“ছবির মতন সুন্দর” কথাটিও সিকিমের জন্য খাটে না। বাস্তবে “ভারতের” এই অঙ্গরাজ্যটি ছবির চেয়েও বেশি সুন্দর। পাহাড়ে-পাথরে-সবুজে-তুষারে সিকিমকে পর্যটকদের জন্য বলা যায় আরেক ভূস্বর্গ। দু’হাজার একুশে এসে সিকিমকে ভারতের অঙ্গরাজ্য হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হলেও অনেকেরই জানা নেই সিকিম কিন্তু ছিল আলাদা একটি রাষ্ট্র। ১৯৪৭ সালের বৃটিশ শাসনের শেষভাগে বৃটিশরা উপমহাদেশের রাজ্যগুলোকে স্বাধীনতার ব্যাপারে তাদের অবস্থান স্থির করতে বলায় সিকিম, হায়দরাবাদ, জম্মু, কাশ্মীর জানিয়ে দেয় তারা না ভারত, না পাকিস্তানে যোগ দেবে। তারা থাকতে চায় স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে। কিন্তু এই থাকতে চাওয়াটা ভারতের যথারীতিই পছন্দ হয়নি। সিকিমকে ধীরে ধীরে ভারতের অংশ করে নেয়ার জন্য যা যা করা প্রয়োজন তারা তাইই করেছে। সে গল্প অনেক লম্বা, কেবল জানিয়ে রাখি সিকিম পাকাপাকিভাবে ভারতের গহ্বরে ঢুকে পড়ে ১৯৭৫ সালে। একসময়ের স্বাধীন রাজ্যটি ভাগ্যে জোটে ভারতের দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম অঙ্গরাজ্যের তকমা। এদিকে তার মাত্র ক’মাস বাদেই সিকিমের কয়েকশ মাইল দূরেই ঘটতে থাকে একের পর এক ঘটনা-দুর্ঘটনা, যা ভারতের আদিপত্যবাদীদের কপালে গভীর ভাজ ফেলতে থাকে। এক সেনা-অভ্যুথানে সপরিবারে নিহত হন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব। দফায় দফায় অভ্যুথান-পাল্টা অভ্যুথানের শেষ অংকে বাংলাদেশের সিপাহী-জনতার বিপ্লবে পর্দায় হাজির হন জিয়াউর রহমান নামের ব্যক্তির, যার উথানে বাংলাদেশের ইতিহাস বাক নেয় অন্য এক পথে। এটা অনস্বীকার্য, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ রক্তস্নাত স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকা ছিল বেশ জোরালো। তাদের মানবিকতায় রক্ষা পায় অজস্র শরণার্থীর প্রাণ। কিন্তু এই সহযোগিতা কিংবা মানবিকতার পেছনে কি কেবলই মানবতা ছিল নাকি অন্য কোন উদ্দেশ্যে ছিল, সেটা বাংলাদেশীরা ঠাওরাতে শুরু করে স্বাধীনতার পরপরই। কাগজে-কলমে “স্বাধীন” বাংলাদেশের প্রতিটা ইস্যুতে ভারত বা ভারতপন্থীদের প্রভাব ছিল সুস্পষ্ট। অভিযোগ আছে, ৭২এর সংবিধানের খসড়ার অনুমোদন নিতেও দিল্লী ছুটেছিলেন এইদেশের নীতিনির্ধারকেরা। একটা সদ্যস্বাধীন দেশকে সাহায্য-সহযোগিতার বদলে কি করে তাকে ভারতের প্রতি নতজানু করে রাখা যায়, দাবিয়ে রাখা যায় এই চিন্তাটাই পার্শ্ববর্তী দেশটির সরকারের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। ৭১-৭৫এ পার্শ্ববর্তী দেশটির গোয়েন্দাদের বাংলাদেশের মাটিতে সরব উপস্থিতি আপনি ওই সময়ের বইগুলোতে ভালোমতই পাবেন। আর শেখ মুজিব ভারতকে ফারাক্কা বাধ চালুর অনুমতি দিয়ে যে সর্বনাশ ডেকে এনেছিলেন, তার ঝাজ তো আজো তুলছে বাংলাদেশ। পাশাপাশি ভারত কেমন বাংলাদেশ চায় সেটা বুঝতে সিকিম-হায়দরাবাদের ইতিহাস পড়া বাদ দিয়ে কেবল জহরওলাল নেহেরুর সেই বিখ্যাত কথাটি স্মরণ করলেই চলবে,”পৃথিবীতে ছোট ছোট রাষ্ট্রের কোন ভবিষ্যৎ নেই। তাদেরকে বড় রাষ্ট্রের সাথে মিশে যেতে হবে।” যে কোন স্বাধীনচেতা কোন ব্যক্তির পক্ষে এটা মেনে নেয়া অবশ্যই কষ্টকর, আর যদি সেটা জিয়াউর রহমানের মতন সম্মুখসমরে স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া ব্যক্তি হন তার অনুভূতি তো সহজেই অনুমেয়। স্বাধীনতা মানে কাগজে-কলমে-বক্তৃতার মধ্যে আটকে থাকা গলাবাজি না, সত্যিকারের স্বাধীনতা মানে আমার নিজের পছন্দে নিজের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতাটুকু। ভারতের সাথে জিয়াউর রহমানের গোলটা বাধে এখানেই। জিয়া প্রথম দফাতেই বাংলাদেশের এই ভারতমুখিতা রুখতে চেয়েছেন। ফারাক্কা বাধের কারণে পানির হিস্যা না পাওয়াকে তিনি টেনে নিয়ে গেছেন জাতিসংঘ পর্যন্ত। তার চেষ্টাতে ভারত বাধ্য হয় সেবার পানির ন্যায্য হিস্যা দিতে। কিন্তু জিয়া বুঝতে পেরেছিলেন, ভারতের সর্বগ্রাসী হা বন্ধ করা তার একার পক্ষে সম্ভব হবে না। অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ার সামগ্রিক উন্নতির জন্য জিয়া চেয়েছিলেন উন্নত বিশ্বের মতন এমন একটা প্লাটফরম যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো পারস্পরিক সাম্যতা আর সহযোগিতার ভিত্তিতে নিজেদেরকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করবে। একদিকে এই সার্ক যেমন হবে আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী রক্ষাকবচ অন্যদিকে ধনাত্মক অর্থে একটা শক্তিশালী আঞ্চলিক সহযোগিতার প্লাটফর্ম। কষ্টের ব্যাপার হচ্ছে সার্কের সমস্ত খসড়া জিয়া করে রাখলেও তার বাস্তবায়ন দেখে যেতে পারেননি। এটুকু নিশ্চিত করে বলা যায়, জিয়াউর রহমান বেচে থাকলে বাংলাদেশ তো বটেই, এই দক্ষিণ এশিয়ার চিত্রটা অনেকখানিই ভিন্ন হতো। আমরা অভাগা বলেই হয়তো তা হয়ে উঠেনি! ব্যক্তি জিয়াউর রহমানের অনেকগুলো পরিচয় আছে। সে সব কিছু ছাপিয়ে আমি জিয়াউর রহমানকে দেখি একজন সফল স্টেটসম্যান হিসেবে। জিয়াউর রহমান যেমন আমাদের “বাংলাদেশী” পরিচয়টা হাতে তুলে দিয়েছেন, আত্মমর্যাদা-স্বজাত্যবোধ-স্বাধীনতার সংজ্ঞা বুঝিয়েছেন তেমনি বাংলাদেশকে সিকিম কিংবা ভারতের "ভেসেল স্টেট" হবার ভাগ্যবরণ থেকে বাচিয়ে দিয়েছেন। তার স্বপ্নের সার্ক হয়তো ফাংশনাল হয়ে উঠতে পারে নি দেশী-বিদেশী অশুভ শক্তির কারণে, কিন্তু তিনি আমাদের শিখিয়েছেন কি করে নিজের ভাগটা বুঝে নিতে হয়, কিভাবে নেগোশিয়েট করতে হয়, পারি আর না পারি কি করে লড়াই করে যেতে হয়। এই ক্ষণজন্মা মহাপুরুষের জন্মদিনে রইলো বিনম্র শ্রদ্ধার্ঘ্য। হাতজোড় করে প্রার্থনা করি, মহান আল্লাহ যেন তার পারলৌকিক জীবনকে অনাবিল প্রশান্তিতে ভরিয়ে দিন। তার মতাদর্শ, তার চিন্তায়, তার চেতনায়, তার স্পর্ধায় যদি নিজেদেরকে আলোকিত করতে পারি, তবেই একজন সত্যিকারের “বাংলাদেশী” হয়ে উঠতে পারবো। আর স্বজাত্যবোধ-স্বাধীনতার যেই পরিচয় তিনি আমাদের দিয়েছেন, সেটাকে ধারণ করে তার প্রতি একনিষ্ঠ থেকেই কেবল তার প্রতি সুবিচার করা সম্ভব,অন্য কোন উপায়েই নয়!


শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে