একটি পারমানবিক বোমা দিয়ে কতটুক জায়গা ধংস করাযায় ? এই বোমার এত শক্তি কেন ? এবং এই বোমার নাম " পারমানবিক " রাখা হয়েছে কেন ?
শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে

পারমাণবিক অস্ত্র এমন এক ধরনের যন্ত্র যা নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার ফলে প্রাপ্ত প্রচণ্ড শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের সৃষ্টি করে। সে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া ফিসানের ফলে অথবা ফিসান ও ফিউশান উভয়েরই সংমিশ্রনেও সংঘটিত হতে পারে। উভয় বিক্রিয়ার কারণেই খুবই অল্প পরিমাণ পদার্থ থেকে বিশাল পরিমাণে শক্তি নির্গত হয়। আধুনিক এক হাজার কিলোগ্রামের একটি থার্মো-নিউক্লিয়ার অস্ত্রের বিস্ফোরন ক্ষমতা প্রচলিত প্রায় ১ বিলিয়ন কিলোগ্রামের প্রচণ্ড বিস্ফোরক দ্রব্যের চেয়েও বেশি। এভাবেই শুধুমাত্র প্রচলিত বোমার সমান আকারেই একটি পারমাণবিক বোমা দ্বারাই একটি শহরকে ধ্বংস করে দেয়া যায়। পারমাণবিক অস্ত্রকে ধরা হয় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের এক বোমা হিসেবে। একারণেই আন্তজার্তিক বিভিন্ন নিয়ম- নীতিমালা প্রণয়নে তাদের ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণ সবসময়ই একটি আলোকিত বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। এটি যে কারণে শক্তিশালী;; এই বোমা তৈরির জন্য যে পদার্থটি ব্যবহৃত হয় তার নাম ইউরেনিয়াম (Uranium). বিজ্ঞানীরা সংক্ষেপে পদার্থটির নাম বোঝানোর জন্য শুধু এর প্রথম অক্ষরটি (U) ব্যবহার করেন। ইউরেনিয়াম অত্যন্ত ভারী তেজস্ক্রিয় পদার্থ। ভূ-পৃষ্ঠের উপরিভাগে এ পদার্থের পরিমাণ শতকরা ০.০০৪% ভাগ। ভূ-ত্বকের ৬.৪০ কিলোমিটার গভীর পর্যন্ত এর মজুদের পরিমাণ প্রায় ১৩,০০,০০,০০,০০,০০,০০০ টন। আফ্রিকার বলিভিয়ান কঙ্গোতে এবং কানাডার গ্রেট বিয়ার হৃদ এলাকায় এর আকরিক পাওয়া গেছে। এছাড়াও অ্যারিজোনা, ক্যালিফোর্নিয়া, কলোরাডোতেও অল্পবিস্তর ইউরেনিয়ামের আকরিকের সন্ধান পাওয়া গেছে। আকরিক থেকে শোধন করে ইউরেনিয়াম আইসোটোপ পাওয়া যায়। যেমন- ইউরেনিয়াম-২৩৮, যার পারমাণবিক ওজন ২৩৮ অর্থাৎ এর নিউক্লিয়াসে আছে ৯২টি প্রোটন এবং ১৪৬টি নিউট্রন। প্রকৃতিতে এধরনের আইসোটোপই বেশিমাত্রায় পাওয়া যায়। এক হিসাবে দেখা গেছে শতকরা ৯৯.৩% ভাগই এ জাতীয় ইউরেনিয়াম। দ্বিতীয় আইসোটোপটির নাম ইউরেনিয়াম-২৩৫ অর্থাৎ এর নিউক্লিয়াসে আছে ৯২টি প্রোটন এবং ১৪৩টি নিউট্রন। প্রকৃতিতে এদের পরিমাণ শতকরা মাত্র ০.৭% ভাগ। তৃতীয় প্রকারের আইসোটোপের পরিমাণ একেবারেই নগণ্য, যা প্রায় হিসেবের মধ্যেই ধরা হয় না। পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য ব্যবহৃত হয় ইউরেনিয়াম-২৩৫। ইউরেনিয়াম-২৩৮ কে নিউট্রন কণা দ্বারা আঘাত করলে নিউট্রন এর নিউক্লিয়াসে ঢুকে পড়ে এবং সামান্য সময়ের জন্য এর পারমাণবিক ওজন দাঁড়ায়-২৩৯। ইউরেনিয়াম পরমাণুটি সাথে সাথে দুটো নিউক্লিয়ার ইলেকট্রন অর্থাৎ দুটি বীটা রশ্মি ত্যাগ করে প্লুটোনিয়াম পরমাণুতে পরিণত হয়। প্লুটোনিয়ামের পারমাণবিক ওজন হয়-২৩৯। কিন্তু ইউরেনিয়াম-২৩৫ এর বেলায় প্লুটোনিয়াম হয় না। বিজ্ঞানী অটোহ্যান ইউরেনিয়াম-২৩৫ এর উপর শক্তিশালী নিউট্রন নিক্ষিপ্ত করে ভিন্ন ব্যাপার অবলোকন করেন। আসলে বিজ্ঞানী অটোহ্যানের এই পরীক্ষার ফলাফলই হলো পারমাণবিক বোমা তৈরির মূল তত্ত্ব। ইউরেনিয়াম-২৩৫ এর উপর নিউট্রন আঘাত করলে ইউরেনিয়াম পরমাণুটি দুটো পৃথক অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তার মানে ইউরেনিয়াম ধ্বংস হয়ে নতুন মৌলিক পদার্থের সৃষ্টি করে। এই নতুন পদার্থের একটির নাম বেরিয়াম পরমাণু এবং অপরটি ক্রিপটন পরমাণু। বেরিয়াম এবং ক্রিপটন পরমাণু সৃষ্টি হবার সাথে সাথে তিনটি নতুন নিউট্রন কণা এবং বিপুল পরিমাণ শক্তির সৃষ্টি করে। সৃষ্ট এই তিনটি নিউট্রন পরমাণু অন্য তিনটি অক্ষত ইউরেনিয়াম পরমাণুকে আঘাত করে এবং একই পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি ঘটে। ইউরেনিয়াম পরমাণুর খন্ডিত হওয়ার এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় বিভাজন বিক্রিয়া বা ফিউশন বিক্রিয়া। পরমাণু বিভাজন হওয়ায় যে নতুন নিউট্রন কণার জন্ম দেয় তা আবার অন্য পরমাণুকে আঘাত করে। এভাবেই বিক্রিয়াটি চলতে থাকে ধারাবাহিক ভাবে। যাকে বলা হয় Chain Reaction. কিন্তু শক্তির সৃষ্টি হয় কেমন করে ওটাই হলো আসল কথা। যেহেতু ইউরেনিয়াম একটি তেজস্ক্রিয় পদার্থ সেজন্য সে স্বতঃস্ফুর্তভাব ে রশ্মি বিকিরণ করে এবং স্থায়িত্ব আনার চেষ্টা করে। কিন্তু এর স্থায়িত্ব কম বলে এর নিউক্লিয়াস অন্য পরমাণুর নিউক্লিয়াসের তুলনায় সহজে ভেঙ্গে যায়। বিভাজন প্রক্রিয়াটি ঘটে যাওয়ার পর ইউরেনিয়াম পরমাণুর অস্তিত্ব লোপ পেয়ে যায় এবং সাথে সাথে কিছু পদার্থের ক্ষয় হয়। তার মানে দুটো নতুন পদার্থ বেরিয়াম এবং এবং ক্রিপটন তৈরি হয়। তাদের মোট ওজন ইউরেনিয়ামের মোট ওজনের চেয়ে কিছু কম হয়। এই হারানো ওজন শক্তিতে পরিণত হয়। পদার্থ যে শক্তিতে রূপান্তরিত হয় তা বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের আগে কেউ ভাবতে পারেননি। বিজ্ঞানী আইনস্টাইনই সর্বপ্রথম ভরশক্তি বিষয়ে সূত্র দেন। পরবর্তী সময় বিজ্ঞানী করক্রফট এবং ওয়াগটন তেজস্ক্রিয় পদার্থের বিভাজনের উপর পরীক্ষা করে আইনস্টাইনের ভরশক্তি (E=MC2) সূত্রের সত্যতা প্রমাণ করেন। ইউরেনিয়াম-২৩৫ এর বিভাজন বিক্রিয়া ঘটার সময় সামান্য পরিমাণ ভরশক্তিতে রূপান্তরিত হয়। এখানে E মানে শক্তি (Energy), M মানে ভর (Mass)এবং C2 মানে আলোর গতির দ্বিগুণ (Speed of light multiplied by itself). এটাতে দেখানো হয়েছে যে, একটি অতি ক্ষুদ্র ভরই একটি বড় শক্তিতে রূপান্তরিত হতে পারে। তাহলে এভাবে এক পাউন্ড (০.৫ কিলোগ্রাম) ইউরেনিয়াম-২৩৫ পদার্থ যদি এই প্রক্রিয়ায় একসাথে শক্তিতে রূপান্তরিত হয় তাহলে কত শক্তির সৃষ্টি হবে? দেখা গেছে, এক পাউন্ড ইউরেনিয়াম-২৩৫ একসাথে বিভাজিত হলে যে শক্তির সৃষ্টি হবে তার পরিমাণ ১০ মিলিয়ন শর্ট টন (৯ মিলিয়ন মেট্রিক টন) টিএটি। পারমাণবিক বিস্ফোরণের কারণে যে শক্তি বের হয় তা তাপ শক্তি, যান্ত্রিক শক্তি এবং বিদ্যুৎ শক্তিতে আত্নপ্রকাশ করে বিপুল ধ্বংস সাধন করে। আগুন এবং প্রচন্ড উত্তাপ সৃষ্টি করে বোমা নিক্ষিপ্ত স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। ইউরেনিয়াম বিভাজনের জন্য অধিক বেগসম্পন্ন নিউট্রন কণার দরকার হয়। এখানে নিউট্রন হয় প্রক্ষেপক অর্থাৎ একে বুলেটের সাথে তুলনা করা হয়। উৎস থেকে নিউট্রন বুলেটটি বের হওয়ার পর এর গতি বাড়ানোর জন্য যে যন্ত্রগুলো ব্যবহার করা হয় তাহলো - কসমোটোন, বেবাট্রোন, সাইক্লোট্রোন, সিনকোসাই ক্লোটেন ইত্যাদি। এসব যন্ত্র নিউট্রন কণার গতিকে ত্বরান্বিত করে প্রচন্ড বেগে ইউরেনিয়াম পরমাণুর উপর নিক্ষেপ করতে সাহায্য করে। গতিবর্ধক হিসেবে এ ধরনের একটি যন্ত্র ভেনডিগ্রাফ বৈদ্যুতিক জেনারেটর দ্বারা পারমাণবিক বোমার ভেতরে সংযুক্ত থাকে। পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য নিউট্রন কণার তুলনা নেই। এ কণাটির কোনো চার্জ নেই। তাই কণাটি যখন পরমাণুর নিউক্লিয়াসের কাছে যায় তখন কোনো বিকর্ষণ বল অনুভূত হয় না। তাই এটা অতি সহজে এবং অল্প শক্তিতে পরমাণুর নিউক্লিয়াসে প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু প্রোটন, ডিউটারণ এবং আলফা কণা এরা সবাই ধনাত্নক চার্জ বহন করে। তাই এগুলোকে বুলেট হিসেবে পরমাণুর উপর নিক্ষেপ করলে বিকর্ষণ ফল হবে। তাই এরা সহজে নিউক্লিয়াসে প্রবেশ করতে পারে না। পারমানবিক অস্ত্র এমন এক ধরনের যন্ত্র যা নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার ফলে প্রাপ্ত প্রচন্ড শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের সৃষ্টি করে। সে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া ফিসানের ফলে অথবা ফিসান ও ফিউশান উভয়েরই সংমিশ্রনেও সংঘঠিত হতে পারে। উভয় বিক্রিয়ার কারণেই খুবই অল্প পরিমাণ পদার্থ থেকে বিশাল পরিমাণে শক্তি নির্গত হয়। আধুনিক এক হাজার কিলোগ্রামের একটি থার্মো- নিউক্লিয়ার অস্ত্রের বিস্ফোরন ক্ষমতা প্রচলিত প্রায় ১ বিলিয়ন কিলোগ্রামের প্রচন্ড বিস্ফোরক দ্রব্যের চেয়েও বেশি। এভাবেই শুধুমাত্র প্রচলিত বোমার সমান আকারেরই একটি পারমানবিক বোমা দ্বারাই একটি শহরকে ধ্বংশ করে দেয়া যায়। পারমানবিক অস্ত্রকে ধরা হয় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের এক বোমা হিসেবে। একারণেই আন্তজার্তিক বিভিন্ন নিয়ম- নীতিমালা প্রনয়নে তাদের ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রন সবসময়ই একটি আলোকিত বিষয় হয়ে দাড়ায়।

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ