maruf

Call

২০০৯ সালে, ইউনিসেফের রিপোর্টে প্রকাশ করা হয়, ' যেসকল দেশে মাসিকের ব্যাপারে কথা বলাকে নিষিদ্ধ মনে করা হয়, সেসকল দেশে বয়ঃসন্ধিতে ২০% মেয়ে স্কুলে অনুপস্থিত থাকে।" সমাজ এখনও মাসিকের ব্যাপারে কথা বলাকে নিষিদ্ধ মনে করে। খুব অল্প কজন মানুষই এই ব্যাপারে কথা বলতে আগ্রহী। বেশিরভাগ তথ্যই কুসংস্কার এবং অন্ধ বিশ্বাসের মাধ্যমে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মতে যাচ্ছে। মেয়েদের মাসিকের সময় যেকোনো ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান এবং সামাজিক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকারও পরামর্শ দেয়া হয়।

মাসিকের সাথে একজন কিশোরীকে মানিয়ে নিতে অনেক কষ্ট করতে হয়, বিশেষ করে বয়ঃসন্ধির সময়টায়। তাছাড়া সমাজের নানা অন্ধ বিশ্বাস এবং অর্ধ সত্য তথ্যের উপর ভিত্তি করে মেয়েরা মাসিকের ব্যাপারে খুব কম মানুষের সাথেই খোলাখুলিভাবে কথা বলতে পারে। অনেক কিশোরী মেয়েই এই সময়ে নিজেকে অন্যদের থেকে আলাদা করে রাখে এবং এসব কুসংস্কার এবং অর্ধ সত্য তথ্য তাদের আরও দ্বিধাগ্রস্ত করে তোলে। বলা বাহুল্য, এই সব কুসংস্কারে ভিত্তি করে অস্বাস্থ্যকর পদ্ধতিতে নিজের স্বাস্থ্যের যত্ন নেয়ার কারনে মেয়েদের শরীরে নানা রকম স্বাস্থ্যগত সমস্যা স্থায়ীভাবে দেখা দেয়।

সময়ের সাথে সাথে নারীরা আজ সমাজের ছোট বড় সবক্ষেত্রে অবদান রাখছে - শিক্ষা, খেলাধুলা, ইত্যাদি নানা সামাজিক প্রতিবন্ধকতাকে ডিঙ্গিয়ে নারীরা পুরুষের সাথে সমাজে সমানভাবে অবদান রাখছে। এসব কিছুই সম্ভব হয়েছে, মাসিকের সকল বিষয় এবং মাসিকের সাথে জড়িত সব স্বাস্থ্য সমস্যা লোকচক্ষুর আড়ালে রেখে।

এখনও, কর্মক্ষেত্রে বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারীদের জন্য সাস্থ্যকর টয়লেট এবং স্যানিটেশনের ব্যবস্থা থাকে না। তাছাড়া, বিভিন্ন পাবলিক যানবাহনে দূর ভ্রমণেও নারীদের টয়লেট নিয়ে পোহাতে হয় সীমাহীন ভোগান্তি।
এসকল স্বাস্থ্য এবং সামাজিক সমস্যা, প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে মেয়েদের মাসিকের সাথে সম্পর্কযুক্ত। এখনও আমরা এই ব্যাপারে মুক্তমনে আলাপ করতে চাই না। যদি প্রতিটি মেয়েরই মাসিক হয় এবং প্রতিটি মেয়েই যদি এই ব্যাপারে জানে, তাহলে এই ব্যাপারে মুক্তমনে কথা বলতেও দ্বিধা হওয়া উচিৎ নয়।

কেন মাসিক সম্বন্ধে কথা বলা উচিৎ?

চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে, মাসিকের সাথে হাজারো স্বাস্থ্য সমস্যা জড়িত। তাই ডাক্তারদের উপদেশ হচ্ছে, মাসিকের সময় পর্যাপ্ত পরিচ্ছন্নতা মেনে চলা।
একজন নারীর নিয়মিত মাসিক হওয়া সুস্বাস্থ্যের লক্ষন। বিশেষ করে যেসকল নারী সন্তান গ্রহন করতে চান, তাদের জন্য নিয়মিত মাসিক হওয়া খুবই জরুরি। প্রতি মাসিকে, ইস্ট্রোজেন হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়, সাথে জরায়ু থেকে ডিম্ব মুক্ত হয়। জরায়ুর লাইনিং আরও গাড় হয় সম্ভাব্য গর্ভধারণের জন্য।
ডিম্ব ফেলোপিয়ান টিউব দিয়ে ভ্রমন করে এবং শুক্রাণুর সাথে মিলিত হলে নিষিক্ত হয় এবং, যা পরবর্তীতে গর্ভধারণের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। ডিম্ব ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত জীবন্ত থাকে এবং এর মাঝে এটি নিষিক্ত না হলে এটি শরীরে শোষিত হয়।

জরায়ুর এই গড়ে ওঠা লাইনিং বেরিয়ে আসে এবং শরীর থেকে যোনিপথে রক্তের সাথে বের হয়ে যায়। একেই পিরিয়ড বা মাসিক বলা হয়।

তাহলে এখন আপনার জন্য এটি বোঝা সহজ হবে যে, নিয়মিত মাসিক না হওয়া মানে নিয়মিত ডিম্বস্ফোটন হয় না এবং গর্ভধারণও হয় না।

যদি মাসিক ১৬ বছরের মাঝে শুরু না হয় তাহলে একে 'delayed menarche' বলা হয় এবং এর জন্য চিকিৎসারও প্রয়োজন পড়তে পারে। যদি মাসিক শুরু হয়ে বন্ধ হয়ে যায় তাহলে এর পেছনে স্ট্রেস, অতিরিক্ত ওজনহীনতা, ওষুধ সেবন ইত্যাদি কারণ কাজ করতে পারে। তাছাড়া পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোমের কারনেও মাসিক হঠাৎ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

যদি মাসিক যথা সময়ে শুরু হয়, কিন্তু অতিরিক্ত রক্তপাত হয় কিংবা বার বার মাসিক হয়, এর ফলে শরীর থেকে রক্তক্ষয় হতে পারে যা পরে অ্যানিমিয়ার দিকে মোড় নিতে পারে।

মাসিক শুরুর দিকে অনিয়মিত হতে পারে। এতে ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু অনিয়মের পেছনে অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণ, পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম বা থাইরয়েডের সমস্যাও থাকতে পারে। অনেক সময় রক্ত শরীর থেকে বের করতে ইউটেরাইনের পেশী সঙ্কুচিত হয়, যার ফলে মাসিকের সময় ব্যথা অনুভূত হয়। তবে অনেক সময় এর পেছনে এন্ডোমেট্রিওসিস, ফাইব্রয়েড, পেলভিক ইনফ্ল্যামাটরি ইত্যাদি রোগও দায়ী থাকতে পারে।

এগুলি মাসিকের সাথে সম্পর্কযুক্ত কয়েকটি রোগের বর্ণনা মাত্র। সঠিক পরিচ্ছন্নতা মেনে চললে মাসিকের সাথে জড়িত অনেক জটিলতা এবং ইনফেকশান থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব।

অপরিচ্ছন্নতার সাথে জড়িত ভয়াবহতাগুলি কি কি ?

প্রতিটি মেয়ের মাসিকের সময় বিজ্ঞানসম্মত পরিচ্ছনতা মেনে চলা উচিৎ। ইনফেকশানের সম্ভাবনা স্বাভাবিক সময় থেকে মাসিকের সময় বেড়ে যায়। এক ধরণের মিউকাস সারভিক্সের মুখে অবস্থান করে, যা রক্ত বেরিয়ে যেতে সাহায্য করে। এটি জরায়ু এবং পেলভিক ক্যাভিটির দিকে ব্যক্টেরিয়ার পুনঃ ভ্রমনের রাস্তা তৈরি করে। তাছাড়া, এই সময়ে যোনিপথের পি, এইচ স্বাভাবিক থেকে কিছুটা কম এসিডিক থাকে, যা থ্রাশ - এর মত ইস্ট ইনফেকশানের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। কয়েকটি অপরিচ্ছন্নতার উদাহরন হল - অপরিষ্কার স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করা, অনেক সময় ধরে প্যাড পরিবর্তন না করা যা ত্বকে চুলকানি এবং র‍্যাশের সূত্রপাত করতে পারে। সামনে পেছনে মুছলে ব্যক্টেরিয়া অন্ত্র থেকে যোনিপথে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

নিজের মেয়েকে শেখান এবং সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তুলুন

মা বাবা, বড় ভাই বোন, বিশেষ করে বোনরা এই সময়ে মেয়েদের শরীর সম্বন্ধে সঠিক শিক্ষা দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতিটি মেয়েকে তাদের শরীর, মাসিক এবং পরিচ্ছন্নতা সম্বন্ধে পর্যাপ্ত জ্ঞান দিতে হবে। যেসব মেয়েরা এই সব বিষয়ে সচেতন তারা অনেক আত্মবিশ্বাসী হয় এবং নানা রকম সামাজিক কর্মকাণ্ডেও সক্রিয় থাকে।

বিভিন্ন বয়সে মেয়েরা মেয়ে থেকে নারী হতে পারে। প্রথম মাসিক যেকোনো সময়ে হতে পারে। তাই, একটু আগে থেকেই নিজেকে যথাযথভাবে প্রস্তুত করা উচিৎ। একটি মেয়ের প্রথম মাসিক হলে তাকে মাসিকের বিজ্ঞানসম্মত বর্ণনা দিন এবং কেন এবং কি ইত্যাদি বিষয়গুলি ধৈর্য নিয়ে ব্যাখ্যা করুন।

বেশিরভাগ বাবা মা মেয়েদের সাথে মাসিক নিয়ে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না কারণ এর সাথে শারীরিক মিলন এবং প্রজনন ইত্যাদি বিষয়গুলি জড়িত। কিন্তু এই বিষয়গুলি সামাজিক বন্ধুত্বপূর্ণ আলাপচারিতার মাধ্যমে আরও ভালোভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। নিকট বন্ধুর সাথেও আলাপচারিতা এবং অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে অনেক কিছু জানা এবং সাপোর্ট পাওয়া সম্ভব। আপনার মেয়েকে শেখান প্রথম মাসিকের সময় কি করতে হবে, কার কাছে যেতে হবে, কিভাবে প্যাড ব্যবহার করতে হয় এবং মাসিকের সময় পরিচ্ছন্নতার প্রয়োজনীয়তা কতখানি।
সাথে আরও শেখাতে হবে কিভাবে প্যাড বিনষ্ট করতে হয়। তাকে প্যাডের লিকেজের ব্যাপারে জানান। অনাকাঙ্ক্ষিত মাসিক এবং পেটের ব্যথা সম্বন্ধেও পর্যাপ্ত জ্ঞান দিন।

তাকে শপিং - এ নিয়ে যান। তাকেই সিদ্ধান্ত নিতে দিন কোন ধরণের স্যানিটারি ন্যাপকিন এবং আন্ডার গারমেন্ট সে ব্যবহার করবে। যদি সে আপনার সাথে শপিং করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ না করে তাকে নিজের মত কিছু সময় দিন। তাকে হাজারো বাঁধা নিষেধ না শিখিয়ে, তাকে বাইরে নিয়ে গিয়ে দিনটিকে উপভোগ করুন। প্রশংসার সাথে তার আত্মবিশ্বাস বাড়ান। যদি তার সব প্রশ্নের জবাব আপনার কাছে না থাকে, মনে রাখুন যে সবার কাছে সবকিছুর উত্তর থাকে না। মায়েদের এটি সবসময় স্মরণে রাখা উচিৎ যে, এখনকার মেয়েদের জন্য জগত আপনাদের সময় থেকে অনেক ভিন্ন। যদি আপনি মাসিক সম্বন্ধে কোন বিষয়ে সঠিক তথ্য না জেনে থাকে তাহলে মায়া'র মত সামাজিক ওয়েবসাইট থেকে সাহায্য নিতে পারেন। প্রয়োজনে ডাক্তার থেকে সরাসরি পরামর্শ গ্রহন করুন।

যদি মা কাছে না থাকে, প্রতিটি মেয়ের প্রয়োজনে তাদের বাবার কাছে স্যানিটারি ন্যাপকিন এনে দেয়ার কথা যেন বলতে পারে, এমন স্বাচ্ছন্দ্যবোধ প্রতিটি ঘরে থাকা উচিৎ। তার সুস্থতার জন্য যতটা সম্ভব তাকে সাহায্য করুন। যত আপনি বিজ্ঞানসম্মতভাবে তাকে গড়ে তুলবেন, ততই আপনি সমাজকে একজন আত্মবিশ্বাসী নারী উপহার দেয়ার দিকে এক ধাপ এগিয়ে যাবেন।

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ