বাইরের জগতের সাথে মক্কার সংযুক্তি ঘটিয়েছে যে ‘অদ্দান’ উপত্যকাটি, সেখানেই ছিল ‘গিফার’ গোত্রের বসতি। মক্কার কুরাইশদের বাণিজ্য কাফিলা ওখান দিয়ে সিরিয়া যাতায়াত করত। এসব  কাফিলার নিরাপত্তার বিনিময়ে যে সামান্য অর্থ লাভ করতো তা দিয়েই তারা জীবিকা নির্বাহ করতো। ডাকাতি, রাহাজানিও ছিল তাদের পেশা। যখন কোন বাণিজ্য কাফিলা তাদের দাবী অনুযায়ী খাদ্যসামগ্রী বা অর্থ আদায় করত না তখন তারা লুটতরাজ চালাতো।

জুনদুন ইবন জুনাদাহ, আবু যার নামেই যিনি পরিচিত- তিনিও ছিলেন এ কবীলারই সন্তান। বাল্যকাল থেকেই তিনি অসীম সাহস, প্রখর বুদ্ধিমত্তা ও দূরদৃষ্টির জন্য ছিলেন সকলের থেকে স্বতন্ত্র। জাহিলী যুগে জীবনের প্রথম ভাগে তাঁর পেশাও ছিল রাহাজানি। ‘গিফার’ গোত্রের একজন দুঃসাহসী ডাকাত হিসেবে তিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তবে কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর জীবনে ঘটে গেল এক বিপ্লব। তাঁর গোত্রীয় লোকেরা এক আল্লাহ ছাড়া যে সকল মূর্তির পূজা করত, তাতে তিনি গভীর ব্যথা অনুভব করতে শুরু করেন। সমগ্র আরব বিশ্বে সে সময় যে ধর্মীয় অনাচার, অন্ধ বিশ্বাস ও কুসংস্কারের সয়লাব চলছিল তা তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করেন। তিনি অধীরভাবে অপেক্ষা করতে থাকেন এমন একজন নবীর, যিনি মানুষের বুদ্ধি-বিবেক ও অন্তরকে পরিচ্ছন্ন করে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে তাদের নিয়ে আসবেন।

তিনি রাহাজানি পরিত্যাগ করে একাগ্রচিত্তে আল্লাহর ইবাদাতের দিকে ঝুঁকে পড়েন, যখন সমগ্র আরব দেশ গুমরাহীর অতল গহ্বরে নিমজ্জিত ছিল। হযরত আবু মা’শার বলেনঃ ‘আবু যার জাহিলী যুগেই মুওয়াহহিদ বা একত্ববাদী ছিলেন। এক আল্লাহ ছাড়া কাকেও তিনি উপাস্য বলে বিশ্বাস করতেন না, অন্য কোন মূর্তি বা দেবদেবীর পূজাও করতেন না। তাঁর বিশ্বাস ও আল্লাহর ইবাদাত মানুষের কাছে পরিচিত ছিল। এ কারণে যে ব্যক্তি সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহর সা. আবির্ভাবের সংবাদ তাঁকে দিয়েছিল, বলেছিলঃ

‘‘আবু যার, তোমার মত মক্কার এক ব্যক্তি ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলে থাকেন।’’

তিনি কেবল মুখে মুখেই তাওহীদে বিশ্বাসী ছিলেন না, সেই জাহিলী যুগে নামাযও আদায় করতেন। এ সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেছেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহর সা. সাথে সাক্ষাতের তিন বছর পূর্ব থেকেই নামায আদায় করতাম।’ লোকেরা জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কাকে উদ্দেশ্য করে?’ বললেনঃ ‘আল্লাহকে।’ আবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘কোন দিকে মুখ করে?’ বলেছিলেনঃ ‘যে দিকে আল্লাহ ইচ্ছা করতেন।’

তাঁর ইসলাম গ্রহণের ঘটনাটিও বেশ চমকপ্রদ। ইবন হাজার ‘আল-ইসাবা’ গ্রন্থে তাঁর ইসলাম গ্রহণের কাহিনী সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। সংক্ষেপে এভাবে বলা যায়, তিনি তাঁর গোত্রের সাথে বসবাস করছিলেন। একদিন সংবাদ পেলেন, মক্কায় এক নতুন নবীর আবির্ভাব হয়েছে। তিনি তাঁর ভাই আনিসকে ডেকে বললেনঃ ‘তুমি একটু মক্কায় যাবে। সেখানে যিনি নিজেকে নবী বলে দাবি করেন এবং আসমান থেকে তাঁর কাছে ওহী আসে বলে প্রচার করে থাকেন, তাঁর সম্পর্কে কিছু তথ্য সংগ্রহ করবে, তাঁর মুখের কিছু কথা শুনবে। তারপর ফিরে এসে আমাকে অবহিত করবে।’

আনিস মক্কায় চলে গেলেন। রাসূলুল্লাহর সা. সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁর মুখনিঃসৃত বাণী শ্রবণ করে নিজ গোত্রে ফিরে এলেন। আবু যার খবর পেয়ে তখুনি ছটে গেলেন আনিসের কাছে। অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে নতুন নবী সম্পর্কে নানা কথা তাকে জিজ্ঞেস করতে শুরু করলেন। আনিস বললেনঃ

– ‘কসম আল্লাহর। আমি তো লোকটিকে দেখলাম, মানুষকে তিনি মহৎ চরিত্রের দিকে আহবান জানাচ্ছেন। আর এমন সব কথা বলেন যা কাব্য বলেও মনে হলো না।’

‘মানুষ তাঁর সম্পর্কে কী বলাবলি করে?’

– ‘কেউ বলে তিনি একজন যাদুকর, কেউ বলে গণক, আবার কেউ বলে কবি।’

– ‘আল্লাহর কসম! তুমি আমার তৃষ্ণা মেটাতে পারলে না, আমার আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে সক্ষম হলে না। তুমি কি পারবে আমার পরিবারের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে, যাতে আমি মক্কায় গিয়ে স্বচক্ষেই তাঁর অবস্থা দেখে আসতে পারি?’

– ‘নিশ্চয়ই। তবে আপনি মক্কাবাসীদের সম্পর্কে সতর্ক থাকবেন।’

পরদিন প্রত্যুষে আবু যার চললেন মক্কার উদ্দেশ্যে। সংগে নিলেন কিছু পাথেয় ও এক মশক পানি। সর্বদা তিনি শঙ্কিত, ভীতচকিত। না জানি কেউ জেনে ফেলে তাঁর উদ্দেশ্য। এ অবস্থায় তিনি পৌঁছলেন মক্কায়। কোন ব্যক্তির কাছে মুহাম্মাদ সা. সম্পর্কে কোন কথা জিজ্ঞেস করা তিনি সমীচীন মনে করলেন না। কারণ, তাঁর জানা নেই এ জিজ্ঞাসিত ব্যক্তিটি মুহাম্মাদের সা. বন্ধু না শত্রু।

দিনটি কেটে গেল। রাতের আঁধার নেমে এল। তিনি ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। বিশ্রামের উদ্দেশ্যে তিনি শুয়ে পড়লেন মাসজিদুল হারামের এক কোণে। আলী ইবন আবী তালিব যাচ্ছিলেন সে পথ দিয়েই। দেখেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, লোকটি মুসাফির। ডাকলে, ‘আসুন আমার বাড়ীতে।’ আবু যার গেলেন তাঁর সাথে এবং সেখানেই রাতটি কাটিয়ে দিলেন। সকাল বেলা পানির মশক ও খাবারের পুটলিটি হাতে নিয়ে আবার ফিরে এলেন মসজিদে। তবে দু’জনের একজনও একে অপরকে কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না।

পরের দিনটিও কেটে গেল। কিন্তু নবীর সংগে পরিচয় হলো না। আজও তিনি মাসজিদেই শুয়ে পড়লেন। আজও  আলী রা. আবার সে পথ দিয়েই যাচ্ছিলেন। বললেনঃ ব্যাপার কি, লোকটি আজও  তাঁর গন্তব্যস্থল চিনতে পারেনি? তিনি তাকে আবার সঙ্গে করে বাড়িতে নিয়ে গেলেন। এ রাতটিও সেখানে কেটে গেল। এদিনও কেউ কাউকে জিজ্ঞেস করলেন না। একইভাবে তৃতীয় রাতটি নেমে এলো। আলী রা. আজ বললেনঃ

– ‘বলুন তো আপনি কি উদ্দেশ্যে মক্কায় এসেছেন?’

তিনি বললেন, ‘আপনি যদি আমার কাছে অঙ্গীকার করেন আমার কাঙ্ক্ষিত বিষয়ের দিকে আমাকে পথ দেখাবেন, তাহলে আমি বলতে পারি।’ আলী রা. অঙ্গীকার করলেন।

আবু যার বললেনঃ

‘আমি অনেক দূর থেকে মক্কায় এসেছি, নতুন নবীর সাথে সাক্ষাৎ করতে এবং তিনি যেসব কথা বলেন তার কিছু শুনতে।’

আলীর রা. মুখমণ্ডল আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললেন, ‘আল্লাহর কসম, তিনি নিশ্চিত সত্য নবী।’ একথা বলে তিনি নানাভাবে নবীর সা. পরিচয় দিলেন। তিনি আরও বললেন, ‘‘সকালে আমি যেখানে যাই, আপনি আমাকে অনুসরণ করবেন। যদি আমি আপনার জন্য আশংকাজনক কোন কিছু লক্ষ্য করি তাহলে প্রস্রাবের ভান করে দাঁড়িয়ে যাব। আবার যখন চলবো, আমাকে অনুসরণ করে চলতে থাকবেন। এভাবে আমি যেখানে প্রবেশ করি আপনিও সেখানে প্রবেশ করবেন।’’

প্রিয় নবীর দর্শন লাভ ও তাঁর ওপর অবতীর্ণ প্রত্যাদেশ শ্রবণ করার প্রবল আগ্রহ ও উৎকণ্ঠায় আবু যার সারাটি রাত বিছানায় স্থির হতে পারলেন না। পরদিন সকালে মেহমান সংগে করে আলী রা. চললেন রাসূলুল্লাহর সা. বাড়ীর দিকে। আবু যার তাঁর পেছনে পেছনে। পথের আশপাশের কোন কিছুর প্রতি তাঁর কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। এভাবে তাঁরা পৌঁছলেন রাসূলুল্লাহর সা. নিকট। আবু যার সালাম করলেন।

– ‘আস-সালামু আলাইকা ইয়া রাসূলুল্লাহ।’ রাসূল সা. জবাব দিলেন,

– ‘ওয়া আলাইকাস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ ওয়া বারাকাতুহ।’

এভাবে আবু যার সর্বপ্রথম ইসলামী কায়দায় রাসূলুল্লাহকে সা. সালাম পেশ করার গৌরব অর্জন করেন। অতঃপর সালাম বিনিময়ের এ পদ্ধতিই গৃহীত ও প্রচারিত হয়।

রাসূল সা. আবু যারকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন এবং কুরআনের কিছু আয়াতও তিলাওয়াত করে শুনালেন। সেখানে বসেই আবু যার কালেমায়ে তাওহীদ পাঠ করে নতুন দ্বীনের মধ্যে প্রবেশের ঘোষণা দিলেন।

এর পরের ঘটনা আবু যার এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ ইসলাম গ্রহণের পর রাসূলুল্লাহর সা. সংগে আমি মক্কায় অবস্থান  করতে লাগলাম। তিনি আমাকে ইসলামের নানান বিষয় শিক্ষা দিলেন, কুরআনের কিছু আয়াত পাঠের প্রশিক্ষণও দিলেন। আমাকে বললেনঃ ‘মক্কায় কারও কাছে তোমার ইসলাম গ্রহণের কথা প্রকাশ করবে না। কেউ জানতে পেলে আমি তোমার জীবনের আশংকা করছি।’

বললাম, ‘যার হাতে আমার জীবন, তাঁর শপথ করে বলছি, আমি মক্কা ছেড়ে যাবনা, যতক্ষণ না মাসজিদে গিয়ে কুরাইশদের মাঝে প্রকাশ্যে সত্যের দাওয়াত দিচ্ছি।’ রাসূল সা. চুপ হয়ে গেলেন।

আমি মাসজিদে এলাম। কুরাইশরা তখন একত্রে বসে গল্প গুজব করছে। আমি তাদের মাঝখানে হাজির হয়ে যতদূর সমস্ত উচ্চকণ্ঠে সম্বোধন করে বললাম, ‘‘কুরাইশ গোত্রের লোকেরা! আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি এক আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, মুহাম্মাদ সা. আল্লাহর রাসূল।’’

আমার কথাগুলি তাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই তারা ভীত-চকিত হয়ে পড়লো। একযোগে তারা লাফিয়ে উঠে বললঃ এই ধর্মত্যাগীকে ধর। তারা দৌড়ে এসে আমাকে বেদম প্রহার শুরু করলো। রাসূলের সা. চাচা আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিব দেখে চিনতে পারলেন। তাদের হাত থেকে বাঁচানের জন্য তিনি আমার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। তারপর তাদের লক্ষ্য করে বললেন, তোমরা নিপাত যাও! গিফারী গোত্রের এবং তোমাদের বাণিজ্য কাফিলর গমনাগমন পথের লোককে হত্যা করছো? তারা আমাকে ছেড়ে দিল।

একটু সুস্থ হয়ে আমি রাসূলুল্লাহর সা. কাছে ফিরে গেলাম। আমার অবস্থা দেখে তিনি বললেন, ‘তোমাকে ইসলাম গ্রহণের কথা প্রকাশ করতে নিষেধ করেছিলাম না?’ বললাম, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! নিজের মধ্যে আমি প্রবল ইচ্ছা অনুভব করছিলাম। সে ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছি মাত্র।’ তিনি বললেন, ‘‘তোমার গোত্রের কাছে ফিরে যাও। যা দেখে গেলে এবং যা কিছু শুনে গেলে তাদের অবহিত করবে, তাদের আল্লাহর দিকে আহ্‌বান জানাবে। হতে পারে আল্লাহ তোমার দ্বারা তাদের উপকৃত করবেন এবং তোমাকে প্রতিদান দেবেন। যখন তুমি জানবে, আমি প্রকাশ্যে দাওয়াত দিচ্ছি, আমার কাছে চলে আসবে।’’

আমি ফিরে এলাম আমার গোত্রীয় লোকদের আবাসভূমিতে। আমার ভাই আনিস এলো আমার সংগে সাক্ষাৎ করতে। সে জিজ্ঞেস করলোঃ ‘কি করলেন?’ বললাম, ‘ইসলাম গ্রহণ করে বিশ্বাসী হয়েছি।’ তক্ষুণি আল্লাহ তাঁর অন্তর-দুয়ার উন্মুক্ত করে দিলেন। সে বলল, ‘আপনার দ্বীন প্রত্যাখ্যান করার ইচ্ছা আমার নেই। আমি ইসলাম গ্রহণ করে বিশ্বাসী হলাম।’ তারপর আমরা দু’ভাই একত্রে আমাদের মায়ের কাছে গিয়ে তাঁকেও ইসলামের দাওয়াত দিলাম।’ ‘তোমাদের দু’ভাইয়ের দ্বীনের প্রতি আমার কোন অনীহা নেই’- একথা বলে তিনিও ইসলাম কবুল করার ঘোষণা দিলেন।

সেইদিন থেকে এই বিশ্বাসী পরিবার নিরলসভাবে গিফার গোত্রের মানুষের নিকট ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতে থাকে। এ কাজে কখনও তারা হতাশ হননি, কখনও মনোবল হারাননি। তাঁদের আপ্রাণ চেষ্টায় এ গোত্রের বিপুল সংখ্যক লোক ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তাদের মধ্যে নামাযের জামায়াত প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে এক দল লোক বলে, আমরা আমাদের ধর্মের ওপর অটল থাকবো। রাসূলুল্লাহ সা. মদীনায় এলো আমরা ইসলাম গ্রহণ করবো। রাসূলের সা. মদীনায় হিজরতের পর তারাও ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। এ গিফার গোত্র সম্পর্কে রাসূল সা. বলেছেনঃ ‘‘গিফার গোত্র- আল্লাহ তাদের ক্ষমা করেছেন, আর আসলাম গোত্র- আল্লাহ তাদের শান্তি ও নিরাপত্তা দিয়েছেন।’’

আবু যার মক্কা ফিরে এসে গোত্রীয় লোকদের সাথে মরুভূমিতে অবস্থান করতে থাকেন। একে একে বদর, উহুদ ও খন্দকের যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল। অতঃপর তিনি মদীনায় এলেন এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে রাসূলুল্লাহর সা. সাহচর্য অবলম্বন করলেন। তিনি রাসূলুল্লাহর সা. কাছে আবেদন করলেন তাঁর খিদমতের সুযোগ দানের জন্য। তাঁর এ আবেদন মঞ্জুর করা হল। মদীনায় অবস্থানকালে সবটুকু সময় তিনি অতিবাহিত করতেন রাসূলুল্লাহর সা. সেবায়।


ওফাতঃ

হযরত আবু জর গিফারী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু’র ওফাতঃ

৩২ হিজরী। আবু জর গিফারী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এঁর ওফাতের  সময় উপস্থিত হয়েছে। নির্জন মরুভূমিতে তিনি আর তাঁর স্ত্রী একা। রাবাতাহ  ছিলো এমন একটি যায়গা যেখান দিয়ে সাধারণত একেবারেই লোক চলাচল হতো না, তার উপর সে সময়টা এমন ছিলো যখন কোন বাণিজ্য কাফেলাও যাতায়াত করতো না।। মৃত্যুপথযাত্রী আবু জর গিফারী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু-এঁর অবস্থা দেখে তাঁর স্ত্রী ব্যাকুল হয়ে পড়লেন কোনো সাহায্যের আশায়। স্ত্রীর এ অবস্থা দেখে আবু জর গিফারী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু বললেন;

:চিন্তা করো না, আমি রাসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আ’লিহি ওয়াছাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, তিঁনি বলেছেন; তোমাদের মধ্যে এখানকার একজনের মৃত্যু হবে নির্জন মরুভূমিতে। কিন্তু তার মৃত্যুর সময় মুমিনদের একটি দল সেখানে উপস্থিত হবে। আমি নিশ্চিত সে ব্যক্তিটিই আমি, কারণ সেদিন আমরা যারা সেখানে উপস্থিত ছিলাম তাদের সবাই মৃত্যুবরণ করেছেন। কেবল আমিই বাকী। তুমি পথের দিকে খেয়াল রাখ। নিশ্চয়-ই আল্লাহর রাসূল মিথ্যা বলেন নি।”

আবু জর  গিফারী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু কিছুক্ষনের মধ্যেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন। আবু জর গিফারী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু-এঁর  স্ত্রী একবার স্বামীর কাছে আরেকবার উঁচু টিলার উপর উঠে দূরে খেয়াল করতে লাগলেন। এ অসময়ে কে আসবে এই অপ্রচলিত পথে এই চিন্তায় তিনি অস্থির হয়ে পড়লেন। অবশেষে দূরে দেখা গেল ধুলোর ঝড় তুলে একদল লোক এদিকেই আসছে।

কাফেলাটি এসে আবু জর গিফারী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু-কে  অসহায় অবস্থায় দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন;

:এ লোকটি কে? ”

তাঁর স্ত্রী উত্তর করলেন;

:ইনি  আবু জর।”

লোকেরা বললেন;

:রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আ’লিহি ওয়াছাল্লাম-এঁর সাহাবী আবু জর?”

তাঁর স্ত্রী বললেন;

:হ্যাঁ।”

লোকেরা অত্যন্ত অস্থির হয়ে বললেন;

:আমাদের জান কুরবান হোক”।

তাঁরা দ্রুত আবু জর গিফারী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু-এঁর জানাজা ও দাফন সম্পন্ন করলেন। প্রখ্যাত সাহাবী আবদুল্লাহ্ ইবনে  মাসউদ গিফারী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু  তাঁর জানাজার সালাত পড়ান।

এমনিভাবে আবু জর গিফারী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু ইসলাম গ্রহণের পর থেকে তাঁর জীবন অতিবাহিত করেছেন দুনিয়াবিমুখ হয়ে কেবলমাত্র আল্লাহ  আর তাঁর রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আ’লিহি ওয়াছাল্লাম-এঁর আনুগত্যের মাধ্যমে।

একদিন যে লোকটি ওয়াদান (তাঁর জন্মস্থান) ভ্যালীর আতঙ্ক আর ত্রাসের নাম ছিলো, সে ব্যক্তিটিই একদিন নির্লোভ আর দুনিয়াবিমুখতার দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন।

ঈমানের মাধ্যমে আল্লাহ  সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা তাঁর অন্তরকে এমনই পরিবর্তন করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ  ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আ’লিহি ওয়াছাল্লাম-কে তিঁনি এতই ভালবাসতেন যে তাঁর  ওফাতের  পর যখনই তিঁনি রাসুল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আ’লিহি ওয়াছাল্লাম-এঁর কথা মনে করতেন, তখনই অঝোর ধারায় কাঁদতেন।

অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যপার এই যে,  এই দুর্ধর্ষ মানুষটি সম্পর্কে-ই রাসূলুল্লাহ   ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আ’লিহি ওয়াছাল্লাম বলেছেন,

”আকাশের নিচে এবং পৃথিবীর উপর আবু জরের চেয়ে বিশ্বাসী ও সত্যবাদী আর কেউ নেই”।

আহ! একেই বলে,আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আ’লিহি ওয়াছাল্লাম-এঁর প্রতি ভালোবাসা। এমন ভালোবাসা কেউ যদি বাসতে  পারে তাহলে দুনিয়ার সম্পদকে লাত্থি দিয়ে আখেরাতে চিরস্থায়ী সম্পদ অর্জন করা তাঁর লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়।

আয় রাব্বে কারীম, আবু জর গিফারী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু’র দরজাকে কোটি কোটি গুনে বুলন্দ করে দাও। এবং তিঁনি যেভাবে তোমাকে ও তোমার রাসূল  ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আ’লিহি ওয়াছাল্লাম-কে ভালোবেসেছেন,সে ভালোবাসার ফল্গুধারা আমাদের অন্তরে প্রবাহিত করে দাও।

আ’মীন।


শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে