প্যারালাইসিস কি?
প্যারালাইসিস হল একটা অবস্থা যেখানে শরীরের কিছু বা সমস্ত অঙ্গের সাময়িক বা সম্পূর্ণ সঞ্চালণ বন্ধ হয়ে যায়। এটা হয় মস্তিষ্ক এবং শরীরের পেশিসমূহের মধ্যে সংকেতপ্রেরণ পদ্ধতির আদান-প্রদানগত সমস্যার কারণে। এটি হতে পারে কোনও রোগের কারণে, যেমন পোলিও, স্নায়ুর ব্যাধি, স্ট্রোক অথবা অন্য কারণের জন্য।

প্যারালাইসিস এর প্রধান লক্ষণ এবং উপসর্গগুলি কি কি?
মূল উপসর্গ হল শরীরের কিছু অঙ্গ বা শরীরের সমস্ত অঙ্গ নড়াচড়া করার অক্ষমতা। এটির সুত্রপাত হয়তো আস্তে আস্তে বা হঠাৎ করে হয়। উপসর্গগুলি হয়তো মাঝে মাঝে দেখা দিতে পারে।

লক্ষণ এবং উপসর্গগুলো হলো:

  • হাত-পা অবশ হয়ে যাওয়া
  • শরীরের একপাশ অবশ হয়ে যাওয়া
  • অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
  • মুখ বেঁকে যাওয়া
  • হাসলে মুখ অন্য পাশে চলে যাওয়া
  • কথা বলতে না পারা
  • কথা জড়িয়ে যাওয়া
  • হঠাৎ চোখে না দেখা
  • গিলতে সমস্যা হওয়া
  • হাঁটতে না পারা
  • বমি বমি ভাব বা বমি
  • ঘুম ঘুম ভাব
  • চোখে একটি জিনিস দু'টি দেখা
  • প্রচণ্ড মাথাব্যথা প্রভৃতি।


মুখ্যভাবে আক্রান্ত অঙ্গগুলি হল:

  • মুখের অংশ।
  • পায়ের উপরের দিক।
  • একটা পায়ের উপরের বা নীচের দিক (মোনোপ্লেজিয়া)।
  • শরীরের একটা দিক (হেমিপ্লেজিয়া)।
  • দুটো পায়েরই নীচের দিকে (প্যারাপ্লেজিয়া)।
  • চার হাত-পা (কোয়াড্রিপ্লেজিয়া)।
  • শরীরের সমস্ত আক্রান্ত অঙ্গ কঠিন অথবা আলগা বোধ হতে পারে, সেখানে সংবেদনের অভাব দেখা দিতে পারে বা কখনও কখন সেগুলি বেদনাদায়কও হয়ে উঠতে পারে।


প্যারালাইসিস এর প্রধান কারণগুলি কি কি?
প্যারালাইসিসের অন্তর্নিহিত কারণগুলি অনেক এবং এটা সাময়িক বা দীর্ঘকালের জন্য হতে পারে। প্রধান কারণগুলি হল:

  • দেহের এক দিকে হঠাৎ করে দুর্বলতা (স্ট্রোক বা অস্থায়ী ইসচেমিক আক্রমণ)।
  • অল্পক্ষণের জন্য প্যারালাইসিস ঘুম থেকে ওঠার পর বা ঘুমোতে যাওয়ার আগে (স্লিপ প্যারালাইসিস)।
  • দুর্ঘটনার কারণে, স্নায়ুর ক্ষতি হওয়া বা মস্তিষ্কে আঘাত পাওয়া।
  • মুখের প্যারালাইসিস (বেল’স পালসি) মস্তিষ্কে ক্ষতের কারণে।


প্যারালাইসিস এর কিছু সাধারণ কারণ হল:

  • মস্তিষ্কে আঘাত বা মেরুদণ্ডে আঘাত।
  • স্ট্রোক।
  • মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস।
  • পোলিও।
  • সেরিব্রাল পালসি।
  • মস্তিষ্কে বা মেরুদণ্ডে টিউমার।


প্যারালাইসিস কিভাবে নির্ণয় করা হয় এবং এর চিকিৎসা কি?
প্যারালাইসিস প্রাথমিকভাবে উপসর্গ দেখে নির্ণয় করা হয়। শারীরিক পরীক্ষার উপর ভিত্তি করে, ডাক্তার কি ধরণের প্যারালাইসিস হয়েছে তা নির্ণয় করেন। ইমেজিং পদ্ধতি, যেমন এমআরআই এবং সিটি স্ক্যান হয়তো করানো হবে মস্তিষ্কের এবং মেরুদণ্ডের বিশদ চিত্র পাওয়ার জন্য এবং স্নায়ুর অবস্থাও পরীক্ষা করে দেখা হয়। প্যারালাইসিস রোগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে রোগীকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে এবং প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। তবে প্যারালাইসিসের জন্য রোগীর ওষুধের চেয়েও বেশি দরকার হলো পরিচর্যার এবং প্রশিক্ষণের। ওষুধ হিসেবে প্রয়োজন অনুযায়ী পেনটস্রিফাইলিন, ভিমপোসিটিন, এসপিরিন ইত্যাদি দেয়া যেতে পারে।
এ ছাড়া প্যারালাইসিসের কারণ অনুযায়ী চিকিৎসা করতে হবে। যেমন- উচ্চরক্তচাপের জন্য প্যারালাইসিস হলে এন্টি-হাইপারটেনসিভ ওষুধ দিতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে রক্তচাপ খুব সতর্কতার সাথে ধাপে ধাপে কমাতে হবে। এ ছাড়া অন্য কোনো সমস্যা থাকলে সমস্যাসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
পরিচর্যার ক্ষেত্রে-

  • অজ্ঞান রোগীদের জন্য বিছানা ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে
  • নাকের মাধ্যমে পরিমিত পরিমাণে খাবারের ব্যবস্থা করতে হবেষ আধা ঘণ্টা পরপর রোগীর পজিশন পরিবর্তন করতে হবে
  • রোগীকে প্রস্রাব-পায়খানা করানোর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। দরকার হলে ক্যাথেটার, বেডপ্যান ইত্যাদি ব্যবহার করতে হবে
  • রোগীর শরীরের সব জোড়ার প্রতি যত্নবান হতে হবে যাতে জোড়াগুলো শক্ত হয়ে না যায়। এ জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী নির্দিষ্ট নিয়মে ব্যায়াম করাতে হবে।
  • বিভিন্ন প্রকার ফিজিক্যাল থেরাপি যেমন ইনফ্রারেড, সর্টওয়েভ ইলেকট্রিক্যাল স্টিমুলেশন থেরাপি প্রয়োজন অনুযায়ী দিতে হবে।


নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি:
স্ট্রোক-প্যারালাইসিস পুনর্বাসনের অনেক পদ্ধতি আছে। এর মধ্যে বোবাথ, পিএনএফ টেকনিক উল্লেখযোগ্য, কিন্তু প্রচলিত এসব পদ্ধতির কোনোটিই আক্রান্ত মস্তিষ্কে সরাসরি উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে পারে না। এক্ষেত্রে ‘কাওয়াহিরা মেথড’ যুগান্তকারী সফলতা পেয়েছে। জাপানের কাগোশিমা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্যারালাইসিস রোগীর ওপর চালিত গবেষণায় ব্যাপক সফলতা পাওয়া গেছে।

প্যারালাইসিস প্রতিরোধ:
বলা হয়, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। তাই স্ট্রোক-প্যারালাইসিস প্রতিরোধ আমাদের সুস্থ জীবনযাপনে খুবই সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। আমরা নিম্নোক্ত বিষয়গুলো অবলম্বন করার মাধ্যমে সহজেই স্ট্রোক-প্যারালাইসিস প্রতিরোধ করতে পারি।

  • নিয়মিত ব্যায়াম
  • শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমানো
  • ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ
  • উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ
  • ধূমপান ও অ্যালকোহল বর্জন
  • বেশি মাত্রায় কোলেস্টেরল থাকে, এমন খাবার বর্জন
  • আঁশ সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ, পরিমিত মাত্রায় লবণ গ্রহণ, ভাজাপোড়া খাবার এড়িয়ে চলা প্রভৃতি।



চিকিৎসা এবং অপচিকিৎসা:
স্ট্রোক হলে যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে হাসপাতালে নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, রোগী যত তাড়াতাড়ি চিকিৎসা পাবে, জটিলতার ঝুঁকি তত কমে যাবে। স্ট্রোকের চিকিৎসা সাধারণত দু'টি পর্যায়ে বিভক্ত। স্ট্রোকের তাৎক্ষণিক চিকিৎসা এবং প্যারালাইসিস (যদি হয়) এর চিকিৎসা। হাসপাতালে তাৎক্ষণিক চিকিৎসার সময় বা অল্প কিছুদিন পর প্যারালাইসিসের চিকিৎসা নিতে হয়। চিকিৎসার দ্বিতীয় পর্যায়টি ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগ করে থাকে। বিভিন্ন ধরনের ব্যায়াম এবং ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে এই চিকিৎসা করা হয়। এই চিকিৎসাকে স্ট্রোক পরবর্তী পুনর্বাসন ও বলে। ফিজিওথেরাপি সেন্টারগুলো এই পুনর্বাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একজন পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীর জন্য এটি খুবই জরুরি। কেননা, সঠিক চিকিৎসা না পেলে রোগী স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে যায়, অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং জীবনযাপন কষ্টকর হয়ে ওঠে। এতে করে পরিবার, সমাজের এবং রাষ্ট্রের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে।

দুঃখের বিষয় হলো, আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষই চিকিৎসার এই দ্বিতীয় পর্যায় সম্পর্কে অবগত নয়। তারা কবিরাজ, ওঝার দ্বারস্থ হয় এবং ঝাড়ফুঁকের নামে বিভিন্ন ধরনের অপচিকিৎসা অবলম্বন করে। এসব অপচিকিৎসার পদ্ধতিগুলোও উদ্ভট। কখনো রোগীর শরীরের অংশ মাটিতে পুঁতে, কখনো রোগীকে শুইয়ে রেখে তার চারপাশে গান-বাজনা করে, কখনো ঝাঁটা দিয়ে রোগীকে আঘাতের মাধ্যমে! এসব কর্মকাণ্ড দেখে হতাশ হতে হয় এই ভেবে যে, মানুষ এখনো কতটা অজ্ঞ, কতটা কুসংস্কারাচ্ছন্ন। সাধারণত গ্রামাঞ্চলে এই অপচিকিৎসা বেশি দেখা যায়। মনে রাখতে হবে যে, এসব অপচিকিৎসার কোনোই ভিত্তি নেই। উপরন্তু, এগুলো রোগীর অবস্থা আরো জটিল করে দেয়। সেইসাথে এসব প্রতারক কবিরাজরা মানুষকে ভুল বুঝিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়ে নেয়।

সচেতন হয়ে আধুনিক চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমেই আমরা একজন রোগীর প্যারালাইসিস অবস্থার উন্নতি করতে পারি, যা সহজ করে দেবে আক্রান্ত ব্যক্তির জীবনযাপন, এনে দেবে কর্মক্ষমতা এবং করে তুলবে আত্মনির্ভরশীল। এতে করে পরিবার এবং সমাজের পিছিয়ে পড়া রোধ হবে। তাই সচেতনতা একান্তভাবে কাম্য।

শেষ কথা:
রোগী যখন সুস্থ হয়ে উঠবে তখন তাকে বিভিন্ন প্রকার প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করে তুলতে হবে। কথা স্পষ্টভাবে বলার জন্য স্পিচ থেরাপি দিতে হবে। রোগীর হাঁটাচলার জন্য প্রশিক্ষণ দিতে হবে। প্রয়োজনে গেট ট্রেনিংয়ের আওতায় প্যারালাল বার ওয়াকিং, রোলেটর ওয়াকিং ও ক্র্যাচ ওয়াকিং এমনকি লাঠির সাহায্যে হাঁটার প্রশিক্ষণ দিতে হবে। যদি কোনো রোগী হাঁটতে অক্ষম হয় তবে তাকে হুইল চেয়ার দিয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। হাত ও পায়ের দুর্বলতার জন্য নির্দিষ্ট নিয়মে নির্দিষ্ট ব্যায়াম করতে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিবর্তন অর্থাৎ রোগীর সামর্থ্য অনুযায়ী থাকার ঘর, কিচেন, বাথরুম, অথবা অফিস কক্ষে পরিবর্তন আনতে হবে। যেমন- স্যাঁতস্যাঁতে ফ্লোর বা স্লিপি ফ্লোরকে কার্পেট দিয়ে মুড়ে দেয়া, প্রয়োজনীয় হাতল দিয়ে চলাচলের সুবিধা করে দেয়া, বাথরুমে উঁচু কমোড তথা ধরে বসার জন্য ব্যবস্থা করে দেয়া ইত্যাদি। এই পরিবর্তন রোগীর প্রয়োজন অনুযায়ী করতে হবে। রোগীর যতটুকু সামর্থ্য আছে তার আলোকে তাকে কোনো কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে এবং তাকে আয় করার জন্য ব্যবস্থা করে দিতে হবে। যেমন- একজন প্যারাব্লেজিক অর্থাৎ যার পা দুটো প্যারালাইজড কিন্তু হাত দিয়ে কাজ করতে পারে, তাকে একটি ক্ষুদ্র ব্যবস্থা যেমন- পান দোকানের ব্যবস্থা করে দেয়া যেতে পারে। দৈনন্দিন কাজের জন্য তাকে কিছু এডাপ্টিভ ডিভাইজের ব্যবস্থা করে দিতে হবে।সর্বোপরি তার আমোদপ্রমোদ তথা বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারার ব্যবস্থা করে দিতে হবে, যাতে সে মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে পারে।


শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে