানির গুণগতমান বিশেষ ভূমিকা রাখে। পুকুরের পরিবেশ ভালো রাখার জন্য পুকুরের পানি আংশিক পরির্বতন করতে হবে। বিশেষ করে খুব ভোরে ব্রুডমাছের পুকুরে মাঝে মধ্যে পানি সরবরাহ (water flash) করলে মাছ অক্সিজেনের স্বল্পতা হতে মুক্ত থাকায় ধকল থেকে মুক্ত থাকে। নতুন পানি পাওয়ায় মাছের শারীরবৃত্তিক কার্যক্রম বেড়ে যায়, ডিমের বিকাশ সঠিকভাবে হয় এবং দ্রুত পুষ্ট হয়।
৬. অন্যান্য পরিচর্যা পুকুরের তলদেশে গ্যাস জমেছে কি না তা দেখতে হবে এবং মাঝে-মধ্যে হররা টেনে বা পুকুরের তলদেশ আলোড়িত করে গ্যাস অপসারণ করতে হবে। মাঝে মধ্যে মাছ ধরে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। মাছ অপুষ্ট মনে হলে খাদ্য প্রয়োগের হার বাড়াতে হবে। পুকুরের পরিবেশ ভালো রাখার জন্য অল্প মাত্রায় (শতকে ১০০ গ্রাম) চুন প্রয়োগ করা যেতে পারে। পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্যের প্রাচুর্য পরীক্ষা বা পানির রং পর্যবেক্ষণ করে পূর্বে উল্লেখিত হারে সার প্রয়োগ করতে হবে। এভাবে ব্রুড মাছের পরিচর্যা করলে সাধারণত তেমন কোনো রোগ দেখা দেয় না। তবে অনেক সময় ব্রুড মাছে আরগুলাস এর সমস্যা দেখা দিয়ে থাকে। এতে রুই মাছের ব্যাপক ক্ষতি হয়। মাছে ডিম আসতে দেরী হয়, ডিম পুষ্ট হয় না ও রেণুর গুণগত মান খুব খারাপ হয় বিধায় রেণুর বাঁচার হার অনেক কমে যায়। এর ফলে হ্যাচারি মালিক বিশেষভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে থাকেন। কোনো ব্রুড মাছের পুকুরে আরগুলাস দেখা দিলে বুঝতে হবে ব্রুড ব্যবস্থাপনা সঠিক হচ্ছে না। অধিক জৈব পদার্থ পচন (খৈল অধিক পচিয়ে পুকুরে দেয়া, অধিক পচা গোবর পুকুরে প্রয়োগ, বাঁশ অথবা সবুজ পাতাসমৃদ্ধ গাছের ডাল পানিতে ভিজিয়ে রাখা) ও অধিক ঘনত্বে মাছ রাখা আরগুলাস সমস্যার প্রধান কারণ। এ সমস্যা হলে দ্রুত প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ জন্য পুকুরে ০.৩৫ পিপিএম হারেডিপটারেক্স বা সুমিথিয়ন দিতে হবে। আক্রান্ত পুকুরে প্রতি ৭ দিন অন্তর মোট তিন বার ডিপটারেক্স বা সুমিথিয়ন প্রয়োগ করতে হবে। এখানে উল্লেখ্য যে, এ চিকিৎসা প্রয়োগে আরগুলাস দূর হয় কিন্তু পুকুরের সমস্ত প্রাণীকণা (zooplankton) মারা যায় বিধায় কাতল অথবা বিগহেড মাছের পুষ্টি সমস্যা দেখা দেয় এবং তারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এজন্য পুকুরে যাতে আরগুলাস সমস্যা না হয় সে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আরগুলাস (মাছের উকুন) সমস্যা ছাড়াও ব্রুডমাছের পুকুরে অক্সিজেন সমস্যা দেখা দিয়ে থাকে। মাছ সকাল ৮:০০-৯:০০ ঘটিকা পর্যন্ত পানির উপর স্তরে এসে খাবি খেতে থাকে এবং অনেক সময় ভোরে মাছ মরে ভেসে উঠতে পারে।
সাধারণত ব্রুডমাছ অধিক ঘনত্বে রাখলে এ সমস্যা দেখা দেয়; তবে অধিক খাদ্য বা সার প্রয়োগের কারণেও এ সমস্যার সৃষ্টি হতে দেখা যায়। সমস্যা দেখা দেবার সাথে সাথে পুকরের পানি আলোড়িত করার ব্যবস্থা করতে হবে (সাঁতার কাটা, পাতিল অথবা বাঁশ দিয়ে পানির উপরে আঘাত করা)। বর্তমানে বাজারে পানিতে অক্সিজেন বৃদ্ধিকারক নানা ধরনের উপকরণ যেমন অক্সিফো, অক্সিগোল্ড, কুইক অক্সিজেন প্রভৃতি পাওয়া যায় যা প্রয়োগ করা যেতে পারে। তবে পানি প্রবাহের মাধ্যমে স্রোতের সৃষ্টি করলে এ সমস্যা দ্রুত দূর করা যায়। সকাল ৮:০০-৯:০০ ঘটিকা পর্যন্ত মাছ ভেসে থাকলে অনেকে এটাকে সমস্যা হিসেবে মনে করতে চান না কিন্তু এটা ঠিক নয়। কারণ মাছ অক্সিজেনের অভাবজনিত সমস্যায় পড়লে অত্যন্ত কাহিল হয়ে পড়ে এবং মারাত্নক ধকলে পড়ে। এ অবস্থায় মাছের খাবার গ্রহণে অরুচি হয় ও স্বাভাবিক দৈহিক বৃদ্ধি হ্রাস পায়। এ ছাড়া বিশেষ করে গোনাড বিকাশে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। এর ফলে মাছে ডিম আসতে বেশি সময় লাগে এবং ডিমের পুষ্টি সমস্যা থাকে। এ ধরনের ডিম থেকে উৎপাদিত রেণুর বৃদ্ধি ভালো হয় না। এটা মনে রাখা প্রয়োজন যে একজন সন্তান সম্ভাবা মায়ের যেমন আমরা যত্ন নিই তেমনি একটি মা মাছেরও (ব্রুডমাছ) সেরূপ যত্ন নিতে হবে।
উপসংহার একটি হ্যাচারির সফলতা, বিশেষ করে হ্যাচারির কলাকুশলিদের মাছ প্রজননে সফলতা ব্রুডমাছের স্বাস্থ্যের ওপর নির্ভর করে। ব্রুডমাছ ভালো থাকলে মাছের প্রজনন এবং রেণুর পরিচর্যা পর্যায়ে কোনো প্রকার সমস্যা দেখা দেয় না এবং নার্সারি পুকুরে রেণুর বাঁচার হার সর্বোচ্চ হয়। এর ফলে রেণু চাষি লাভবান হন এবং হ্যাচারির সুনাম বৃদ্ধি পায় ও মালিক লাভবান হতে পারেন। এজন্য যারা কার্প হ্যাচারির সাথে যুক্ত আছেন তাদের সকলকে ব্রুডমাছ প্রতিপালনের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
লেখক: কৃষিবিদ মোঃ তোফাজউদ্দীন আহমেদ সহকারী পরিচালক, মৎস্য অধিদপ্তর, মৎস্য ভবন, ঢাকা।