একসাথে ৩তালাক বলতে কী তোমাকে ৩তালাক দিলাম বলা নাকি তোমাকে ১তালাক ২তালাক ৩তালাক বুঝায়
শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে

মুখে পরপর তিনবার 'তালাক' উচ্চারণ করলে অথবা একসাথে 'বায়েন তালাক' কথাটি বললেই তালাক কার্যকরী হয় না। যদিও এই ভুল ধারণাটা এখনও অনেকের মধ্যে আছে এবং আমাদের দেশে স্বামীরা অহরহই মুখে মুখে তালাক দিয়ে থাকেন। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ৭ (১) ধারা অনুযায়ী, স্বামী তালাক দেবার পরপরই তালাক দেবার সংবাদটি একটি নোটিশের মাধ্যমে চেয়ারম্যানকে (যে চেয়ারম্যানের এলাকায় স্ত্রী বাস করছেন) জানাতে হবে।সেই নোটিশের একটি কপি স্ত্রীকে পাঠাতে স্বামী বাধ্য। স্বামী যদি চেয়ারম্যান এবং স্ত্রীকে তালাকের নোটিশ না পাঠান, তবে ঐ একই আইনের ৭ (২) ধারা অনুযায়ে স্বামী এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা দশ হাজার টাকা জরিমানা অথবা অথবা দুটি দণ্ডেই দণ্ডিত হবেন। নোটিশ পাবার ত্রিশ দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পুনর্মিলন ঘটানোর উদ্দেশ্যে উভয়পক্ষের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সালিশী পরিষদ গঠন করবেন এবং তাঁদের মধ্যে সমঝোতা আনার প্রয়োজনীয় সমস্ত ব্যবস্থা নেবেন।

কিন্তু সালিশীতে যদি কাজ না হয় এবং নোটিশ দেবার ৯০ দিনের মধ্যে স্বামী যদি স্ত্রীকে দেওয়া নোটিশ প্রত্যাহার না করেন, তবে ৯০ দিন পরে তালাক কার্যকরী হবে। ৯০ দিন পার না হওয়া পর্যন্ত দম্পতিকে আইনসিদ্ধ স্বামী-স্ত্রী হিসেবেই ধরা হবে এবং স্ত্রী ভরণপোষণও পাবে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশ ১৯৬১ -এর ৭(১) নং ধারা অনুযায়ী - চেয়ারম্যান ও স্ত্রীকে নোটিশ না পাঠালে স্বামী শাস্তি পাবেন ঠিকই, কিন্তু তালাক বাতিল হবে না। তালাক কার্যকরী হবে। (সম্প্রতি একটি মামলায় (মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম বনাম মোছা:হেলেনা বেগম ও অন্যান্য। সিভিল রিভিশন নং ৬৯৮, ১৯৯২) এ মর্মেই রায় দেওয়া হয়েছে।)

এই ৯০ দিন অতিক্রান্ত হবার আগে কি তালাক প্রত্যাহার করা যাবে?

হ্যাঁ, এই ৯০ দিন অতিক্রান্ত হবার আগে অবশ্যই তালাক প্রত্যাহার করা যাবে। এই সময়টা এইজন্যই রাখা হয়েছে যাতে করে স্বামী-স্ত্রী উভয়পক্ষই ঠাণ্ডা মাথায় সব কিছু ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন - পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় আসতে পারেন।

বিচ্ছেদ প্রাপ্ত স্বামী কি আবার আগের স্ত্রীকে বিয়ে করতে পারে?

১৯৬১ সনের মুসলিম পারিবারিক আইন ৭ (৬) ধারা অনুযায়ী তালাকের মাধ্যমে কোন বিবাহবিচ্ছেদ ঘটলে, তালাক হওয়া দম্পতি আবার বিয়ে করতে চাইলে নতুন করে বিয়ে করতে হবে। তবে তার জন্য মধ্যবর্তী বা হিল্লা বিয়ের কোনো প্রয়োজন নেই।
(হিল্লা বিয়ে হল তালাক দেওয়া নারীকে প্রাক্তন স্বামী বিয়ে করতে চাইলে সেই নারীকে অন্তর্বর্তী কালে অন্য কোনো পুরুষকে বিয়ে করার পুরনো প্রথা। সেই প্রথা অনুযায়ী হিল্লা বিয়ের বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়ে যাবার পর তাঁকে প্রাক্তন স্বামী আবার নিকাহ্ করতে পারবেন । ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের মাধ্যমে 'হিল্লা' নিকাহ্ বলে যে বিয়ে প্রচলিত ছিল, সেটি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। হিল্লা বিয়ে সম্পূর্ণ বেআইনী কাজ। কেউ এ ধরণের বিয়ে ঘটানোর উদ্যোগ নিলে সরাসরি আইন প্রয়োগকারী সংস্থায় খবর দেওয়া উচিত।)

স্ত্রী কীভাবে স্বামীকে তালাক দিতে পারে?

(১) তালাক-ই-তৌফিজের মাধ্যমে
(২) খুলার মাধ্যমে
(৩) মোবারাতের মাধ্যমে
(৪) আদালতে আবেদনের মাধ্যমে

(১) তালাক-ই-তৌফিজ কি?

তালাক-ই-তৌফিজ স্ত্রীর নিজস্ব ক্ষমতা নয়। স্বামী যদি স্ত্রীকে তালাক প্রদানের ক্ষমতা দেয়, তবে স্ত্রীও স্বামীর মতো তালাক দিতে পারে। সেক্ষেত্রে স্ত্রীকেও স্বামীর মতো তালাকের নোটিশ চেয়ারম্যানের কাছে পাঠাতে এবং এক কপি স্বামীর কাছে পাঠাতে হবে। স্ত্রীর এই তালাক দেওয়ার ক্ষমতাকে তালাক-ই-তৌফিজ বলে।

নিকাহ্নামার ১৮ নং ঘরে "স্বামী স্ত্রীকে তালাক প্রদানের ক্ষমতা অর্পণ করছে কি না? করে থাকলে কী শর্তে?" এই প্রশ্নটি থাকে। স্বামীর একতরফা ক্ষমতার কারণে স্ত্রীকে বহু নির্যাতন সহ্য করেও স্বামীর সাথে থাকতে হয়। ১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহবিচ্ছেদ আইনে বর্ণিত শর্তগুলো (যেমন, নির্যাতন, নিরুদ্দেশ) না থাকলে এবং হুলার মাধ্যমে স্বামীর কাছ থেকে বিচ্ছেদ না পেলে একটি মেয়ের পক্ষে বিয়ে থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব। সেক্ষেত্রে স্ত্রী অপেক্ষাকৃত কম জটিলতায় তালাক-ই-তৌফিজের মাধ্যমে মুক্তি পেতে পারে। তাই এর গুরুত্ব অপরিসীম। নিকাহ্নামার ১৮ নং ঘরটি এজন্য অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পূরণ করা উচিত। অনেক সময় কাজীরা এ প্রশ্ন করেন না এবং ঘরটি শূন্য থাকে। কাজীদের অবশ্যই দুপক্ষকে দিয়ে ঘরটি সম্পর্কে অবগত করানো উচিত।

(২) খুলা বিচ্ছেদ কাকে বলে?

যদি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক বনিবনা ভাল না থাকে, তবে স্ত্রী অর্থ বা সম্পত্তির বিনিময়ে স্বামীকে বিচ্ছেদ ঘটাতে রাজী করাতে পারে। যেহেতু অধিকাংশ নারীর সম্পত্তি থাকে না অথবা সম্পত্তি থাকলেও তা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা থাকে না, সেক্ষেত্রে স্ত্রী মোহরানা বা মোহরানার অংশ দিয়ে স্বামীকে তালাক দিতে রাজী করানোর চেষ্টা করতে পারেন।

(৩) মোবারাত

যে ক্ষেত্রে স্বামী ও স্ত্রী, উভয়ই একে অন্যের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করেন এবং তাঁরা চুক্তির মাধ্যমে তাঁদের বিয়ের বিচ্ছেদ ঘটান, তখন বলা মোবারাত। খুলার মত মোবারাতও এক ধরণের চুক্তি-ভিত্তিক বিবাহবিচ্ছেদ।

(৪) স্ত্রী কর্তৃক আদালতে আবেদন মাধ্যমে তালাক

১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইনের অধীনে স্ত্রী নিম্নোক্ত ৯টি কারণের যে কোনো এক বা একাধিকের ভিত্তিতে আদালতে বিবাহ বিচ্ছেদ প্রার্থনা করতে পারেন:

(১) স্বামী ৪ বছরের অধিক সময় নিরুদ্দেশ থাকলে;
(২) দুই বছর যাবত্ স্ত্রীর খোরপোষ দিতে স্বামী ব্যর্থ হলে;
(৩) স্বামী ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের বিধান লঙঘন করে অতিরিক্ত স্ত্রী গ্রহণ করলে;
(৪) স্বামী সাত বছর বা তার বেশি সময় কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে;
(৫) কোনো যুক্তি-সঙ্গত কারণ ছাড়া তিন বছর ধরে স্বামী তাঁর দাম্পত্য দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে;
(৬) স্বামী বিয়ের সময় পুরুষত্বহীন থাকলে এবং তা মামলা দায়ের করার সময়পর্যন্ত বজায় থাকলে;
(৭) স্বামী দুই বছর ধরে পাগল থাকলে অথবা মারাত্বক যৌনব্যধিতে আক্রান্ত থাকলে;
(৮) নাবালিকা অবস্থায় বিয়ে হয়ে থাকলে অথবা সাবালকত্ব লাভের পর অর্থাত্ ১৮ বছর পূর্ণ হবার পর স্ত্রীর বিয়ে অস্বীকার করলে (কিন্তু এক্ষেত্রে স্বামীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে থাকলে এরকম মামলা দায়ের করা যাবে না)
(৯) নিম্নলিখিত যে কোনো অর্থে স্ত্রীর সাথে স্বামী নিষ্ঠুর আচরণ করলে:
(ক) যদি স্ত্রীকে শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করা;
(খ) কুখ্যাত মহিলাদের (women of ill reputation) সঙ্গে স্বামীর মেলামেশা করা কিংবা নৈতিকতা-বর্জিত জীবন যাপন করা।
(গ) নৈতিকতা-বর্জিত জীবন যাপনের জন্য স্ত্রীকে বাধ্য করা;
(ঘ) স্ত্রীর সম্পত্তি হস্তান্তর করা, কিংবা স্ত্রীকে তার সম্পত্তির বৈধ অধিকার প্রয়োগে দেওয়া;
(ঙ) স্ত্রীকে তার ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনে বাধা দেওয়া;
(চ ) যদি স্বামীর একাধিক স্ত্রী থাকে, তবে পবিত্র কোরানের নির্দেশে তাদের সাথে সমান ব্যবহার না করা;

তবে উপরোক্ত কারণগুলির ভিত্তিতে মামলা দায়ের করতে হলে স্ত্রীর কাছে সুনির্দিষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকতে হবে।

তালাক কখন কার্যকরী হয় না?

গর্ভবতী অবস্থায় তালাক দিলে সন্তান প্রসব না হওয়া পর্যন্ত তালাক কার্যকরী হবে না। সন্তানের বৈধতা বা পিতৃত্ব নির্ধারণের জন্যই এ আইন তৈরি করা হয়েছে।

বিবাহবিচ্ছেদের পর সন্তান কার কাছে থাকবে?

বিবাহবিচ্ছেদের পর ছেলে সন্তান ৭ বছর পর্যন্ত ও মেয়ে সন্তান বয়ঃসন্ধিকাল পর্যন্ত মায়ের কাছে থাকবে। বাবা ভরণপোষণ দেবে। যদি বাবা দায়িত্ব পালন না করে, সেক্ষেত্রে চেয়ারম্যান সালিশী পরিষদের মাধ্যমে আলাপ আলোচনা করে বিষয়টির নিষ্পত্তি করতে পারেন।

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ