শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে
MD Khan

Call

মানুষের জীবন রক্ষা করা ইসলামি শরিয়তের পাঁচটি প্রধান উদ্দেশ্যের অন্যতম। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে একজন মানুষের জীবন রক্ষাকে সমগ্র মানবজাতির জীবন রক্ষার সঙ্গে তুলনা করেছেন। রাসুল (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে কুসংস্কার পরিহার করে চিকিৎসা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘সব রোগেরই আরোগ্য আছে।’

ইসলামি সভ্যতার সূচনা থেকে মুসলিম সমাজে চিকিৎসকদের বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। তবে চিকিৎসাসেবার সঙ্গে যেহেতু মানুষের জীবনের নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত, তাই ইসলাম চিকিৎসা ক্ষেত্রে কিছু বিধি-নিষেধও আরোপ করেছে। যাতে চিকিৎসকের স্বার্থ ও রোগীর সেবা পাওয়ার অধিকার সুসংহত হয়।

মুসলিম সমাজে চিকিৎসাবিদ্যা ও চিকিৎসক

ড. আলী আবদুল্লাহ সাহাল মুসলিম সমাজে চিকিৎসকদের মর্যাদা সম্পর্কে বলেন, ‘পেশা হিসেবে চিকিৎসা শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। কেননা তার বিষয় মানুষের জীবন, তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য স্বাস্থ্য সুরক্ষা, মানব প্রকৃতিকে শক্তিশালী করা ও রোগমুক্তি যা পৃথিবীতে মানব প্রেরণের উদ্দেশ্য (আল্লাহর দাসত্ব) পূরণে আবশ্যক। তা ছাড়া এই পেশার মাধ্যমে শরিয়তের অন্যতম ‘উদ্দেশ্য’ পূরণ হয়। সুতরাং তা কোরআনে বর্ণিত ‘ভালো কাজে পারস্পরিক সহযোগিতার অন্তর্ভুক্ত।’ (প্রবন্ধ : আখলাকুত তাবিবিল মুসলিম, পৃষ্ঠা : ৪-৫)

ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে ‘চিকিৎসাবিদ্যা’ অর্জন করা ‘ফরজে কিফায়া’ (সামষ্টিক অবশ্য করণীয়)। অর্থাৎ উম্মাহর একটি দলকে অবশ্যই সব সময় এই বিদ্যাচর্চায় থাকতে হবে। ইমাম নববি (রহ.) বলেন, ‘বুদ্ধিবৃত্তিক (ওহিনির্ভর নয় এমন) জ্ঞানগুলোর মধ্যে চিকিৎসা ও হিসাববিজ্ঞান ফরজে কিফায়া। কেননা, মানুষ তার মুখাপেক্ষী।’ (রাওদাতুত-তালিবিন ওয়া উমদাতুল মুফতিয়্যিন : ১০/২২৩)

ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলতেন, ‘আমি হালাল-হারাম সংক্রান্ত জ্ঞানের (ইসলামি আইনবিজ্ঞান) পর চিকিৎসার চেয়ে অভিজাত কোনো বিদ্যা সম্পর্কে জানি না।’ (সিয়ারু আলামিন-নুবালা, খ- : ১০, পৃষ্ঠা : ৫৭)

চিকিৎসকের মর্যাদাপূর্ণ পাঁচ বৈশিষ্ট্য

আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে জাকারিয়া আর রাজি চিকিৎসকদের মর্যাদা ও সম্মান বিষয়ে বলেন, চিকিৎসকরা এমন পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের অধিকারী যা আর কেউ অর্জন করতে পারেনি। তা হলো

১. পৃথিবীর সব জাতি ও সভ্যতা তাদের সম্মান ও মর্যাদার স্বীকৃতি দিয়েছে।

২. রাষ্ট্র ও ক্ষমতা তাদের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে নিয়েছে। যখন পরিবার-পরিজন ও সম্পদ কাজে আসে না, তখন তারা ত্রাণকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।

৩. মানুষের কল্যাণচেষ্টা থেকে তারা কখনো মুখ ফিরিয়ে নেননি।

৪. সব সময় মানুষের সুখ ও শান্তিকে অগ্রাধিকার দেন।

৫. তাদের নামটি (তাবিব) আল্লাহর গুণবাচক নাম থেকে নেওয়া। (আখলাকুত তাবিব, পৃষ্ঠা : ৮৭)

মুসলিম চিকিৎসকের দায়িত্ব

কোরআন ও হাদিসের আলোকে মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিকরা চিকিৎসকের কিছু বৈশিষ্ট্য নির্ণিত করেছেন। যার কয়েকটি হলো

১. বিশুদ্ধ নিয়ত : মুসলিম চিকিৎসক তার কাজে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সৃষ্টির সেবার নিয়ত করবেন। কেননা বিশুদ্ধ নিয়ত জাগতিক কাজকেও ইবাদতে পরিণত করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই নিয়তের ওপর সব কাজের ফলাফল নির্ভরশীল।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১)

২. বিশুদ্ধ বিশ্বাস : মুসলিম চিকিৎসক গভীরভাবে বিশ্বাস করেন তার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা, প্রযুক্তি ও প্রচেষ্টা উপলক্ষ মাত্র। রোগমুক্তি ও আরোগ্যের প্রকৃত ক্ষমতা আল্লাহর। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি যখন অসুস্থ হই তিনি আমাকে আরোগ্য দেন।’ (সুরা : আশ-শুআরা, আয়াত : ৮০)

৩. আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা : চিকিৎসক তার জ্ঞান, মর্যাদা ও মানবসেবার সুযোগের জন্য মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবেন। কেননা তা একান্তই আল্লাহর অনুগ্রহ। ইরশাদ হয়েছে, ‘...তুমি যা জানতে না তা তিনি তোমাকে শিখিয়েছেন এবং তোমার প্রতি রয়েছে আল্লাহর মহা অনুগ্রহ।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ১১৩)

৪. চিকিৎসায় যত্নবান : মুসলিম চিকিৎসক তার পেশাগত কাজে যত্নবান হবেন। কেননা আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘আল্লাহ পছন্দ করেন যে, তোমরা যখন কোনো কাজ করবে তাতে তোমরা যত্নবান হবে।’ (মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদিস : ১১১৩)

৫. রোগীর জীবন ঝুঁকিতে না ফেলা : মুসলিম চিকিৎসক নিজের অজ্ঞতা ও অনভিজ্ঞতা গোপন করে বা নতুন কোনো বিষয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য রোগীর জীবন ঝুঁকিতে ফেলবেন না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো রোগের চিকিৎসা করে, অথচ তার প্রতিষেধক তার জানা নেই সে দায়ী বলে গণ্য হবে।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৪৭৩০)

৬. রোগীর সঙ্গে কোমল আচরণ : রোগীর সঙ্গে চিকিৎসকের আচরণ হবে বন্ধুসুলভ। এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর কাছে নিজেকে চিকিৎসক হিসেবে পরিচয় দিলে তিনি বলেন, ‘চিকিৎসক আল্লাহ। তুমি বরং তার একজন বন্ধু (বা হিতাকাক্সক্ষী)। তার চিকিৎসক যে তাকে সৃষ্টি করেছেন।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৪২০৭)

৭. রোগীর প্রতি কল্যাণকামিতা : মুসলিম চিকিৎসক রোগীর প্রতি কল্যাণকামী হবেন। তিনি রোগীর জন্য সবচেয়ে উপকারী পরামর্শটি দেবেন। আল্লাহ বলেন, ‘যখন তোমাদের কেউ তার ভাইয়ের কাছে পরামর্শ চায়, সে যেন তাকে উত্তম পরামর্শ দেয়।’ (সহিহ বুখারি : ৩/৭২)

৮. রোগীর অসংযত আচরণে ধৈর্যের পরিচয় : মুসলিম চিকিৎসক রোগীর অসংযত আচরণ ও অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ধৈর্যের পরিচয় দেবেন; তার প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করবেন না। শায়খ আবু আবদুর রহমান সাকাল্লি (রহ.) বলেন, ‘সব অভিযোগ নিন্দনীয় কিন্তু তিনটি ব্যতিক্রম : শিক্ষার্থী যখন আলেমের কাছে না বোঝার অভিযোগ করে, মুরিদ যখন তার শায়খের কাছে অন্তরের ব্যাধির অভিযোগ করে এবং রোগী যখন চিকিৎসকের কাছে তার শারীরিক ব্যাধির অভিযোগ করে।’ (আল-মাদখাল লি-ইবনিল হজ : ৪/১৩৪)

৯. হারাম পরিহার করা : মুসলিম চিকিৎসক হারাম কাজ, পদ্ধতি ও প্রতিষেধক পরিহার করবেন যতক্ষণ না রোগীর জীবন বাঁচাতে বিকল্প খুঁজে না পাওয়া যায়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ রোগ ও আরোগ্য পাঠিয়েছেন। প্রত্যেক রোগের আরোগ্য রয়েছে; সুতরাং তোমরা চিকিৎসা গ্রহণ করো। হারাম দ্বারা চিকিৎসা কোরো না।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৩৮৭৪)

১০. নিজের ব্যাপারে সতর্ক থাকা : মুসলিম চিকিৎসক যেমন রোগীর সেবা করবেন, তেমনি তিনি নিজের ব্যাপারেও সতর্ক থাকবেন। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমার ওপর তোমার নিজেরও অধিকার রয়েছে।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ১৩৬৯)

অন্য হাদিসে তিনি সুস্থ ও অসুস্থের অসাবধান সংমিশ্রণের ব্যাপারে সতর্ক করে বলেছেন, ‘কেউ যেন কখনো রোগাক্রান্ত উট সুস্থ উটের সঙ্গে না রাখে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৭৭১)

চিকিৎসক যখন দাঈ হবেন

যেহেতু চিকিৎসাশাস্ত্রের সঙ্গে মানুষের জীবন ও জীবনের নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত, তাই প্রাজ্ঞ আলেমরা মুসলিম চিকিৎসকদের জন্য তিনটি মৌলিক লক্ষ্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন এবং তা পূরণের ক্ষেত্রে তিনটি কাজ বর্জনের নির্দেশ দিয়েছেন। যেন রোগী ক্ষতি থেকে এবং তারা আইনি জবাবদিহি থেকে রক্ষা পান।

প্রধান তিন লক্ষ্য : আল্লামা ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেন, ‘শারীরিক চিকিৎসার মূল ভিত্তি তিনটি : সুস্থতা রক্ষা, কষ্টকর বিষয় বা রোগ দূর করা এবং সুস্থতার জন্য হুমকি এমন বিষয় অপসারণ (অস্ত্রোপচার)।’ (জাদুল মাআদ : ৪/৫)

বর্জনীয় তিন কাজ : চিকিৎসাকাজের জন্য কোনো চিকিৎসককে দায়ী করতে হলে তার ব্যাপারে তিনটি অভিযোগ প্রমাণিত হতে হবে : এক. ইসলামি শরিয়ত ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রচলন ও রীতির সাপেক্ষে বাড়াবাড়ি করা, দুই. বিকল্প থাকার পরও ক্ষতিকর কোনো ওষুধ বা পদ্ধতি প্রয়োগ করা, তিন. পেশাগত দায়িত্ব পালনে অবহেলা। (তাকরিবু ফিকহিত-তাবিব, পৃষ্ঠা : ১০১)

আর কোনো চিকিৎসক যদি অজ্ঞ হন এবং তার দ্বারা মানুষের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ভয় থাকে, তবে এমন চিকিৎসককে প্রতিহত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। (প্রবন্ধ : ড. ফায়েক জাওহারি, আখতাউল আতিব্যা, পৃষ্ঠা : ৮)

সদাচরণ চিকিৎসকের প্রাপ্য

প্রখ্যাত মুসলিম চিকিৎসাবিজ্ঞানী আবু বকর রাজি সুচিকিৎসা লাভে রোগীর প্রতি তিনটি পরামর্শ দিয়েছেন। তা হলো, এক. নিজ শহরের একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ চিকিৎসককে নিজের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক চিকিৎসক হিসেবে গ্রহণ করা। দুই. চিকিৎসকের সঙ্গে সর্বোচ্চ সদাচরণ করা। তিন. চিকিৎসকের প্রতি আস্থা রাখা ও ধৈর্যের পরিচয় দেওয়া। অতঃপর তিনি বলেন, ‘এগুলো তোমাকে অল্প কষ্টে, দ্রুততম সময়ে সহজে আরোগ্য লাভে সহায়তা করবে।’ (আখলাকুত তাবিব, পৃষ্ঠা : ৩১-৩৩)

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ