মনসুর হেল্লাজ আল্লাহর অতি প্রিয় একজন দাস ছিলেন। তিনি তার সারাজীবন অতি সাধারনভাবে জীবন অতিবাহিত করেছেন। কিন্ত দুঃখের বিষয় জীবিতকালে মানুষতাকে চিনতে পারেনি। আর তাকে চিনতে না পারার কারণে ও তার কথার মর্ম উতঘাটন করতে না পারার কারনে আজীবন নানা অত্যাচার ও নিপীড়নের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করতে হয়েছে। মনসুর হেল্লাজের আধ্যাতিক শিক্ষা পূর্নতা পেয়েছিল বাগদাদে এবং সে সময়ের প্রধান ধর্মীয় পুরুষ হযরত জোনায়েদ-আল-বাগদাদীর সান্নিধ্যে। সে সময়ে মুসলিম বিশ্বের শাসক ছিলেন আব্বাসীয় খলিফাগন । আধ্যাতিক পুরুষ হিসেবে মনসুর অনন্য ছিলেন তার প্রকাশ ভংগীও ছিল অনন্য ।অন্যান্য সুফী-দরবেশগন যেখানে ধর্মের গুঢ় তত্ব সাধারন মানুষের সাথে আলোচনা করতেননা, নিজেদের রহস্যময়তার ভেতর রাখতেন,সেখানে মনসুর ছিলেন বিপরীত । মনসুর মারফতের সব জটিল ও অলৌকিক ব্যপারগুলো খোলামেলা আলোচনা করতেন সাধারন মানুষের সাথে । অন্যান্য ধর্মীয় স্কলার দের চেয়ে বরং সাধারন মানুষের সাথে তিনি আল্লাহ ও তার প্রেমময়তা নিয়ে কথা বলতেন বেশী । বাগদাদের রাস্তায় রাস্তায় তিনি বলে বেড়াতেন: ‘আমি তোমাকে খুঁজতে গিয়ে আমাকে ফিরে পাই। এতো নিকটে তুমি যে আমি আমার থেকে তোমাকে আলাদা করতে পারিনা’ ‘আমার অন্তরাত্না মিশে গেছে তোমার মাঝে,খুব সন্নিকটে অথচ অনেক দূরে…যেন তুমিই আমি যেমন আমি হয়ে গেছি তোমার’ এর ফলে মনসুর সাধারন মানুষের কাছে খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠলে ও তৎকালীন অন্য সব ধর্মীয় গুরুগন তার উপর ক্ষেপে উঠেন । তারা মনসুরের বিরুদ্ধে আধ্যাতিক রহস্য জনসম্মুখে প্রকাশের অভিযোগ আনেন । এমনকি তার শিক্ষক হযরত জোনায়েদ ও তাকে সতর্ককরে দেন সাধারন মানুষের কাছে সব গোপনীয়তা প্রকাশ না করার জন্য । তিনি আবারো বলেন: ‘ আমার অস্তিত্বে তুমি মিশে গেছো যেমন সুরার সাথে জল। যা তোমাকে স্পর্শকরে আমি তার স্পর্শপাই’ এবার শরীয়তি আইনে তাকে খারিজী ঘোষনা করা হয় এবং বাগদাদে অবাঞ্চিত করা হয় । মনসুর আল-হেল্লাজ ফিরে যান তার জন্মস্থান ইরানে । সমগ্র ইরান জুড়ে তিনি ছোটে বেড়ান সাধারন মানুষ কে ইসলামের প্রেমময়তা শিক্ষা দেবার জন্য এবং সবখানেই তিনি সাধারন মানুষের ভালোবাসা পান আর শাসক গোষ্ঠী ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গুলোর বিরাগভাজন হন। এর পর তিনি তার ৪০০ শিষ্য নিয়ে মক্বা শরীফে যান হজ্ব করার জন্য । সেখানে তাকে যাদুকর ও ভন্ড বলে তিরস্কার করা হয় এবং মক্বা নগরীর প্রবেশ দ্বার বন্ধ করে দেয়া হয় । ফিরে এসে মনসুর একা বেরিয়ে পড়েন ছোট্র নৌকা নিয়ে । সাগর পাড়ি দিয়ে আসেন ভারতে । গুজরাট, সিন্ধু হয়ে চলে যান চীন দেশে । সবখানেই তিনি তার স্বভাব অনুযায়ী হাজার হাজার সাধারন মানুষের সাথে মিশেন,কথা বলেন,ধর্মের অপার সৌন্দর্য্য ব্যখ্যা করেন এবং সবখানেই তিনি ব্যাপকভাবে আদৃত হন। মনসুর আবার ফিরে আসেন বাগদাদে । আবারো বাগদাদের সাধারন মানুষের সাথে শুরু হয় তার ভাবনা বিনিময় । তিনি সবাইকে বলেন: ‘যদি নিজেকে বিযুক্ত করা যায় সবকিছু থেকে তাহলে পৌঁছে যাওয়া যায় সেই অলৌকিকতায় যেখানে কিছুই বিযুক্ত নয় আর, কিছুই নয় সম্পৃক্ত’ এক পর্যায়ে মনসুর উচ্চারন করেন তার সবথেকে ভয়ংকর অথচ সুন্দর শব্দগুচ্ছ — ‘ আনাল হক’ । ‘আমিই সত্য’ । তার এই উচ্চারনে কেঁপে উঠে বাগদাদ তথা সমস্ত মুসলিম বিশ্ব। বলা হয় মনসুর নিজেকে আল্লাহ ঘোষনা করেছেন যেহেতু ‘ হক’ আল্লাহর ৯৯ নামের একটা । মনসুরকে প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তর দেন ‘ আল্লাহ সবখানে এবং সবকিছুতেই । আল্লাহ আমার মাঝে ও । তাই আমি ই সত্য’ কিন্ত প্রথা গত ধর্মব্যবস্থা তার ব্যখ্যায় খুশি হয়নি । এবার শরীয়া আইনে তাকে কাফের ঘোষনা করে বন্দী করা হয় । বন্দী হবার প্রথম দিন মনসুর জেলখানা থেকে অদৃশ্য হয়ে যান, দ্বিতীয় দিন তাকে সহ পুরো জেলখানাই অদৃশ্য হয়ে যায়, তৃতীয় দিন আবার দৃশ্যমান হন তিনি এবং জেলখানা । এ ঘটনায় সমস্ত বাগদাদ জুড়ে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। প্রধান ধর্মীয় পুরুষগন ছুটে যান তার কাছে । তিনি ঘটনার ব্যখ্যা দেন এভাবে: ‘প্রথম দিন আমি চলে গিয়েছিলাম মহানবী(সাঃ) কাছে, দ্বিতিয় দিন মহানবী(সাঃ) এসেছিলেন আমাকে দেখতে, তৃতীয় দিন আমি ফিরে এসেছি তার নির্দেশে শরীয়তকে সম্মান জানাতে’ ঐ জেলে সে সময় তিনশো বন্দি ছিলো । মনসুর তাদের বলেন ‘ তোমরা কি মুক্তি চাও?’ তারা পালটা প্রশ্ন করে ‘ওহে মনসুর ক্ষমতা থাকলে তুমি নিজেই মুক্ত হওনা কেন?’ তিনি জবাব না দিয়ে তাদের শিকলগুলোর দিকে চোখ মেলে তাকান । শিকল সব ভেং গে পড়ে । তিনি জেলখানার প্রধান ফটকের দিকে দৃষ্টি দেন । ফটক খুলে যায় । সব বন্দি বেরিয়ে যায় । পরদিন সকালে বিস্মিত নগর বাসী একা মনসুরকে বসে থাকতে দেখে জেলখানায় । তাদের প্রশ্নের উত্তরে এবার তিনি বলেন ” আমি আমার প্রভূর দেয়া শাস্তির অপেক্ষা করছি’ বন্দি মুক্তির ঘটনা শোনার সাথে সাথে আব্বাসীয় খলিফা তাকে ৩০০ দোররা এবং ফাঁসীর নির্দেশ দেন । শরীয়া আইন অনুযায়ী বাগদাদের তৎকালীন কাজি খলিফার এই নির্দেশনামায় স্বাক্ষর করেন । পরিহাস এই, সে সময় বাগদাদের কাজী ছিলেন মনসুরেরই আধ্যাতিক শিক্ষক হযরত জোনায়েদ । হযরত জোনায়েদ নির্দেশ নামায় স্বাক্ষর দিয়ে বলেন ‘ইসলামী আইন অনুযায়ী সে দোষী কিন্ত আসল সত্য তো এক আল্লাহই জানেন’ মনসুর কে জনসম্মুখে ৩০০ দোররা মারা হয় । মনসুর অবিচল,ভাবেলশহীন । হাজার হাজার সাধারন মানুষ বিস্ময় ভূলে চিৎকার দিয়ে উঠে ‘আনাল হক’ আনাল হক’ রক্তাক্ত মনসুরকে একজন প্রশ্ন করে ‘ ও মনসুর ইশক কি?’ মনসুর বলেন ‘ তোমরা ইশক দেখবে আগামী কাল ও তার পরদিন ‘ হাজর হাজার জনতার চিৎকারের মধ্য দিয়ে মনসুর কে নিয়ে যাওয়া হয় ফাঁসীর মঞ্চে । না মনসুরের মরদেহ কবর দেয়া হয়নি । শরীয়া আইনে ঘোষিত কাফের মনসুরের দেহ পুড়িয়ে ফেলা হয় এবং ছাই ভাসিয়ে দেয়া হয় টাইগ্রীস নদীতে পরদিন । মনসুরের ছাই ভাসানোর সাথে সাথে ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকে টাইগ্রীসের পানি । বাগদাদের সবাই ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠে ‘ এ বোঝি তাদের উপর আল্লাহর অভিশাপ’ পরদিন যখন টাইগ্রীসের পানি প্রায় ঢুকে পড়ছে শ হরের ভেতরে তখনই মনসুরের এ কজন শিষ্য মনসুরের ব্যবহৃত চামড়ার থলেটি ছুঁড়ে ফেলেন সেই পানিতে এবং সবাইকে আবারো বিস্মিত করে পানি ফিরে যায় টাইগ্রীসে । পরে সেই শিষ্য অন্যদের বলেন যে মনসুর তার মৃতু্যর আগেই এই থলেটি তার কাছে রেখে এরকম নির্দেশ দিয়েছিলেন ।
মনসুর হাল্লাজ ইতিহাস খ্যাত এক রহস্যময় পুরুষ। লোক সমাজে ওলী খ্যাত এ ব্যক্তিটির মূল নাম হুসাইন বিন মনসুর হাল্লাজ। এ ব্যক্তিটি সঠিক পথে ছিলেন কি না তা নিয়ে রয়েছে তুমুল বিতর্ক। তার আনালহক থিউরিটিই এ বিতর্কের অন্যতম প্রতিপাদ্য বিষয়। তবে তার সাথে সংশ্লিষ্ট বিবরণ, আলোচনা ও মনীষী পর্যায়ের বিদগ্ধ উলামায়ে কেরামের মন্তব্য পর্যালোচনা করলে তার সম্বন্ধে ভালো ধারণা পোষণ করাটা জটিল হয়ে পড়ে। উলামা মহলের একটি পক্ষ তাকে ওলীর আসনে সমাসীন করলেও তাদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। তৎকালীন যুগের উলামায়ে কেরামের সর্বসম্মত ফতওয়ার আলোকে তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিলো। মনসুর হাল্লাজ আনালহক তত্ত্বের যে ব্যাখ্যা প্রদান করেছিলেন তা বিদগ্ধ উলামা মহলে গৃহীত হয় নি। সারকথা তার ব্যাপারে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে না যাওয়াটাই নিরাপদ পন্থা। তাকে ওলীর আসনে বসিয়ে অতি মাতামাতি করারও কোনো প্রয়োজন নেই। আল্লাহর পক্ষ থেকে তার যা প্রাপ্তি তাই তিনি প্রাপ্ত হোন।