(সংকেত: ভূমিকা; চাদের পরিচয়; চাদ নিয়ে গবেষণা; চন্দ্র বিজয়; উপসংহার।)

 

ভূমিকা:

চন্দ্র বিজয় মানব সভ্যতার অন্যতম ঐতিহাসিক ঘটনা। চাঁদ পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ। সৃষ্টির পর থেকেই চাঁদ পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। তাই চাঁদকে নিয়ে মানুষের আগ্রহ সেই প্রাচীনকাল থেকেই। চাঁদ সম্পর্কে সেসময়ের মানুষ তেমন কিছুই জানতো না। তারপর মানুষ দিনে দিনে সভ্য হয়েছে। মিসরীয়, গ্রিক, রোমান, আসিরীয় এবং অন্যান্য সভ্যতায় চাঁদ বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। তবে মানব সভ্যতার ইতিহাসে ১৯৬৯ সালটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এই বছরের ২০ জুলাই সমগ্র বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে সর্ব প্রথম চন্দ্রে মানুষের অবতারণা ঘটে। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসা’র মহাকাশ যান এপোলো-১১তে চড়ে এদিন প্রথম মানুষ হিসেবে চাঁদে পদার্পণ করেন নীল আর্মস্টং।

 

চাঁদের পরিচয়:

চাঁদ পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ এবং সৌরজগতের পঞ্চম বৃহৎ উপগ্রহ। পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে চাঁদের কেন্দ্রের গড় দূরত্ব হচ্ছে ৩৮৪,৪০৩ কিলোমিটার (২৩৮,৮৫৭ মাইল) যা পৃথিবীর ব্যাসের প্রায় ৩০ গুণ। চাঁদের ব্যাস ৩,৪৭৪ কিলোমিটার (২,১৫৯ মাইল) যা পৃথিবীর ব্যাসের এক-চতুর্থাংশের চেয়ে সামান্য বেশি। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, চাঁদের আয়তন পৃথিবীর আয়তনের ৫০ ভাগের ১ ভাগ। এর পৃষ্ঠে অভিকর্ষ বল পৃথিবী পৃষ্ঠে অভিকর্ষ বলের এক ষষ্ঠাংশ। পৃথিবী পৃষ্ঠে কারও ওজন যদি ১২০ পাউন্ড হয় তা হলে চাঁদের পৃষ্ঠে তার ওজন হবে মাত্র ২০ পাউন্ড। এটি প্রতি ২৭.৩ দিনে পৃথিবীর চারদিকে পূর্ণ আবর্তন সম্পন্ন করে। প্রতি ২৯.৫ দিন পরপর চন্দ্র কলা ফিরে আসে অর্থাৎ একই কার্যক্রিয়া আবার ঘটে। পৃথিবী চাঁদ-সূর্য তন্ত্রের জ্যামিতিতে পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তনের কারণেই চন্দ্র কলার এই পর্যানুক্রমিক আবর্তন ঘটে থাকে। চাঁদের আকর্ষণে পৃথিবীতে জোয়ার-ভাটা হয়ে থাকে।

 

চাঁদ নিয়ে গবেষণা:

চাঁদ নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণার শুরু খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। ১৬০৯ সালে বিজ্ঞানী গ্যালিলিও সে যুগের তুলনায় মোটামুটি উন্নত একটি টেলিস্কোপ আবিষ্কার করেন। তার উদ্ভাবিত এই টেলিস্কোপ দিয়ে তিনি প্রথম চাঁদের পৃষ্ঠতল দেখতে পান। এটাই আসলে চাঁদ নিয়ে সর্বজন স্বীকৃত বৈজ্ঞানিক গবেষণার শুরু। গ্যালিলিওর পরবর্তীকালের বিজ্ঞানীরা চাঁদ নিয়ে আরও গবেষণা করেন। এদিকে পৃথিবীর এই উপগ্রহকে নিয়ে কবি সাহিত্যিক বা সঙ্গীত শিল্পীদেরও আগ্রহ দেখা যায়। চাঁদ বা চাঁদে অভিযান নিয়ে কল্পকাহিনী লিখেছেন অনেক লেখক। এ প্রসঙ্গে জুলভার্নের কথা চলে আসে প্রথমেই। জুলভার্নের আগে অনেকেই চাঁদে অভিযান নিয়ে লিখেছেন। কিন্তু সাধারণ পাঠকের হৃদয় জয় কতে পেরেছিলেন তিনি। ১৮৫৬ সালে তার লেখা ‘ফ্রম দি আর্থ টু দি মুন’ নামের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী প্রকাশিত হবার পর সাধারণ পাঠক অনেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করেন চাঁদে যাওয়া সম্ভব। এদিকে সত্যিকারভাবে চাঁদে প্রথম অভিযান শুরু করে আসলে রাশিয়া। শুধু তাই নয় পৃথিবীর বাইরে প্রথম প্রাণী (লাইকা নামের একটা কুকুর), প্রথম পুরুষ নভোচারী (ইউরি গ্যাগারিন), প্রথম নারী নভোচারী (ভ্যালেন্তিনা তেরেশকোভা) পাঠানোর কৃতিত্বও তাদের। এতসব অর্জনের পর তারা ১৯৫৬ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর লুনার-২ নামের একটি নভোযান পাঠায় চাঁদের উদ্দেশে। এ নভোযান চাঁদের চারিদিকে প্রদক্ষিণ করে চাঁদের উল্টো পৃষ্ঠের ছবি তুলতে সক্ষম হয়। মূলত তারপর থেকেই চাঁদের বুকে মানুষ পাঠাতে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় রাশিয়া ও আমেরিকার মধ্যে। কিন্তু রাশিয়ার মহাকাশ অভিযান নিয়ে অনেক অর্জন থাকলেও চাঁদের বুকে প্রথম মানুষ পাঠানোর প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয় আমেরিকা।

 

চন্দ্র বিজয়:

২০ জুলাই চাঁদের বুকে নীল আর্মস্ট্রং নামলেও তারা পৃথিবী থেকে যাত্রা শুরু করেন ১৬ জুলাই ১৯৬৯ অ্যাপোলো-১১ নামের রকেটে চেপে। এই অভিযানে কমান্ডার নীল আর্মস্ট্রংয়ের সহযাত্রী ছিলেন মাইকেল কলিন্স ও এডউইন অলড্রিন। অ্যাপোলো-১১ এর দু’টি অংশ ছিলো-একটি কমান্ড মডিউল, যার নাম রাখা হয়েছিলো কলাম্বিয়া। এই নামটি জুলভার্নের বিখ্যাত কল্পকাহিনী ‘ফ্রম দি আর্থ টু দি মুন’ থেকে নেয়া হয়েছিলো। অন্যদিকে লুনার মডিউল, যার নাম ছিলো ঈগল। কমান্ড মডিউল কলাম্বিয়ার পাইলট ছিলেন মাইকেল কলিন্স এবং লুনার মডিউল ঈগলের পাইলট ছিলেন এডউইন অলড্রিন। ১৯৬৯ সালের ১৬ জুলাই কমান্ডার নীল আর্মস্ট্রংয়ের নেতৃত্বে লুনার মডিউল পাইলট এডউইন অলড্রিন এবং কমান্ড মডিউল পাইলট মাইকেল কলিন্স যখন চাঁদের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন, ঠিক তখন স্থানীয় সময় সকাল ৯টা বেজে ৩২ মিনিট। অভিযানের নাম রাখা হয় অ্যাপোলো-১১।নাসার কেনেডি স্পেস সেন্টারের চারপাশে তখন হাজার হাজার উৎসাহী মানুষের ভিড়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই রকেট পৃথিবীর কক্ষপথে পৌঁছে গেল। ততক্ষণে কেটেছে মাত্র বার মিনিট। এর পরই শুরু হলো মূল অভিযান, চাঁদের অভিমুখে যাত্রা। চারদিকে নিকষ কালো অন্ধকার ভেদ কর রকেট ছুটে চললো চাঁদের দিকে। বাইরে তখন বিশাল শূন্যতা। দীর্ঘযাত্রা শেষে ১৯ জুলাই অ্যাপোলো-১১ চাঁদের কক্ষপথে প্রবেশ করলো। আগেই ঠিক করা ছিল চন্দ্রযানের প্রথম অংশ কমান্ড মডিউল চাঁদের কক্ষপথে থাকবে কিন্তু চাঁদের মাটিতে নামবে না। অপর অংশ লুনার মডিউল নামবে চাঁদের মাটিতে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পাখির নাম ঈগল। চাঁদের বুকে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পাখি অবতরণ করছে, অনেকটা এমন ধারণা থেকেই লুনার মডিউলের নাম ঈগল রাখা হয়। ২০ জুলাই লুনার মডিউল ঈগল কলাম্বিয়া থেকে পৃথক হয়ে নীল আর্মস্ট্রং এবং এডউইন অলড্রিনকে নিয়ে চাঁদের দিকে রওনা করে। কমান্ড মডিউল কলাম্বিয়ায় থেকে যান মাইকেল কলিন্স। ঈগলের নেভিগেশন ও গাইডের কম্পিউটার স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঈগলকে চাঁদে অবতরণ করানোর দায়িত্বে ছিল।আমেরিকার স্থানীয় সময় রাত ১০টা ৫৬ মিনিটে ঈগল থেকে প্রথমে চাঁদের বুকে পা রাখেন মিশন অধিনায়ক নীল আর্মস্ট্রং। বিভিন্ন রকম শিলা সংগ্রহ করলেন, অসংখ্য ছবি তুললেন নীল আর্মস্ট্রং। চাঁদে নামার সাড়ে ছয় ঘণ্টা পর অলড্রিনও নেমে আসেন। তিনিও ছবি তোলা, শিলা সংগ্রহ ইত্যাদি করে আড়াই ঘণ্টা পার করার পর এলো ফিরে যাবার সময়। অলড্রিনই প্রথম ঈগলে প্রবেশ করেন, তাকে অনুসরণ করেন আর্মস্ট্রং। তবে ঈগলে ওঠার আগে দু’জনেই দুই ব্যাগে করে নিয়ে নেন সাড়ে একুশ কেজি ধুলো-বালি, পাথর ইত্যাদি। চাঁদের অতিথিরা চাঁদ থেকে শুধু নিয়েই আসেননি, দিয়েও এসেছেন। তার মধ্যে রয়েছে কিছু বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি, আমেরিকার পতাকা, পৃথিবীর পূর্ব ও পশ্চিম গোলার্ধের মানচিত্র, একটি সিলিকন মেসেজ ডিস্ক যার মধ্যে রেকর্ড করা আছে পৃথিবীর ৭৩টি দেশের প্রধানসহ আমেরিকার কয়েক প্রেসিডেন্টের বাণী। ২৪ জুলাই ১৯৬৯, চন্দ্র বিজয়ীরা পৃথিবীতে ফিরে আসেন। ওয়েক দ্বীপ থেকে প্রায় ২৬৬০ কিলোমিটার পূর্বে সাগরে অবতরণ করেন তারা। উদ্ধারকারী জাহাজ মার্কিন বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস হর্নেট তাদের অবতরণ স্থল থেকে ২৪ কিলোমিটার দূরে ছিলো। হেলিকপ্টারের সাহায্যে তাদের ইউএসএস হর্নেটে নিয়ে আসা হয়। এর মধ্য দিয়েই শেষ হয় মানুষের প্রথম চন্দ্র অভিযান। সেই বিশেষ মুহূর্ত সম্পর্কে নীল আর্মস্ট্রং স্বয়ং বলেছিলেন, ‘এটা (চাঁদে পা রাখা) একজন মানুষের জন্য ছোট্ট একটা পদক্ষেপ হলেও মানবসভ্যতার জন্য অনেক বড় একটা পদক্ষেপ।’

 

উপসংহার:

চাঁদ নিয়ে বা চাঁদে অভিযান নিয়ে এখনো শেষ কথা বলার সময় আসেনি। পৃথিবীর একদম কাছের উপগ্রহ হলেও চাঁদের রহস্য জাল ছিঁড়তে শুরু করছে গত শতাব্দী থেকে, যার অধিকাংশই এখনো রহস্যাবৃত। গল্প-কবিতা কিংবা রূপকথার চাঁদে যে একদিন মানুষের পায়ের চিহ্ন অংকিত হবে তা ছিল স্বপ্নেরও অতীত। সকল রহস্য আর অসম্ভবের জাল ছিন্ন করে পৃথিবীর মানুষ চাঁদে পা রেখেছে, জয় করেছে যোজন যোজন মাইল দূরের চাঁদকে। এদিকে সম্প্রতি চীন, জাপান, ভারতসহ আরও কয়েকটি দেশ নতুন করে চাঁদে অভিযান ও চাঁদ নিয়ে গবেষণা শুরু করেছে। এর সাথে যোগ দিয়েছে পূর্বেকার মহাকাশ বিজয়ী দেশ রাশিয়া ও আমেরিকা। তাই নিশ্চিতভাবেই বলা যায় চাঁদ নিয়ে আরও অনেক কথা অপেক্ষা করছে আমাদের সামনের দিনগুলোতে।


শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে