ক্যালসিয়ামের অভাব কি?
ক্যালসিয়াম একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খনিজ। এটি শক্তিশালী হাড় এবং দাঁতের গঠনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। আমাদের শরীরে ৯৯ শতাংশ ক্যালসিয়াম শক্ত টিস্যু হিসেবে জমা হয়ে হাড় এবং দাঁতের আকার ধারণ করে। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ পরিপোষক, যা খুবই জরুরি কিছু গুরুত্বপূর্ণ শরীরের কার্যকারিতার জন্য, যেমন স্নায়ুর মাধ্যমে বার্তা প্রেরণ, হরমোন ক্ষরণ, রক্ত বাহিকা ও পেশীর সংকোচন ও সম্প্রসারণ, আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল যে ক্যালসিয়াম কঙ্কাল কার্যকারিতায় সাহায্য করে।
আমরা অনেকে ক্যালসিয়ামের অভাব হাড়ে হাড়ে টের পাই। সিঁড়ি ভাঙতে গেলে, একটু হাঁটাহাটি করতে গেলে কুঁকড়ে উঠি ব্যথায়, পা আর চলে না। আবার এই হাড়ের যত্নের ক্ষেত্রে অধিকাংশ মানুষই হয় খুব উদাসীন! যার ফলে হরহামেশা দেখা দেয় ক্যালসিয়াম অভাবজনিত রোগব্যাধি।
ক্যালসিয়ামের অভাব হাইপোক্যালসেমিয়া নামেও পরিচিত। চিকিৎসা না করানো দীর্ঘস্থায়ী হাইপোক্যালসেমিয়া হাড় পাতলা হয়ে যাওয়া (অস্টিওপেনিয়া), বাচ্চাদের মধ্যে দুর্বল হাড় (রিকেটস) আর হাড়ের ঘনত্ব অত্যধিক কমে যাওয়া (অস্টিয়োপোরোসিস)-র মতো জটিলতা বাড়িয়ে তোলে। ক্যালসিয়ামের অভাবের ব্যাপারে সবচেয়ে ভালো কথা হল যে খাদ্যাভাসে পরিবর্তন এনে এটা খুব সহজেই সারানো যায়।
ক্যালসিয়ামের অভাবের প্রধান লক্ষণ এবং কারণগুলি কি কি?
শুরুতে, ক্যালসিয়ামের অভাব চেনা খুবই কঠিন। কিন্তু, অবস্থা বাড়তে শুরু করলে কিছু নির্দিষ্ট লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
শুরুর দিকের লক্ষণ হল:
- আঙুল, হাত এবং পায়ে অসাড় ও ঝিনঝিনেভাব
- পেশীতে খিঁচুনি এবং আড়ষ্ঠভাব
- আলস্য এবং প্রচণ্ড ক্লান্তি অনুভব।
দীর্ঘস্থায়ী ক্যালসিয়ামের অভাব শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষতি করতে পারে। পরবর্তী পর্যায়ের লক্ষণ হল:
- অস্টিওপেনিয়া এবং অস্টিওপোরোসিস - হাড় ভাঙার প্রবণতা
- দাঁতের সমস্যা - দাঁত এবং অ্যানামেলের হাইপোলাসিয়া, ভোঁতাভাবে দাঁতের গোড়ার বিকাশ এবং দেরি করে দাঁত ওঠা
- দুর্বল এবং ভঙ্গুর নখ
- শুষ্ক এবং চুলকুনিযুক্ত ত্বক- একজিমা
- হতাশা এবং বিভ্রান্তিবোধ
- দুর্বল ক্ষুধাভাব
- অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন
- রক্ত তঞ্চনে দেরি।
ক্যালসিয়ামের অভাবের প্রধান কারণগুলি কি কি?
একজন প্রাপ্তবয়ষ্কের দিনে অন্তত ৭শত মিলিগ্রাম এবং একজন বয়ষ্কদের দিনে ১২শত মিলিগ্রাম ক্য়ালসিয়াম প্রয়োজন। ক্যালসিয়ামের ঘাটতির মূল কারণ হ’ল ডায়েটে ক্যালসিয়াম গ্রহণ না করা। ক্যালসিয়ামের অভাবের কিছু সাধারণ কারণ হল:
- খুব খারাপভাবে খাদ্য গ্রহণ
- পাচনতন্ত্রের ব্যাধির জন্য ঠিক করে হজম না হওয়া, যেমন সেলিয়াক রোগ
- হাইপোপ্যারাথাইরয়েডিজম
- ম্যাগনেসিয়ামের উচ্চ অথবা স্বল্প মাত্রা
- ফসফেটের উচ্চ-মাত্রা
- যেসব ব্যক্তি ফেনিটইন, ফেনোবার্বিটাল, রিফামপিন, কর্টিকস্টেরয়েড এবং কেমোথেরাপির ওষুধ নেন
- সেপ্টিক শক
- কিডনি বিকলতা
- প্যানক্রিয়াটাইটিস
- ভিটামিন ডি’র স্বল্প মাত্রা।
- অতিরিক্ত ব্যায়াম করলে শরীরে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি পড়ে।
- প্রচুর পরিমাণে কোমল পানীয় পান করলে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি হয়।
- শরীর দুর্বল হলে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি দেখা দেয়।
- ক্রীড়াবিদ নারীদের মেনোপজের সময় বেশি ক্যালসিয়াম ক্ষয় হয়।
- এছাড়াও অতিরিক্ত মেদ, চিনিযুক্ত খাবার, প্রোটিন ডায়েট ক্যালসিয়ামের ঘাটতি সৃষ্টি করে।
- অ্যালকোহল, তামাক, অতিরিক্ত লবণ সেবনের ফলে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি হয়।
যাদের ক্যালসিয়ামের অভাব হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে:
- মহিলা, বিশেষ করে ঋতুবন্ধার পর
- বয়স্ক ব্যক্তি
- কিশোর বা কিশোরী
- যাদের ল্যাক্টোজ ইনটলারেন্স রয়েছে এমন ব্যক্তি।
ক্যালসিয়ামের অভাব কিভাবে নির্ণয় এবং চিকিৎসা করা হয়?
ডাক্তার প্রথমে রোগীর মূল্যায়ন করেন ক্লিনিকাল উপস্থাপনা এবং লক্ষণাবলির ওপর ভিত্তি করে। পরের পদক্ষেপ হল ক্লিনিকাল লক্ষণগুলি নিশ্চিত করা আর তার জন্য প্যাথোলজিকাল পরীক্ষা করা, যার মধ্যে রয়েছে সিরাম ক্যালসিয়াম, প্যারাথাইরয়েড হরমোন, সিরাম ফস্ফেট, ম্যাগনেসিয়াম, ২৫-হাইড্রোক্সিভিটামিন ডি এবং ১, ২৫ ডাইহাইড্রক্সি ভিটামিন ডি’র মাত্রা পরীক্ষা। ডাক্তার হয়তো আপনাকে ক্যালসিয়াম-সেনসিং রিসেপ্টরের জি প্রোটিন সাবিউনিট অ্যালফা ১১-র জেনেটিক মিউটেশনের পরীক্ষা করাতে বলতে পারেন।
ক্যালসিয়ামে সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া শুধু হাইপোক্যালসেমিয়াই সারিয়ে তুলবে তা নয় আবার এই পরিস্থিতি উৎপন্ন হওয়ার থেকেও প্রতিরোধও করবে। ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ উৎসগুলি হলো-
- দুধ এবং দুগ্ধ জাতীয় অন্যান্য দ্রব্য - চিজ, দই, ছানা এবং পনির
- শাকসব্জি - পালং শাক, ব্রোকোলি, কলাই জাতীয় - বিনস এবং মটরশুঁটি
- ফর্টিফায়েড খাদ্যশস্য, আস্ত শস্যদানা
- ক্যালসিয়ামে সমৃদ্ধ মিনারেল পানি
- সামুদ্রিক খাবার, চর্বিহীন মাংস এবং ডিম
- বাদাম, বীজ, সোয়ার দ্রব্য- তোফু।
ক্যালসিয়ামের সম্পূরক যেটা ডাক্তার লিখে দেন, তাও ক্যালসিয়ামের মাত্রা ঠিক করতে পারে।
নিজে চিকিৎসা করা এড়ানো
- উচ্চ-মাত্রায় ক্যালসিয়াম গ্রহণ এড়ানো - কারণ শরীরের ওজনের ভিত্তিতে মাত্রা ঠিক করা হয়। উচ্চ-মাত্রা ডাইজক্সিন টক্সিসিটির কারণ হতে পারে। মনে রাখবেন, ক্যালসিয়ামের অভাব রাতারাতি হয় না আর তাই সারতে সময় লাগবে।
- ক্যালসিয়ামের সম্পূরক অন্য নির্দিষ্ট ওষুধের সাথে মিথস্ক্রিয়া করতে পারে - রক্ত চাপ এবং কোলেস্টেরল হ্রাসকারী ওষুধ, অ্যান্টিবায়োটিক্স- টেট্রাসাইক্লিন্স এবং ফ্লুরোকিনোলোন্স।
- এর সাথে, ক্যালসিয়ামের ইনজেকশন দরকার হতে পারে ব্যক্তির অবস্থার ওপর নির্ভর করে। প্রবলতার ওপর নির্ভর করে হয়তো এক মাস থেকে ছয় মাস লাগতে পারে সম্পূর্ণভাবে হাইপোক্যালসেমিয়া সারতে এক থেকে ছয় মাস লাগতে পারে।
বাজারে প্রচুর পরিপূরক পাওয়া যায় তবে এটি নির্বাচন করা খুব কঠিন। আবার অতিরিক্ত মাত্রায় সাপ্লিমেন্ট গ্রহণে কিডনিতে পাথর হতে পারে।
এছাড়াও ক্যালসিয়ামের ঘাটতি রোধ করতে জীবনযাপনে পরিবর্তন আনা জরুরি। আপনার ডায়েটে চিজ বা পনির ব্যবহার করুন।
ভিটামিন ডি পেতে সকালে রোদে হাঁটুন ও ডায়েটে ভিটামিন ডি রাখুন। লবণ কম খান। ধূমপানের অভ্যাস ত্যাগ করুন। ক্যালসিয়াম বাড়াতে পালং শাক, ব্রোকোলি, পনির ও ডুমুর রস পান করুন।