চিকিৎসা বিজ্ঞানে মৃত্যুর
বর্ণনাঃ
এতদিন ভাবা হতো মৃত্যুর
হিমশীতল ভুবন থেকে কেউ
যেহেতু ফিরে আসেনি, সেহেতু
মানুষ কোনোদিন জানতে পারবে
না মৃত্যুর স্বাদ; কিন্তু
বিজ্ঞানীরা কেন থেমে
থাকবেন! শুরু হয়ে গেছে মৃত্যুকে
জানতে ব্যাপক তোড়জোড়। যদিও
এখন পর্যন্ত জানা হয়েছে খুবই
কম। মৃত্যু নিয়ে গবেষণা শুরু
করেছেন মৃত্যু বিশেষজ্ঞ
নিউইয়র্ক শহরের উইল কর্নেল
মেডিকেল সেন্টারের গবেষক
ড. সাম পার্নিয়া। সম্প্রতি
পার্নিয়া ও তার সহকর্মীরা
প্রকাশ করেছেন তাদের ৩
বছরের গবেষণার উল্লেখযোগ্য
আবিষ্কার। এই গবেষণা অডঅজঊ
হিসেবে পরিচিতি লাভ
করেছে। ইউরোপ, কানাডা ও
ইউএসের ২৫টি মেডিকেল
সেন্টারের ১৫০০ রোগী, যারা
‘কোমা অবস্থা’ থেকে ফিরে
এসেছেন জীবনে, পার্নিয়া
গবেষণা করেছেন মূলত তাদের
নিয়ে।
পার্নিয়ার গবেষণা থেকে
জানা যায় মৃত্যু মুহূর্তের কোনো
ঘটনা নয়; হৃৎপিন্ডের কম্পন
বন্ধ হলে ধীরে ধীরে
জীবকোষগুলো ক্ষয় হতে শুরু
করে। জীবকোষগুলো চলাচলে
অক্ষম হতে থাকে আর সব ক্রিয়া
বন্ধ হতে সময় লাগে ১০ মিনিট
থেকে এক ঘণ্টা। ওই সময়গুলোর
অনুভূতি সম্পর্কে আমাদের কোনো
ধারণা নেই। তবে ১০ অথবা ২০
শতাংশ মানুষ যারা ‘কোমা
অবস্থা’ থেকে ফিরে এসেছেন,
কিছুক্ষণ বা ঘণ্টা খানিক পর
তিনি চেতন ফিরে পেয়ে কি
দেখে এসেছেন সে বিষয়ে
স্বকল্পিত বিবরণ দিতে
পারেন। প্রায়-মৃত্যু থেকে
ফিরে আসা রোগিদের অনেকে
কোমা অবস্থায় নানামাত্রিক
রঙের কারুকাজ দেখেছেন বলে
মনে করেন। এই বিবরণ কতটা
সত্য বা কতটা অলীক কিংবা
মনের ভুল তা নিশ্চিত করে
অবশ্য বলা সম্ভব নয়।
সাধারণভাবে মনে করা হয়
মৃত্যু প্রাণীর জীবনে আচমকা
এসে সবকিছু লন্ডভন্ড করে দেয়;
কিন্তু চিকিৎসা শাস্ত্রে বলে
মৃত হতে হলে প্রথমে হৃদয়ের
কম্পন বন্ধ হতে হবে, ফুসফুস
তার ক্রিয়া বন্ধ করবে, যার
ফলে মস্তিষ্ক তার সব কাজ বন্ধ
করে দেবে। ডাক্তার চোখের
মণিতে আলো ফেললে যদি
স্নায়ুর ওপর কোনো উদ্দীপনা
সৃষ্টি না করে তবে তাকে মৃত
বলে ঘোষণা দেয়া হয়।
মানুষ মারা যাওয়ার পর সেই
মৃতদেহে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য
করা যায়। এই পরিবর্তন
সম্পর্কে আধুনিক বিজ্ঞান কিছু
তথ্য দিয়েছে। যেমন মৃতদেহের
পচন ধরার পূর্ব পর্যন্ত
শারীরিক কী কী পরিবর্তন হয়
বা কোন প্রক্রিয়ায় মৃতদেহে
পচন শুরু হয়।
চিকিৎসা বিজ্ঞারীরা বলেন,
মৃত ঘোষণার অর্থ এই নয় যে,
দেহের প্রতিটি কোষের মৃত্যু
হয়েছে। হৃদযন্ত্র শ্বাস-
প্রশ্বাস নেওয়া বন্ধ করলে,
কোষগুলো অক্সিজেন পায় না।
অক্সিজেন পাওয়া বন্ধ হলে
পেশিগুলো শিথিল হতে শুরু
করে। পাশাপাশি অন্ত্র এবং
মূত্রথলি খালি হতে শুরু হয়।
দেহের মৃত্যু ঘটলেও, অন্ত্র,
ত্বক বা অন্য কোনো অংশে
বসবাসকারী ১০০ ট্রিলিয়ন
ব্যাকটেরিয়া তখনও জীবিত
থাকে। মৃত্যুর পর দেহের
অভ্যন্তরে যা কিছু ঘটে, সে সব
কিছুর পেছনে কাজ করে এই ১০০
ট্রিলিয়ন ব্যাকটেরিয়া। মৃত্যুর
পর সর্বপ্রথম দেহের যে
পরিবর্তন আসে হলো, প্রথমে
অ্যালগর মরটিস (মৃতদেহের
তাপমাত্রা) ঘরের তাপমাত্রায়
না-আসা পর্যন্ত দেহের
তাপমাত্রা প্রতি ঘণ্টায় ১.৫
ডিগ্রি ফারেনহাইট করে কমতে
থাকে। লিভোর মরটিস বা
লিভিডিটি- এ ক্ষেত্রে দেহের
নিচের দিকে রক্ত এবং তরল
পদার্থ জমা হয়। মৃতদেহের
ত্বকের আসল রঙ ধীরে ধীরে
পরিবর্তিত হয়ে গাঢ় বেগুনি-
নীল রঙ ধারন করে।
রিগর মরটিস- এ ক্ষেত্রে দেহ
থেকে অত্যধিক ক্যালসিয়াম
ক্ষরণের ফলে পেশিগুলো শক্ত
হয়ে যায়। ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা
পর্যন্ত এই অবস্থা থাকে। এই
সময় চোখ খোলা থাকতে পারে।
বেশ কিছুক্ষণের জন্য মৃতের
চোখ খোলাই থাকে।
এর পর দেহে পচন ধরতে শুরু
করে। রক্ত চলাচল বন্ধ হলে
কার্বন-ডাই-অক্সাইডের গঠন
শুরু হয়, অম্লের মাত্রা বাড়তে
থাকে। এর ফলে কোষগুলোতে
ভাঙন ধরে। ২ থেকে ৩ দিনে
দেহ পচতে থাকে। পরিপাক
নালীতে থাকা ব্যাকটেরিয়া
এবং আণুবীক্ষণিক প্রাণীরা
দেহের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে
পড়ে। এ সময় তলপেট সবুজ বর্ণ
ধারণ করে এবং তাতে গ্যাস
তৈরি হয়। তার চাপে শরীরের
মলমূত্র নিষ্কাশিত হয়।
পিউট্রেসিন এবং
ক্যাডাভেরিনের মতো জৈবিক
যৌগ শিরা-উপশিরায় ছড়িয়ে
পড়লে, দুর্গন্ধ বের হতে শুরু
করে। এই গন্ধই মৃতদেহের
অন্যতম বৈশিষ্ট। নেক্রোসিস
পদ্ধতিতে এর পর দেহের রঙ
সবদিক থেকে কৃষ্ণবর্ণ ধারণ
করে।
মৃতদেহের দুর্গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে
ভিড় জমায় উচ্ছিষ্ট-ভোগী
পোকা-মাকড়। মৃতদেহকে
খাদ্যভা-ার হিসেবে ব্যবহার
করা হয়। এ তো গেল শুধু প্রথম
সাতদিনের বৃত্তান্ত। এর পর
ধীরে ধীরে প্রাণহীন মৃতদেহ
ক্রমে মাংস-চামড়ার খোলস
ত্যাগ করে পরিণত হয় হাড়
সর্বস্ব কঙ্কালে ।