দীর্ঘ একটা সময় ধরে আমি অপরাধটি করছি। 'করছি' না বলে বলা উচিত 'করতে বাধ্য হচ্ছি'। অনেকবার অনেক নিস্তব্ধ মধ্যরাতে যে অনুশোচনায় ভুগিনি নি তা কিন্তু নয়। কখনও কখনও মনে হয়েছে, সব বলে দেই। যা হবার হবে এরপরে। কিন্তু কোনো অদৃশ্য ইশারায় আমি তা বলতে পারি নি হৃদিতাকে। কোনো বিকল্প উপায়ান্তরও খুঁজে পায় নি আমার অনুর্বর মস্তিষ্ক। আমি ভীতু প্রকৃতির মানুষ, জন্মগতভাবেই। কখনও খুব সাহস করে বড় কিছু চাইতেও পারি নি জীবনে। এ আমার এক জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতাই বৈ কি। কেবল এই সাহসের অভাবই হৃদিতাকে বলতে না পারার অন্যতম কারণ।
অফিস থেকে বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে ফিরেছি মাত্র। আমার শান্তিনগরের এক কামরার ছোট্ট রুম। টেবিলের উপরে আধখোলা করে রাখা একটি চিঠি। হৃদিতা গোটা গোটা হাতে মেয়েলী অক্ষরে এক সমুদ্র মায়া মিশিয়ে লিখেছে- "ওগো, কত দিন হয়ে গেলো তুমি বাড়িতে আসো না! আমার সঙ্গে রাগ করেছো খুব? রাগ করে দূরে দূরে থেকো না আর। বাড়িতে এসে আমাকে খুব করে বকে দাও। বকে তোমার বুকটাকে হালকা করো। তবুও তুমি আসো.....।" এই চিঠি একাধিক বার পড়া যায় না। সেই শক্তি একজন পুরুষকে দেয়া হয় নি। আমি হৃদিতার নামে ৭০০০ টাকা মানিঅর্ডার করার জন্য আবার ছাতা হাতে বেরিয়ে পড়লাম।
শান্তিনগরের এক কামরার এই রুমটিতে আমি আর শাহেদ থেকেছি প্রায় আড়াই বছর। রোজ রাত ৩ টায় ঘুম থেকে ওঠা ছিলো শাহেদের রুটিন। উঠেই চলে যেতো কলপাড়ে। ওজু করে এসে দাঁড়াতো তাহাজ্জুদে। দীর্ঘ সময় ধরে দাঁড়িয়েই থাকতো। মনে হতো যেন পাথর হয়ে গেছে। রুকুতে গিয়েও থাকতো অনেকক্ষণ। সিজদায় গেলে তো মনে হতো, শাহেদ আর জীবিত নেই। পাড়ি জমিয়েছে অন্য দুনিয়ায়। এতো অমায়িক ছেলে এ যুগে মেলা ভার। বিয়ে করেছিলো কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায়। এক বছরের মাথায় ঘরে এলো এক ফুটফুটে সন্তান। খবরটা শুনে আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো ছেলেটা। গ্রামে বউ আর বাচ্চার সঙ্গে থাকে কেবল বৃদ্ধা মা। ওর মাস শেষের পাঠানো ৭০০০ টাকাই তাদের বেঁচে থাকার সম্বল।
২০১৩ সালের মে মাসের ৫ তারিখ সকাল সাড়ে আটটা। শাহেদকে টুপি, পাঞ্জাবি আর পাজামা পরে বাইরে যাবার প্রস্তুতি নিতে দেখে পাশ ফিরে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। দরজা ভিজিয়ে বের হবার সময় শাহেদ গলা উঠিয়ে বললো, "আপনার জন্য ডাল পরোটা টেবিলের উপরে রাখা আছে মুনায়েম ভাই। তাড়াতাড়ি উঠে খেয়ে নিবেন। আমি শাপলা চত্বরের দিকে যাচ্ছি।" সে-ই তার শেষ উচ্চারণ। আর ফিরে আসে নি। অনেক ভোর সন্ধ্যা হয়েছে, অনেক সন্ধ্যা মিলিয়ে এসেছে ভোর। কেবল আসে নি শাহেদ। কোথায় হারিয়ে গেলো ছেলেটা! কোন সুদূরে! শাপলা চত্বরের অসংখ্য শহীদের মিছিলেই কি সে লুকিয়ে গিয়েছে? কোন অভিমানে?
টেবিলের উপরে হৃদিতার চিঠি- "আমাদের খোকন কতটা বড় হয়েছে জানো! তোমার কি একটুও দেখতে ইচ্ছে করে না? ও সারাক্ষণ 'হিজিবিজি' করে কথা বলে। আর মাঝে মাঝে বলে 'বাব্বা'। তোমার খোকনকে দেখতে আসবে না তুমি? আমার সঙ্গে না হয় রাগ করে আছো, কিন্তু তোমার খোকন তো কোনো দোষ করে নি। ওর নরম তুলতুলে শরীরের পরশ নিতে ইচ্ছে করে না তোমার? কেন এমন বদলে গেলে তুমি? ওগো....।" আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। একই সঙ্গে অনুশোচনা। বলতে না পারার অনুশোচনা যে, শাহেদ আর শাপলা চত্বর থেকে ফিরে আসে নি। ওর পাঠানো ৭০০০ হাজার টাকাই বউ, বাচ্চা আর বৃদ্ধা মায়ের সম্বল। আমি তখন থেকে এই টাকাটা পাঠিয়ে গিয়েছি। কখনও কখনও না খেয়ে থেকে হলেও পাঠিয়েছি। এই সময়টাতে খুব কম চিঠি পাঠায় নি হৃদিতা। এখনও সামনে খোলা আছে ওর শেষ চিঠিটা- "ওগো, প্লিজ তুমি একটিবার বাড়িতে আসো। মা যে তোমার জন্য কাঁদতে কাঁদতে অন্ধ হয়ে গেলো। ওগো...!"


শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে