ব্রেইন ক্যান্সার কি?
মস্তিষ্কের টিউমার বা ব্রেইন টিউমার (ইংরেজি: brain tumor) বা ইন্ট্রাক্রানিয়াল নিওপ্লাজম (ইংরেজি: intracranial neoplasm) হচ্ছে এমন একটি অবস্থা যখন মানুষের মস্তিষ্কে অস্বাভাবিক কোষ তৈরি হয়। এই টিউমার দুই প্রকারের হয় যার একটি হচ্ছে ম্যালিগ্যান্ট বা ক্যান্সার সৃষ্টিকারী টিউমার এবং অপরটি হচ্ছে বেনাইন টিউমার। ক্যান্সার সৃষ্টিকারী টিউমার প্রাথমিক বা প্রাইমারি টিউমার ও মেটাস্ট্যাসিস বা সেকেন্ডারি টিউমার — এই দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। এদের মধ্যে প্রাথমিক টিউমারের শুরুটি হয় মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে, অপরদিকে মাধ্যমিক টিউমার শরীরের অপর কোনো অংশ থেকে বিস্তৃত হয়ে মস্তিষ্কে আসে যা চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় ব্রেইন মেটাস্টাসিস টিউমার নামে পরিচিত।

ব্রেইন ক্যান্সারের স্থান এবং বৃদ্ধির হার নির্ধারণ করে স্নায়বিক পদ্ধতির ক্রিয়ার ওপর তার প্রভাব কিরকম হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী প্রতি বছর ব্রেইন ক্যান্সারে আক্রান্তের হার বেড়ে চলেছে। প্রাপ্তবয়স্কদের পাশাপাশি শিশুরাও এই ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে, বিশেষ করে শিশুরা যেসব ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় তার মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ব্রেইন ক্যান্সার।

ব্রেইন ক্যান্সারের লক্ষণ ও ঝুঁকিগুলো কী? এটা কতটা ব্যাপক? কীভাবে এই ক্যান্সার নির্ণয় ও চিকিৎসা দেয়া হয়? চলুন জানা যাক বিস্তারিত!

ব্রেইন ক্যান্সারের প্রধান লক্ষণগুলি এবং উপসর্গগুলি কি?
মস্তিষ্কের যতটা অংশ প্রভাবিত হয়েছে, তার ওপর নির্ভর করে এর লক্ষণ। নীচে ব্রেইন ক্যান্সারের কয়েকটি উপসর্গগুলি দেওয়া হল:

  • প্রচণ্ড মাথা ব্যথায় ভোর রাতে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া এবং ঘুম যত গভীর হয় মাথা ব্যথাও ততো বাড়ে।
  • পেটে ব্যথা ছাড়া বা বমনেচ্ছা ছাড়াই বমি হতে পারে এবং খাবারের সাথে বমির কোন সম্পর্ক থাকে না। মাথা ব্যথা থাকাকালীন সময়েও বমি হতে পারে।
  • ব্রেইন ক্যান্সারের ফলে মস্তিষ্কের অভ্যন্তরের চাপ অত্যন্ত বেড়ে যায় এবং শিরাস্থ রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্থ হয় ফলে স্ট্যাসিস এবং এডিমা হতে পারে।
  • চোখ অতিরিক্ত কাঁপা বা চোখের পাতা বন্ধ করতে অসুবিধা হওয়া প্রভৃতি লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
  • ব্রেইন ক্যান্সারের অন্যতম লক্ষণ হল ঘ্রাণশক্তি হ্রাস পাওয়া, অলীক কোন কিছুতে কল্পনা করা প্রভৃতি।
  • ব্রেইন টিউমারের কারনে শ্রবণশক্তিও হ্রাস পায়।
  • অপ্রাপ্ত বয়সে মৃগী রোগ দেখা দিলে এবং সাথে মানসিক ভারসাম্যহীনতা বা অন্য কোন অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা দিলে প্রথমেই বুঝতে হবে এটি ব্রেইন ক্যান্সার।


ব্রেইন ক্যান্সারের লক্ষণ গুলো সবার ক্ষেত্রে একই রকম হয় না এবং এক্ষেত্রে কোন রকম লক্ষণ দেখা মাত্রই দ্রুত পরবর্তী পরীক্ষার জন্য বিশেষজ্ঞ হসপিটালে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

ব্রেইন ক্যান্সারের প্রধান কারণগুলি কি কি?
ব্রেইন ক্যান্সারের প্রধান কারণ অজানা এবং অনির্দিষ্ট। কিন্তু, অনেকগুলি ঝুঁকির বিষয় ব্রেইন ক্যান্সারের সাথে যুক্ত আছে। যেমন:

  • বয়স - বয়সের সাথে ব্রেইন ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
  • উচ্চ মাত্রার তেজস্ক্রিয় তরঙ্গের সংস্পর্শে আসলেও ব্রেইন ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
  • লিউকিমিয়া অথবা নন-হজক্কিন লিম্ফোমার ইতিহাসের সাথে যুক্ত প্রাপ্তবয়স্কদের ব্রেইন ক্যান্সার বৃদ্ধি পাওয়ার সর্বাধিক ঝুঁকি আছে।
  • বাহ্যিক বা অভ্যন্তরীণ ভাবে মাথায় অতিরিক্ত আঘাত পেলে অনেক ক্ষেত্রে ক্যান্সার কোষ সক্রিয় হয়ে যেতে পারে অথবা পূর্বে বিদ্যমান টিউমারের আকৃতিও বৃদ্ধি পেতে পারে।
  • দীর্ঘসময় ধরে বিভিন্ন কেমিক্যাল অথবা হেয়ার কালার মাথায় ব্যবহার করলে ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
  • ভ্রূণের উন্নয়নের সময় একটোপিক প্রিমিটিভ সেল বা করোটি গহ্বর থেকে যায় এবং এর বর্ধন প্রক্রিয়ার বিভিন্নতার কারণে জন্মগত ভাবেও মস্তিষ্কের ক্যান্সার হতে পারে।
  • অধিকাংশ রোগীর ক্ষেত্রে দেখা যায় পরিবারের কারো ব্রেইন ক্যান্সার ছিল এবং ভবিষ্যতে তারও হয়েছে। সুতরাং জেনেটিক্যাল কারনেও ব্রেইন ক্যান্সার হতে পারে।


কিভাবে রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা করা হয়?
চিকিৎসক রোগীর গতিদায়ক প্রতিবর্তী ক্রিয়া, পেশি শক্তি এবং সংবেদনশীল প্রতিক্রিয়াগুলির দ্বারা রোগ নির্ণয় নিশ্চিত করেন। টিউমারের দ্বারা মাথার মধ্যে চাপ বৃদ্ধির কারণে দৃষ্টিসংক্রান্ত স্নায়ু স্ফীত হয়।

ব্রেইন ক্যান্সারের প্রধান রোগনির্ণয়সংক্রান্ত পরীক্ষা হল এমআরআই এবং সিটি স্ক্যান।

অন্য পরীক্ষাগুলি যেগুলি ব্যবহার হতে পারে সেগুলি হল:

  • ম্যাগনেটিক রিজোনেন্স স্পেকট্রোস্কপি
  • পিইটি স্ক্যান
  • সিঙ্গল-ফোটন এমিসন সিটি (এসপিইসিটি) স্ক্যান
  • লাম্বার পাংচার।


টিউমারের পর্যায় এটার বিকাশের পরিমানের উপর নির্ভর করে। এটি টিউমারের আকার এবং শরীরে কতটা ছড়িয়েছে তা নির্দেশ করে।

  • প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণিগুলি হল ধীরে ক্রমবর্ধমান
  • তৃতীয় এবং চতুর্থ শ্রেণিগুলি হল দ্রুত ক্রমবর্ধমান


শ্রেণির উপর ভিত্তি করে, টিউমারের চিকিৎসা হয়:
শল্যচিকিৎসা, রেডিয়েশন থেরাপি এবং কেমোথেরাপির সমন্বয়ে ব্রেইন ক্যান্সারের চিকিৎসা হতে পারে। খিচুনির ক্ষেত্রে খিচুনি প্রতিরোধোক অ্যান্টিকনভালস্যান্ট ওষুধের প্রয়োজন পড়তে পারে। টিউমারের পাশে পানি জমা ঠেকাতে ওষুধ ব্যবহৃত হতে পারে। কিছু টিউমার ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায় যা শুধুমাত্র নিয়মতি মনিটরিংয়ের প্রয়োজন এবং বাড়তি আর কিছু করার প্রয়োজন পড়ে না। এছাড়াও চিকিৎসার ক্ষেত্রে রোগীর রোগপ্রতিরোধ তন্ত্র সম্পর্কে গবেষণা করা প্রয়োজন। চিকিৎসার ফলাফল টিউমারের প্রকার ও বিস্তৃতির ওপর উল্লেখযোগ্যভাবে নির্ভর করে। সাধারণত গ্লিওবাস্টোমার ক্ষেত্রে চিকিৎসায় খুব ভালো ফলাফল পাওয়া যায় না, কিন্তু মেনিনজিওমার ক্ষেত্রে এই ফলাফল ভালো।

যেহেতু ব্রেইন ক্যান্সার বিরল অসুখ, তাই বাঁচার হার গণনা করা কঠিন। আগে থেকে ব্রেইন ক্যান্সার ধরা পড়লে গড়ে ১৫% মানুষ ৫ বছর পর্যন্ত তা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মস্তিষ্কের ক্যান্সারের পাঁচ বছর মেয়াদী বেঁচে থাকার হার গড়ে ৩৩%।


শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে