গরু ছাড়া অন্য প্রাণীর মাংস খেতে হিন্দু শাস্ত্রে কোনো বাধা নেই।

শুক্লযজুর্বেদ এর ১৩ অধ্যায়ের ৪৯ নং শ্লোকের প্রথম অংশে বলা আছে,

“ইমং সাহস্রং শতধারমুৎসং ব্যচ্যমানং সরিরস্য মধ্যে ঘৃতং দুহানামদিতিং জনায়াগ্নে মা হিংসীঃ পরমে ব্যোমন্।”

এর অর্থ হলো- উৎকৃষ্ট স্থানে স্থিত এ গোরূপ পশুকে হিংসা করো না, এ গাভী সহস্র উপকারক্ষম, শত সংখ্যক ক্ষীরধারাযুক্ত, উৎসের মতো বহু স্রোতযুক্ত, বহু লোকের উপজীব্য ও তাদের জন্য ঘৃতের কারণ দুগ্ধক্ষরণকারী এবং অদীনা।

এখানের ‘অদীনা’ শব্দটি স্ত্রীলিঙ্গ এবং এর অর্থ হলো- যে গরীব নয়।

এই শ্লোকে, স্পষ্টভাবে গরুকে হিংসা করতে অর্থাৎ তাকে হত্যা করতে নিষেধ করা হয়েছে এবং গরু যে সবচেয়ে উপকারী প্রাণী সে কথাও বলা হয়েছে এবং এই শ্লোকেরই আগে পরে বলে দেওয়া হয়েছে কোন কোন পশুর মাংস খাওয়া যাবে। যেমন- ১৩/৪৭ নং শ্লোকে বলা হয়েছে,

“যদি খাবার ইচ্ছা হয় তাহলে শুদ্ধ কিম্পুরূপ পশু ভক্ষণ করো, তা দিয়ে তোমার জ্বালারূপ তনু পুষ্ট করে এখানে থাকো।”

এখানের কিম্পুরূপ মানে কৃষ্ণমৃগ বা কালো হরিণ।

শুধু গরুকেই নয়, ঘোড়াকেও হত্যা করতে নিষেধ করা হয়েছে বেদে: কারণ, ১৩/৪৮ নং শ্লোকে বলা হয়েছে,

“এ এক খুর বিশিষ্ট পশু অশ্বকে হিংসা করো না, সে সর্বদা হ্রেষা শব্দ করে এবং বেগশালীর মধ্যে বেগবান। তোমাকে বন্য গৌরবর্ণ মৃগ দিচ্ছি তা দিয়ে জ্বালারূপ তনু পুষ্ট করে এখানে থাকো।”

এছাড়াও ১৩/৫০ নং শ্লোকে বলা হয়েছে,

“তোমাকে বন্য উট দিচ্ছি, তা দিয়ে শরীর পুষ্ট করে এ স্থানে থাকো।”

এরপর ১৩/৫১ নং শ্লোকে বলা হয়েছে,

“তোমাকে বন্য শারভ দিচ্ছি, তা দিয়ে শরীর পুষ্ট করে এ স্থানে থাকো।”

এই শারভও এক প্রকার হরিণ।

এছাড়াও শুক্লযজুর্বেদের ১২/৭৩ নং শ্লোকে বলা আছে,

“তোমরা অবধ্য গাভীগনকে মুক্ত করো।”

এখানে অবধ্য মানে যাকে হত্যা করা যায় না।

শুক্ল যজুর্বেদের পর এবার দেখুন ঋগ্বেদে গো হত্যা সম্পর্কে কী বলা আছে-

ঋগ্বদের ১ম মণ্ডলের ১৬৪ নং সূক্তের ৪০ নং ঋক বা শ্লোকে বলা আছে,

“হে অহননীয় গাভী, তুমি শোভন শস্য তৃণাদি ভক্ষণ করো এবং প্রভূত দুগ্ধবতী হও। তাহলে আমরাও প্রভূত ধনবান হবো। সর্বকাল ধরে তৃণ ভক্ষণ করো এবং সর্বত্র গমন করে নির্মল জল পান করো।”

এই শ্লোকের শুরুতেই বলা হয়েছে, হে অহননীয় গাভী, যার মানে যাকে হত্যা করা যাবে না।

এরপর ঋগ্বেদের ১০/৮৭/১৬ নং শ্লোকে বলা হয়েছে,

“যে হত্যা করবার অযোগ্য গাভীর দুগ্ধ হরণ করে; হে অগ্নি, নিজ বলে তাদের মস্তক ছেদন করে দাও।”

এই শ্লোকেও বুঝিয়ে দেওয়া হলো যে, গরু হত্যা যোগ্য নয়।

এছাড়াও ঋগ্বেদের ৮/১০১/১৬ নং শ্লোকে বলা হয়েছে,

“নির্দোষ অদিতি গো দেবীকে হিংসা করো না।”

দিতি অসুরদের এবং অদিতি দেবতাদের মাতা, এই সূত্রে সকল দেবতার মা হলো গো দেবী।

সুতরাং বেদ এ যে গো-হত্যা নিষেধ, এটি স্পষ্ট।

------

এক:


আমাদের মহান প্রতিপালক শূকর খাওয়া অকাট্যভাবে নিষিদ্ধ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন: “বলুন, আমার প্রতি যে ওহী হয়েছে তাতে লোকে যা খায় তার মধ্যে আমি কিছুই হারাম পাই না; মৃত প্রাণী, প্রবাহিত রক্ত ও শূকরের গোশত ছাড়া। কেননা এগুলো অবশ্যই অপবিত্র।”[সূরা আনআম, আয়াত: ১৪৫]


আমাদের প্রতি আল্লাহর রহমত হচ্ছে এবং তাঁর পক্ষ থেকে সহজায়ন হচ্ছে — তিনি আমাদের জন্য পবিত্র বস্তুসমূহ খাওয়া বৈধ করেছেন এবং শুধুমাত্র অপবিত্র বস্তুসমূহ হারাম করেছেন। তিনি বলেন: “তিনি তাদের জন্য পবিত্রবস্তু হালাল করেন এবং অপবিত্র বস্তু হারাম করেন”[সূরা আরাফ, আয়াত: ১৫৭]


শূকর নাপাক ও নিকৃষ্ট প্রাণী— এ ব্যাপারে আমরা এক মুহূর্তের জন্যেও সন্দেহ পোষণ করি না। শূকর খাওয়া কোলেস্টেরল মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর। তাছাড়া শূকর ময়লা-আবর্জনা খেয়ে জীবন ধারণ করে; মানুষের সুস্থ রুচিবোধ যা অপছন্দ করে এবং এমন প্রাণী খেতে ঘৃণাবোধ করে। কারণ যে মেজাজ ও স্বভাবের ওপর আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এর সাথে এটি খাপ খায় না।


দুই:


আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান মানব দেহের উপর শূকর খাওয়ার বিভিন্ন অপকারিতা সাব্যস্ত করেছে; যেমন-


- বিভিন্ন প্রাণীর গোশতের মধ্যে শূকরের গোশতে সবচেয়ে বেশি চর্বিযুক্ত কোলেস্টেরল রয়েছে। মানুষের রক্তে কোলেস্টেরল এর পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে রক্তনালী ব্লক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এছাড়া শূকরের গোশতে থাকা ‘ফ্যাটি এসিড’ অন্য সকল খাদ্যে থাকা ফ্যাটি এসিড থেকে ভিন্নরকম ও ভিন্ন গঠনের। তাই অন্য যে কোন খাদ্যের তুলনায় মানুষের শরীর খুব সহজে একে চুষে নেয়। যার ফলে, রক্তে কোলেস্টেরল এর পরিমাণ বেড়ে যায়।


- শূকরের গোশত ও চর্বি কোলন ক্যান্সার (বৃহদন্ত্রের ক্যান্সার), রেক্টাল ক্যান্সার (মলদ্বারের ক্যান্সার), অণ্ডকোষের ক্যান্সার, স্তন ক্যান্সার ও ব্লাডক্যান্সার এর বিস্তার ঘটায়।


- শূকরের গোশত ও চর্বি মেদ বাড়ায় এবং মেদ সংক্রান্ত রোগ বাড়ায়; যেগুলোর চিকিৎসা করা অনেক দুরূহ।


- শূকরের গোশত খাওয়া চর্মরোগ ও পাকস্থলির ছিদ্র ইত্যাদি রোগের কারণ।


- শূকরের গোশত খাওয়ার ফলে সৃষ্ট ফিতা কৃমি ও ফুসফুসের কৃমির কারণে ফুসফুস আলসার ও ইনফেকশনে আক্রান্ত হয়।


শূকরের গোশত খাওয়ার সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক হলো, শূকরের গোশতে ফিতা কৃমির শূককীট থাকে; যাকে বলা হয় টিনিয়া সলিয়াম (Taenia solium)। এ কৃমি ২-৩ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। এ কৃমির ডিম্বগুলো যদি মস্তিষ্কে বৃদ্ধি পায় তাহলে পরবর্তীতে মানুষ পাগলামি ও হিস্টিরিয়া রোগে আক্রান্ত হতে পারে। আর যদি হার্টে বৃদ্ধি পায় তাহলে মানুষ উচ্চ রক্তচাপ ও হার্টএটার্কে আক্রান্ত হতে পারে। শূকরের গোশতের মধ্যে আরও যেসব কৃমি থাকতে পারে সেগুলো হচ্ছে- ট্রিচিনিয়াসিস কৃমির শূককীট; রান্না করলেও এগুলো মরে না। মানুষের শরীরে এ কৃমি বাড়ার ফলে মানুষ প্যারালাইসিস ও চামড়ায় ফুসকুড়িতে আক্রান্ত হতে পারে।


চিকিৎসকগণ জোরালোভাবে বলেন যে, ফিতাকৃমি অত্যন্ত মারাত্মক রোগ; শূকরের গোশত খাওয়ার ফলে যে রোগে আক্রান্ত হতে পারে। মানুষের ক্ষুদ্রান্ত্রের মধ্যেও এ কৃমিগুলো বাড়তে পারে এবং কয়েক মাসের মধ্যে পরিপূর্ণ কৃমিতে পরিণত হতে পারে। যে কৃমির দেহ এক হাজারটি অংশ দিয়ে গঠিত। এর দৈর্ঘ্য ৪-১০ মিটার পর্যন্ত হতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে এটা এককভাবে বাস করতে পারে। এর ডিম্ব মানুষের মলের সাথে বেরিয়ে যায়। শূকর যখন এসব ডিম গিলে ফেলে ও হজম করে তখন এটা শুককীটের থলি আকারে টিস্যু ও পেশীতে প্রবেশ করে। এ থলিতে এক জাতীয় তরল ও ফিতাকৃমির মাথা থাকে। যখনি কোন লোক এ ধরণের কোন শূকরের গোশত খায় তখনি এ শূককীট মানুষের পাকস্থলীতে পরিপূর্ণ কৃমিতে পরিণত হয়। এ কৃমিগুলো মানুষকে দুর্বল করে দেয়। ভিটামিন বি-১২ এর ঘাটতি ঘটায়। যার ফলে মানুষের রক্ত শূন্যতা দেখা দেয়। এ ছাড়াও অন্য কিছু স্নায়ুবিক সমস্যা ঘটায়, যেমন-স্নায়ু প্রদাহ। কোন কোন ক্ষেত্রে এ শূককীট মস্তিষ্কে পৌঁছে খিঁচুনি বা ব্রেইনের উচ্চ রক্তচাপ ঘটতে পারে। যার কারণে মাথা ব্যথা, খিঁচুনি, এমনকি প্যারালাইসিসও হতে পারে।


ভালভাবে সিদ্ধ না করা-শূকরের গোশত খেয়ে মানুষ ট্রিচিনিয়াসিস কৃমিতে আক্রান্ত হতে পারে। এ প্যারাসাইটগুলো যখন মানুষের ক্ষুদ্রান্ত্রে পৌঁছে তখন ৪-৫ দিনের মধ্যে এগুলো অসংখ্য কৃমি হয়ে পরিপাকতন্ত্রের দেয়ালে প্রবেশ করে। সেখান থেকে রক্তে এবং রক্তের মাধ্যমে শরীরের অধিকাংশ পেশীতে ঢুকে পড়ে। কৃমিগুলো শরীরের পেশীতে ঢুকে সেখানে থলি তৈরী করে। যার ফলে রোগী পেশীতে তীব্র ব্যথা অনুভব করে। এ রোগ বেড়ে গিয়ে এক পর্যায়ে মস্তিষ্কের আবরণী ও মস্তিষ্কের প্রদাহ রোগে পরিণত হয়, হার্ট, ফুসফুস, কিডনি ও স্নায়ুর প্রদাহে পরিণত হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এ রোগ মৃত্যুও ঘটাতে পারে।


এ ছাড়া মানুষের এমন কিছু রোগ আছে যে রোগগুলো প্রাণীদের মধ্যে শুধুমাত্র শূকরের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়; যেমন- Rheumatology (বাতরোগ) ও জয়েন্টের ব্যথা। আল্লাহ তাআলা ঠিকই বলেছেন: “তিনি আল্লাহ্‌ তো কেবল তোমাদের উপর হারাম করেছেন মৃত জন্তু, রক্ত, শূকরের গোশ্‌ত এবং যার উপর আল্লাহ্‌র নাম ছাড়া অন্যের নাম উচ্চারিত হয়েছে। তবে, যে ব্যক্তির আর কোন উপায় ছিল না, (সে সেটা ভক্ষণ করেছে তবে) নাফরমান ও সীমালংঘনকারী হয়ে নয়; তার কোন পাপ হবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”[সূরা, বাকারা, আয়াত: ১৭৩]



শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে