২০১০ সালে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের শত বছর পূর্ণ হলেও বাংলাদেশে নারীরা নানা রকম হিংস্রতা, বর্বরতা, পৈশাচিকতা, নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এসব নির্যাতনের মধ্যে এসিড ছুড়ে নির্যাতন বর্বরতম অপরাধ। এসিড সহজে পাওয়া যায়_এ কারণে এই অপরাধ দিন দিন বাড়ছে। কিছু ক্ষেত্রে শিশু ও পুরুষরাও এসিড-সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছে। এসিড নিক্ষেপে শরীর বিশেষ করে মুখ বিকৃত হয়। যথাযথ চিকিৎসা হলেও ক্ষত থেকে মুক্তি পায় না এসিড-সন্ত্রাসের শিকার মানুষগুলো। নিকষ কালো ছায়ায় ঢেকে যায় একটি জীবন। বিপর্যয়ের কবলে পড়ে এসিড-সন্ত্রাসের শিকার পরিবারগুলো। এসিড-সন্ত্রাস জাতির জন্য অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। এসিড সারভাইভরস ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী ১৯৯৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ১২ বছরে দেশে মোট এসিড-সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন প্রায় আড়াই হাজার। অথচ ১২ বছরে এই আড়াই হাজার মুখ ঝলসে গেলেও আইন অনুযায়ী এখন পর্যন্ত কোনো আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়নি। ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে এসিড-সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন প্রায় ৯৩ জন। এদের মধ্যে অধিকাংশ নারী ও কিশোরী। প্রতি মাসে গড়ে ১০ জন নারীর মুখ ঝলসে যাচ্ছে। এসিড-সন্ত্রাসের কারণ : আমাদের দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পারিবারিক কলহ, বিয়ে, প্রেম বা কুপ্রস্তাবে রাজি না হওয়া, যৌতুকের দাবি মেনে না নেওয়া, সম্পত্তি নিয়ে শত্রুতা ইত্যাদি কারণেই এসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটছে। যৌতুকের দাবি আদায়ে ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে স্বামী কর্তৃক অসংখ্য নারী শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়, শারীরিকভাবে নির্যাতনের পরও এসিড নিক্ষেপের শিকার হয়। এসিড-সন্ত্রাসের আইনগত প্রতিকার : এসিড-সন্ত্রাস প্রতিরোধে দুটি আইন রয়েছে : এক. এসিডের আমদানি, উৎপাদন, পরিবহন, মজুদ, বিক্রয় ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ, ক্ষয়কারী দাহ্য পদার্থ হিসেবে এসিডের অপব্যবহার রোধ এবং এসিড দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা, পুনর্বাসন এবং আইনগত সহায়তা প্রদানের জন্য এসিড নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০২ (২০০২ সালের ১ নম্বর আইন), যা ২০০৬ সালে সংশোধন করা হয়েছে এবং দুই. এসিড নিক্ষেপজনিত অপরাধগুলো নির্মূল করার লক্ষ্যে এসিড অপরাধ দমন আইন, ২০০২ (২০০২ সালের ২ নম্বর আইন) প্রণয়ন করা হয়েছে। এ দুটি আইন ছাড়াও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)-এ এর প্রতিকার পাওয়া সম্ভব। এসিড অপরাধ দমন আইন, ২০০২-এর ৪ ধারায় এসিড দ্বারা মৃত্যু ঘটানোর শাস্তির বিধান আছে_মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং অনূর্ধ্ব এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। ৫ ধারায় এসিড দ্বারা আহত করার শাস্তির বিধান আছে, যা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)-এর ৪ ধারার অনুরূপ। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৪ (১) ধারা অনুযায়ী এসিড বা অন্য কোনো দহনকারী বা ক্ষয়কারী পদার্থ দ্বারা কোনো শিশু বা নারীর মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা করলে তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং তার সঙ্গে অনূর্ধ্ব এক লাখ টাকা জরিমানা। ৪(২) ধারা অনুযায়ী এসিড নিক্ষেপের ফলে কোনো শিশু বা নারীর দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি বা কোনো অঙ্গ নষ্ট হয়ে গেলে ওই নিক্ষেপকারী ব্যক্তির শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা জরিমানা। আর শরীরের অন্য কোনো অঙ্গ, গ্রন্থি বা অংশ বিকৃত বা নষ্ট হয়ে গেলে ওই নিক্ষেপকারী ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১৪ বছর; কিন্তু সর্বনিম্ন সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং তাকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। ৪(২) ধারা অনুযায়ী এসিড নিক্ষেপের চেষ্টা করাও একটি কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যদি কোনো ব্যক্তি এসিড বা দহনকারী পদার্থ কোনো শিশু বা নারীর ওপর নিক্ষেপ করে বা নিক্ষেপের চেষ্টা করে, তবে ওই নারী বা শিশুর শারীরিক, মানসিক বা অন্য কোনো ক্ষতি না হলেও নিক্ষেপকারী ব্যক্তির সর্বোচ্চ শাস্তি সাত বছর; কিন্তু সর্বনিম্ন তিন বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং অনূর্ধ্ব ৫০ হাজার টাকা জরিমানা। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচার : ২০০২ সালের এসিড অপরাধ দমন আইনের ১৬ ধারায় এসিড অপরাধের জন্য পৃথক বিচারপদ্ধতির বিধান আছে। ২৩ ধারা মোতাবেক এসিড অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল নামে বিশেষ আদালত গঠন করা হয়েছে। বিচারের জন্য মামলাপ্রাপ্তির তারিখ থেকে ১৮০ দিনের মধ্যে ট্রাইব্যুনাল বিচারের কাজ শেষ করবেন। এমনকি এই আইন অনুযায়ী, পুলিশ যদি অভিযোগ গ্রহণ না করে সে ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল সরাসরি বিচারের জন্য অভিযোগ নিতে পারেন। এ বিধানটি যদি বাস্তবে প্রয়োগ করা হয়, তবে জনগণের অভিযোগ করা অনেক সহজ হবে। বিচারের বাস্তব চিত্র : বাস্তবে আইনি প্রতিকারের চিত্র অত্যন্ত উদ্বেগজনক। মামলা দায়ের ও পরিচালনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের জটিলতা রয়েছে। এমনকি অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অপরাধ প্রমাণের পর শাস্তি প্রদান হলেও তা কার্যকর হয় না। অপরাধীদের প্রভাব-প্রতিপত্তি, রাজনৈতিক শক্তির ছত্রচ্ছায়া, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তার দায়িত্ব পালনে অবহেলা, আইনজীবীদের আইনগত সহায়তা প্রদান না করা ইত্যাদি কারণে অপরাধীরা অশুভ শক্তির বিস্তার করে ক্রমবর্ধমান নির্যাতনের উৎকট রূপ প্রকাশ করছে। এ ছাড়া এসিডের সহজলভ্যতা এ ধরনের অপরাধীদের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে সহায়তা করছে। যদিও ২০০২ সালে এসিড নিয়ন্ত্রণ আইন (সংশোধিত ২০০৬) করা হয়েছে, তবুও খুব সহজেই মিলছে এসিড। এসিড বেচাকেনা নিয়ন্ত্রণে আইনের কঠোর প্রয়োগে এ অপরাধ কিছুটা কম হতো। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে এই আইনের কার্যকারিতা তেমন নেই বললেই চলে। এসিড-সন্ত্রাস মোকাবিলায় সামাজিক প্রতিরোধ : সব শ্রেণীর মানুষের কাছে এসিড-সন্ত্রাস এখন যেমন খুব পরিচিত শব্দ, তেমনি এটি একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়। এসিড নিক্ষেপের মতো একটি সামাজিক ব্যাধি সহজেই নির্মূল হবে না। তাই আইনের বাস্তবায়নের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতারও প্রয়োজন। নারীর প্রতি সহিংসতা, বর্বরতা, পৈশাচিকতা রোধে সম্মিলিতভাবে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার পাশাপাশি আইনি প্রতিকারের কঠোর কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। * এ ক্ষেত্রে পরিবার হচ্ছে সর্বপ্রথম ও প্রধান ভিত্তি স্তর, যেখান থেকে একটি শিশু সম্পূর্ণ মানুষরূপে গড়ে ওঠে। পরিবারে একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, সম্মান ও মর্যাদার মনোভাব নিয়ে বেড়ে না উঠলে এর নেতিবাচক প্রভাব পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে পড়বেই। পরিবারে যদি ছেলেদের নৈতিক শিক্ষা দেওয়া যায়, তবেই পরিবর্তন আশা করা যায়। শিশুর বেড়ে ওঠা ও সামাজিকীকরণের মধ্যেই নারীর প্রতি এই বিদ্বেষ ও সহিংস মনোভাব আত্মস্থ হয়ে পড়ে এবং তা ছেলেশিশুর ব্যক্তিত্বের অংশে পরিণত হয়। ঘরের ভেতরের পুরুষ চরিত্রের ধর্মবিহীন রূঢ় আচরণ বা নারীদের অপমান করার চিত্র পরবর্তী সময়ে ছেলেশিশুটিও আশপাশের কম শক্তিধর মানুষকে হেয় করার মানসিকতা নিয়ে বড় হতে থাকে। যে ছেলেটি মেয়েদের প্রতি বিকৃত রুচির পরিচয় দেয়, তার বিরুদ্ধে অভিভাবককে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। * স্কুল, কলেজ ও অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়ালেখার পাশাপাশি সমান গুরুত্ব দিয়ে তাদের মধ্যে নৈতিকতাবোধ এবং সহপাঠীদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তৈরি করে দিতে হবে। সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য তার যে দায়িত্ব বা ভূমিকা, তা তাকে বোঝাতে হবে। এসিড নিক্ষেপের ফলে একটি জীবন ও পরিবারের নির্মম পরিণতি তাদের জানাতে হবে। সব পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত হলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিত, নৈতিক মূল্যবোধ গঠনে তা সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। * পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর বেড়ে ওঠা ও সামাজিকীকরণ ঘটে নাজুকতার মধ্য দিয়ে এর সুযোগ নেয় অপরাধীরা। সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সব মানুষের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। রাষ্ট্র ও সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই এ সমস্যা প্রতিহত করা সম্ভব হবে। * এসিড-সন্ত্রাসের শিকার হলে সহজেই যাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার সাহায্য নেওয়া যায়, এ জন্য পর্যাপ্ত হেলপ লাইন থাকতে হবে। তবে যাদের বিরুদ্ধে নালিশ করা হবে, তাদের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিচয় তথা ক্ষমতার দাপট যদি প্রবল হয়, তাহলে অনেক ক্ষেত্রে পরবর্তী অবস্থা সামলানো একজন ভিকটিমের জন্য কঠিন হয়ে ওঠে। এ কারণে অনেকে বিষয়টি নীরবে সহ্য করে যায়। তাই সামাজিকভাবে জোরালো ঐকমত্য সৃষ্টি করা দরকার, যাতে কোনো অভিভাবক, ক্ষমতাধর ব্যক্তি, কোনো কর্তৃপক্ষ যেন এসিড নিক্ষেপকারীদের প্রশ্রয় না দেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের প্রচেষ্টা ধারাবাহিকভাবে কার্যকর থাকলে এ ধরনের অপরাধ একসময় নির্মূল হয়ে যাবে আশা করা যায়। এ ছাড়া দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হলে পরবর্তী সময়ে অন্য অপরাধীদের দৌরাত্ম্য কমে আসবে। * নারীদের বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন থেকে রক্ষার জন্য যত ধরনের আইন করা হয়েছে, তা থেকে নারীরা কতটা সুফল পাচ্ছে_এ বিষয়টি নতুন করে ভাবা প্রয়োজন। তাই নারীর প্রতি নির্যাতন রোধে যেসব আইন আছে, তা বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রচলিত আইনের সঠিক ও কঠোর প্রয়োগ সুনিশ্চিত করতে হবে। লেখক : সহকারী অধ্যাপক (আইন) বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ