'আমি কখনো ক্লাসের প্রথম বেঞ্চের ছাত্র ছিলাম না। প্রত্যেক ক্লাসেই আমার অবস্থান ছিল মধ্যম সারিতে। পুরো ছাত্রজীবনে কখনো কোনো শিক্ষক আমার দিকে বিশেষ নজরে তাকিয়েছেন বলেও মনে পড়ে না। কারণ, আমার মধ্যে ছিল না চোখে পড়ার মতো কোনো বিশেষত্ব। কিছু কিছু ছাত্র আছে, যাদের নিয়ে শিক্ষকমহল তো দূরের কথা, বন্ধুমহলেও কখনও আলোচনা হয় না। আমি ছিলাম ক্লাসের সেই অনালোচিত ছাত্রদের মিছিলে।
আমার ক্লাসমেটদের অধিকাংশই ছিল ধনী পরিবারের সন্তান। ক্লাসের ছেলে বন্ধুদের কাউকে কাউকে নিয়ে মেয়েমহলে ব্যাপক কৌতূহল বিরাজ করত বলে শুনতাম। কোনো কোনো ছেলেকে নাকি ওপরের ক্লাসের সিংহভাগ মেয়েরাই পছন্দ করত। তাদের কেউ কেউ বড়োলোক বাবার একমাত্র সন্তান; দামি ব্র্যান্ডের বাইক হাঁকিয়ে ক্লাসে আসত। পরনে থাকত হাজার টাকা দামের পোশাক। কলেজের অধিকাংশ মেয়েরাই হা করে তাকিয়ে থাকত তাদের দিকে।
অথচ আমি মেয়েমহলেও ছিলাম তুমুল অনালোচিত একজন। কখনো কোনো মেয়ে আমাকে পছন্দ করবে, স্বপ্ন দেখবে আমাকে ঘিরে; এ ছিল আকাশকুসুম কল্পনা। কারণ আমার চেহারা ছিল বিশেষত্বহীন। পরিবারের ছিল না কোনো সামাজিক অবস্থান কিংবা টাকা-পয়সা। ধনী আত্মীয়-স্বজনদের কাছেও আমি নিদারুণ অবহেলিত ছিলাম। কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গেলে বিরক্তিতে ভ্রু কুঞ্চিত করত তারা। কিন্তু আমার ধনী চাচাত ভাই-বোনদের ঠিকই তুলোতুলো করা হতো।
কৈশোর আর তারুণ্যের সন্ধিক্ষণের সময়টা থেকে একটি মেয়েকে আমি ভীষণ পছন্দ করতাম। এ পছন্দ, এ ভালোলাগা ছিল কদর্যতার অনেক অনেক উর্ধ্বে। শুভ্র, স্নিগ্ধ, হৃদয় আবেশ করা এক অনুভূতি ছিল সেটা। সে অনুভূতিতে কখনোই প্রবেশ করতে পারেনি অন্ধকারের কালিমা। আমি আমার মনের গোপন কন্দরে সযতনে আগলে আগলে রাখতাম তাকে। অথচ মেয়েটি কখনোই জানতে পারেনি তা। একা একা ভালোবেসে যাওয়ার মধ্যে অদ্ভূত এক সুখ আছে বৈকি!
আমি কল্পনায় তার সঙ্গে ঘর বাঁধার স্বপ্ন বুনতাম। খেলতাম চড়ুইভাতি চড়ুইভাতি খেলা। কখনো ভালোবাসতাম, কখনো বাঁধাতাম তুমুল ঝগড়া। আমার কল্পনার সে রাজ্যে বাঁধ সাধতে আসবে; এমন সাধ্য কার! বছরের পর বছর কেটে গেল, আমি মেয়েটিকে বলতে পারলাম না। কারণ আর কিছু নয়—তার আর আমার পরিবারের মধ্যকার সামাজিক অবস্থানের ব্যবধান। কেবলই অপেক্ষা করলাম তার সত্যিকার যোগ্য হয়ে উঠবার; যেদিন মাথা উঁচু করে তার বাবা-মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াব।
কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি। আমার আব্বার মৃত্যুর ১৭ দিনের মাথায় বিয়ে হয়ে গেল মেয়েটির। বড়োলোক স্বামীর সাথে প্যারিসে চলে গেল সে। পরপর দুটি ধাক্কা বুকে নিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রামে পথে নামলাম। জীবন তখন আমার কাছে নির্মম হয়ে ধরা দিয়েছে। কোথাও কোনো প্রশান্তি নেই। একটা চাকরির খোঁজে চষে বেড়ালাম ঢাকা শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। সবখানেই নিষ্ঠুরভাবে প্রত্যাখ্যাত হলাম। কেউ একটা চাকরি দেওয়ার যোগ্য মনে করল না আমাকে।
অবশেষে একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি হলো। তারা যে বেতন দিত, তা দিয়ে ঢাকা শহরে চলা ছিল একপ্রকার অসম্ভব। দাঁত কামড়ে পড়ে থাকলাম তবুও। কারণ আমার যাবার মতো কোনো জায়গা ছিল না। অথচ আমার হাত দিয়েই সাতটি প্রজেক্ট সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছিল কোম্পানির। তারা লক্ষ লক্ষ টাকা লাভবান হয়েছিল। তবুও একদিন অযোগ্যতার অজুহাতে চাকরিচ্যুত করা হলো আমাকে। আটতলা অফিস থেকে সেদিন লিফট দিয়ে নামলাম না, সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে নেমে এলাম নিচে।
আমি জানলাম না—অফিস থেকে সেদিন এভাবে নেমে আসাটাই ছিল আমার জীবনে ওপরে ওঠার সিঁড়ি। এরপর ঘুরে গেল জীবনের মোড়। নিজের সঙ্গে জেদ করে পরিশ্রম করতে শুরু করলাম। কত সন্ধ্যা ভোর হলো, কত ভোর সন্ধ্যা হলো; তার হিসেব রাখলাম না। পরিশ্রম আমার সামনে একে একে অবমুক্ত করে দিতে লাগল সৌভাগ্যের দরজা। আজ আমি এত বড়ো একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক, আমার অধীনে চাকরি করে ২১ হাজার কর্মী; ঢাকা শহরে নিজস্ব দুটি প্লট করেছি; এসবই সম্ভব হয়েছে প্রথম জীবনে পাওয়া মানুষের উপেক্ষাগুলোর কারণে।'
কথাগুলো একটানা বলে থামলেন আসিফ ভাই। আমি তন্ময় হয়ে তাকিয়ে আছি তার দিকে, তাকিয়ে আছি একজন আত্মনির্মিত মানুষের মুখপানে। সেখানে ক্লান্তি নেই, অভিমান নেই; বরং অবিরাম ছুটে চলার নেশা, বড়ো হবার দৃঢ়প্রত্যয়। জীবনে বড়ো হবার জন্য মানুষের উপেক্ষার চাইতে শক্তিশালী সিঁড়ি আর কিছু নেই। উপেক্ষা মানুষকে জেদি বানায়, সাফল্যের জন্য ক্ষুধার্ত বানায়৷ আসিফ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আমার মনে পড়ল বিশ্বকবির গানের চরণ—
'তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী,
আমি অবাক হয়ে শুনি কেবল শুনি...।'



শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে