আত্মহত্যা একটি সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি সমাজের বিভিন্ন শিরায় উপশিরায় প্রবেশ করেছে। হত দরিদ্র পরিবারে নিম্নমানের জীবনযাপন করা মানুষ যেমন আত্মহত্যা করে তেমন উন্নত পরিবারে বিলাসবহুল জীবনযাপন করা মানুষও আত্মহত্যা করে। ভিন্ন পেশার ভিন্ন ধরণের মানুষ বিভিন্ন কারণে আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যা বা সুইসাইড বলতে মানুষ যখন নিজেই নিজের মৃত্যু ঘটায়। অর্থাৎ স্বেচ্ছায় নিজের জীবন বিসর্জন করে কিন্তু সেটা কোনো মহৎ কাজে নয়।



'মানুষ সামাজিক জীব' এটি এরিস্টটলের সেই বিখ্যাত উক্তি। মানুষ নিজ প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে একে অপরের কাছে সাহায্যের সহযোগিতার বা সময় কাটানোর জন্য এগিয়ে আসে। এভাবেই গড়ে একটি পরিবার, একটি সমাজ, একটি রাষ্ট্র। কখনো কখনো মানুষ বিশেষ কোনো কারণে মানুষ পরিবার বা সমাজচ্যুত হয়ে সামাজিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। তখন সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।


বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী প্রতিবছর বিশ্বে আট লাখ লোক আত্মহত্যা করে। মৃত্যুর হার প্রতি লাখে ১৬ জন। প্রতি ৪০ সেকেন্ডে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে একটি। বিশ্বে বর্তমানে ১৫ থেকে ৪৪ বছর বয়সী মানুষের মৃত্যুর প্রধান তিনটি কারণের মধ্যে একটি হচ্ছে আত্মহত্যা। বাংলাদেশে আত্মহত্যার জাতীয় কোনো পরিসংখ্যান নেই। স্থানীয় গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে আত্মহত্যার হার প্রতি লাখে ৬ থেকে ১০ জন , যা উন্নত বিশ্বের কাছাকাছি।


প্রতিটি আত্মহত্যা করার পিছনে সুনির্দিষ্ট একটি কারণ থাকে। কারণ ছাড়া পৃথিবীতে কোনো কিছু ঘটে না। আত্মহত্যার জন্য যে যে কারণগুলো হতে পারে।


* বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় হতাশাগ্রস্থ ;

* পরিবার, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব থেকে      

দূরে কোথাও একাকিত্ব জীবনযাপন ;

* জীবনের কোনো লক্ষ্য উদ্দেশ্য ঠিক করতে না পারা ;

* প্রেমে ব্যর্থতা গ্লানি নিতে না পারা;

* প্রত্যাশিত কাজে অসফলতা হওয়া;

* প্রতারণার ফাঁদে পা দেয়া ;

* প্রিয় মানুষগুলোর থেকে নানান রকমের অবহেলা পাওয়া;

* ধর্ষণের লজ্জা থেকে মুক্তি পেতে ;

* স্বামীর সীমাহীন নির্যাতনের স্বীকার হওয়া ;

* অতিরিক্ত ঋণের চাপ নিতে না পেরে ;

* বিবাহে জটিলতা থাকায় ;

* অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের পর বিবাহ করতে অস্বীকার;

* পরীক্ষার প্রত্যাশিত ফলাফল না পাওয়া ;

* যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বেকার থাকা ;

* স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীদের বাড়তি চাপ ও র‌্যাগিংয়ে দিশেহারা ;

* জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে হেনস্থার শিকার ;

* চরমভাবে আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হওয়া, 

* পারিবারিক দ্বন্দ্ব ;

* আত্মবিশ্বাসের অভাব ইত্যাদি।



এমন হাজারো কারণে মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। তখন তাদের উপর চাপটা এতোটাই বেশি হয়ে যায় এবং তারা মনে করেন এর কোনো সমাধান করা যাবে না। তারপর তারা জীবন থেকে পালানোর চেষ্টা করে এবং আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এই মুহুর্তে আত্মহত্যার পথটাই তার কাছে সবচেয়ে সহজ এবং কার্যকর সমাধান মনে করে । সবশেষে তারা তাই করে।


আত্মহত্যা করার জন্য বেশ কিছু পদ্ধতি প্রচলন রয়েছে। এর মধ্যে জনপ্রিয় হলো গলায় দড়ি দেয়া, বিষ খাওয়া, কীটনাশক খাওয়া, চলতি গাড়ির (বাস ট্রাক বা ট্রেন) নিচে ঝাঁপিয়ে পড়া, পানিতে ঝাঁপ দেয়া (যারা সাঁতার জানেন না), আগ্নেয়াস্ত ব্যবহার, স্লিপিং পিল ইত্যাদি। তাছাড়াও এমন জানা অজানা হাজারো নতুন পুরাতন পদ্ধতি রয়েছে।


এভাবে তারা নিজের জীবন নিজে নেয়। তখন তাদের মাথা ঠিক থাকে না। সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ দ্বারা এটা করা কখনোই সম্ভব নয়। অনেকের মনে প্রশ্ন, তাহলে কি এর কোনো সমাধান নেই? অবশ্যই আছে। যেখানে সমস্যা আছে সেখানে সমাধানও আছে। যখন থেকে একটা সমস্যার সৃষ্টি হয় তখন থেকে সমাধানও সৃষ্টি হয়। আত্মহত্যা সমস্যা সমাধানের কি কি উপায় হতে পারে দেখা যাক।


১. ছোট বেলা থেকেই বাচ্চাদের ধর্মচর্চা ও ধর্মবিশ্বাস জাগ্রত করতে হবে। কেননা কোনো ধর্মেই আত্মহত্যার ব্যাপারে কোনোভাবেই সমর্থন করে না।


২. নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি করতে হবে। নারীর প্রতি নারী পুরুষ সবার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে।নারী নির্যাতন রোধ করা এবং তাদের মতামতে গুরুত্ব দেওয়া।


৩. বিশেষ পরামর্শ নেওয়া ব্যবস্থা সহজতর করতে হবে। যেন ডিপ্রেশন চলে যাওয়া ব্যক্তি সহজেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক বা কাউন্সিলরদের পরামর্শ নিতে পারে।


৪. সামাজিক বন্ধন বৃদ্ধি করতে হবে। পরিবারের সদস্যদের সাথে যেন দূরত্ব না বেড়ে যায়। সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে পাশাপাশি সদস্যদের সাথে‌ বন্ধুসুলভ আচরণ করতে হবে। ফলে সহজেই সকল সমস্যায় শেয়ার করতে পারে।


৫. ঘরে একাকিত্ব জীবনযাপন না করে সঠিক বন্ধুদের সাথে মিশতে হবে এবং তাদের সাথে খেলাধুলা করতে হবে। তাহলে দেহ এবং মন দুটোই ভালো থাকবে।


৬. আত্মহত্যার উপকরণ সহজপ্রাপ্তি রোধ করতে হবে। যেমন হতে পারে কীটনাশক ও স্লিপিং পিল প্রেসক্রিপশন ছাড়া বিক্রি বন্ধ করা।


৭. মাঝে মধ্যে পরিবার অথবা বন্ধুবান্ধবের সাথে কোথায় ভ্রমনে বের হওয়া। এতে মন ভালো থাকবে এবং সুস্থ থাকবে।


৮. পছন্দের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করা। অনেক সময় অপছন্দ কাজে করতে করতে বিরক্তি চলে আসে। পছন্দের কাজে মনোযোগ দিতে হবে ।


৯. শরীরচর্চামূলক কাজ করা। শরীরের সাথে মনের গভীর সম্পর্ক। শরীর ভালো থাকলে মন ভালো থাকে। এজন্য নিয়মিত হাঁটাহাঁটি, ব্যায়াম , সাঁতার কাটা ইত্যাদি করা।


এছাড়াও আত্মহত্যা প্রতিরোধে বেশ কিছু করনীয় তা হলঃ 


আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তিকে চোখে চোখে রাখা।

মানসিকভাবে ভেঙে পড়া ব্যক্তিকে মানসিক সমর্থন করা।

আত্মহত্যার বিষয়ে সচেতন বৃদ্ধি করা।

সৃজনশীল কাজে মনোনিবেশ করা।

বইপড়া, মনীষীদের জীবনী ও বাণী পড়া ইত্যাদি।



একবার চোখ খুলে ভালো করে তাকিয়ে দেখুন এবং কিছুক্ষণ ভাবুন আমাদের পৃথিবী কত সুন্দর এবং বৈচিত্র্যময়! মাথার উপর সুনীল আকাশ চারপাশে সবুজ শ্যামলে ভরপুর। আপনার দিকে তাকিয়ে আছে আপনার পরিবারের প্রিয় মুখগুলো। জাতি আপনার কাছ থেকে ভালো কিছু প্রত্যাশা করছে।

তাই কবি বলেছেন,


“মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে

মানবের মাঝে বাঁচিবার চাই।”


কবি ও সাংবাদিক

সুজন চন্দ্র দাস

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।


শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে