ঘড়িতে তখন রাত ২ টা ১৮। রাতুল এক বুক অভিমান নিয়ে ঝুলে পড়লো ঘরের সিলিং ফ্যানটার সঙ্গে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার সতেজ দেহটা ছটফট করতে করতে নীরব হয়ে গেলো। আত্মীয়-পরিজনহীন দূর দেশে এক অভিমানী তরুণের সদা প্রাণোচ্ছল দেহটা ঝুলে রইলো সকাল অব্দি। কেউ জানলো না তার পোড়খাওয়া বুকটাতে হাজার মাইল দূরের বাংলাদেশে রেখে আসা প্রিয়তমা স্ত্রীর জন্য কতটা ভালোবাসা আর অভিমান লুকানো ছিলো।
শ্রাবণের এক বাদলাঝরা সন্ধ্যায় অনেক আড়ম্বরের সাথে সিমথীর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিলো রাতুলের। কন্যাবিদায়ের মুহূর্তে যখন সিমথী তার বাবা-মা-ভাইকে জড়িয়ে ব্যাকুল হয়ে কাঁদছিলো, তখন রাতুলের চোখও খানিকটা ছলছল করে উঠেছিলো। গভীর মমতায় আদ্র হয়ে ভাবছিলো মেয়েদের জীবনের কথা। মেয়েদের জীবন সত্যিই অদ্ভূত। জীবনের মাঝপথে এসে সম্পূর্ণ নতুন একদল মানুষের সঙ্গে জীবন শুরু করতে হয়। রাতুল মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো, যে মেয়ে তার জীবনের সব প্রিয় মানুষদের ছেড়ে শুধু তার কাছে চিরদিনের জন্য চলে আসছে, তাকে একটুও কষ্ট পেতে দিবে না কোনো দিন।
বিয়ের পর প্রতি রাতে বাসায় ফেরার সময় সিমথীর জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসতো রাতুল। এক রাতে অনেকগুলো বকুল ফুলের মালা নিয়ে উপস্থিত হলো। সিমথী বিস্ময়ে চিৎকার করে বললো- “ও মাগো! এগুলো আমার জন্য!!” রাতুল মাথা ঝুঁকিয়ে বললো, “হ্যাঁ মহারাণী।” সিমথী রাতুলের হাত ধরে বললো, “তুমি এতো ভালো কেন বল তো?” রাতুল মুচকি হেসে জবাব দিলো, “তোমায় ভালোবাসি, তাই।” বিয়ের পর মধুচন্দ্রিমায় কক্সবাজার গিয়ে রাতের সমুদ্র সৈকতে দাঁড়িয়ে রাতুল সিমথীকে জিজ্ঞেস করেছিলো, “প্রিয়তমা, আমায় কখনও ছেড়ে যাবে না তো?” সিমথী দুই পা সমুদ্রের পানিতে ভিজিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে জবাব দিয়েছিলো, “এই বিশাল সমুদ্র সাক্ষী, এই রাতের আকাশ সাক্ষী, আমি তোমাকে কখনোই ছেড়ে যাবো না।”
বছর ঘুরতেই রাতুল-সিমথীর ঘর আলোকিত করে এলো তাদের সন্তান সিয়াম। বাবা মায়ের প্রথম সন্তান হলো একটা জীবন্ত পুতুল। এই পুতুল হাসলে বাবা-মা হাসে, এই পুতুল কাঁদলে বাবা-মাও কাঁদে। সন্তানের হাসি কান্নাই হয়ে উঠলো রাতুল আর সিমথীর হাসি-কান্না। স্ত্রী-সন্তানের আরেকটু উন্নত ভরণ-পোষণের জন্য বাইরে যাবার চেষ্টা করছিলো রাতুল। বছর দুয়েক বাইরে থেকে কিছু ক্যাপিটাল করে দেশে ফিরতে পারলে ছোটখাটো একটা ব্যবসা দাঁড় করিয়ে দিব্যি চলে যাবে দিন। রাতুলের এক দুঃসম্পর্কের মামা থাকেন উলানবাটোরে। অনেক চেষ্টা তদবিরের পর সেখানে বেশ ভালো বেতনের একটা চাকরি হয়ে গেলো রাতুলের।
মঙ্গোলিয়া চলে যাবার দিন ব্যাকুল হয়ে কাঁদলো সিমথী। সিয়ামকে রেখে চলে যেতে বুক ফেঁটে যাচ্ছিলো রাতুলের। জীবনের প্রয়োজনে কত হতভাগা বাবাকে এভাবে বুকে পাথর বেঁধে দূর দেশে গিয়ে পড়ে থাকতে হয়, কে রাখে তার হিসেব! এরপর নিয়মিত ভিডিও কলে কথা হতো স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে। সিয়ামের মধুর হাসিতে কাজ করার বাড়তি উদ্যোম পেতো যেন। মাস ছয়েক অতিবাহিত হবার পরের সিমথীর আচরণে পরিবর্তন লক্ষ্য করছিলো রাতুল। কথায় আগের মতো আন্তরিকতা নেই। সবসময় ব্যস্ততার অজুহাত দেখাতে লাগলো। আগে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেও যেন তৃপ্তি হতো না দুজনের, আর এখন একটুতেই বিরক্ত হয়ে ওঠে সিমথী। এক অব্যক্ত মনোঃকষ্ট কুরে কুরে খাচ্ছিলো রাতুলকে।
সিমথী পালালো ডিসেম্বরের ১৯ তারিখ রাতে। সিয়ামকে রেখে গেলো তার দাদীর কাছে। ফেসবুকে পরিচয়। ছেলেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। অনেক ধনী পরিবারের সন্তান। দেখতে শুনতে ভীষণ স্মার্ট। নাম সুমন। সিমথী আর সুমন প্রায়ই রাত জেগে ফোনে কথা বলতো। সিমথীর মনে হতে লাগলো, সে এক অন্য দুনিয়ার সন্ধান পেয়ে গেছে। এতোদিন যে সংসারে ছিলো, সেটা নিতান্তই এক বদ্ধ কূয়া। সুমনের মতো একজন ড্যাম স্মার্ট, শিক্ষিত ছেলেকেই সে ডিজার্ভ করে। রাতুল সুমনের মতো রোমান্টিক নয়। সিমথীর মতো রূপবতী, শিক্ষিতা তরুণীর তার টানাটানির সংসারে পড়ে থাকার কি মানে থাকতে পারে!
রাতুলের লাশবাহী গাড়িটি বিমানবন্দর থেকে এগিয়ে চলছে তার গ্রামের বাড়ির দিকে। গাড়িতে ফ্রিজিং করে শুইয়ে রাখা হয়েছে এক অভিমানী তরুণকে, যে তার স্ত্রী-সন্তানকে আরেকটু ভালো রাখার স্বপ্ন নিয়ে একদিন দেশ ছেড়েছিলো। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধরে আরেকটি গাড়ি এগিয়ে চলছিলো কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে। এ গাড়িটি সুমনের নিজস্ব। ড্রাইভিং সিটের পাশেই সুমনের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে সিমথী। তার চোখে-মুখে একটি নতুন দুনিয়ার স্বপ্ন। সে দুনিয়ায় রাতুল কিংবা সিয়ামের কোনো অস্তিত্ব নেই। সেখানে কেবলই সুমন। যে একদিন সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে এক পবিত্র বন্ধনের সঙ্গীকে কথা দিয়েছিলো, ““এই বিশাল সমুদ্র সাক্ষী, এই রাতের আকাশ সাক্ষী, আমি তোমাকে কখনোই ছেড়ে যাবো না।”



শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে