উপকথা
অক্ষরের আবিষ্কার কিভাবে হয়েছে, তার সঠিক ইতিহাস জানা যায় না। তাই অক্ষরের উৎপত্তি নিয়ে নানান দেশে নানান ধরনের উপকথা সৃষ্টি হয়েছে।
চীনদেশের উপকথা থেকে জানা যায়, সাং চিয়েন(Ts'ang Chien) নামক ড্রাগনমুখো এক লোক আনেক দিন আগে চীনা অক্ষর তৈরি করেছিলেন।
পাখির ঠোঁটের মত মাথাওয়ালা আর মানুষের শরীরওয়ালা দেবতা থথ(Thoth) মিশরীয় অক্ষর সৃষ্টি করেছিলেন।
হিন্দু দেবতা ব্রহ্মা ভারতবর্ষে একটি প্রাচীন লিপি আবিষ্কার করেন। ব্রহ্মার নাম অনুসারে ওই অক্ষর বা লিপির নাম হয়েছে ব্রাহ্মীলিপি।
নৃতত্ব অনুসারে, প্রকৃতপক্ষে ছবি থেকে এসেছে চিত্রলিপি এবং চিত্রলিপি থেকে সৃষ্টি হয়েছে লিপি বা অক্ষরের। পঁচিশ হাজার বছরেরও আগের গুহার দেয়ালে বা পাথরের গায়ে আঁকা ছবির নমুনা আবিষ্কৃত হয়েছে। হাজার হাজার বছরের বিবির্তনের ফলে কোনো কোনো চিত্র চিত্রলিপিতে পরিবর্তিত হয়েছে এবং আরও পরে হয়েছে অক্ষর বা বর্ণ। যতটুকু জানা যায়, ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত ফিনিশিয়া(Phoenicia) দেশে চিত্রলিপি থেকে প্রথম ২২টি অক্ষরের সৃষ্টি হয়েছিল। তবে ওই লিপির সবগুলোই ছিল ব্যঞ্জনবর্ণ। গ্রিক ও হিব্রু জাতি ফিনিশীয়দের নিকট থেকে ওই সব লিপি গ্রহণ করেছিল। গ্রিকদের অক্ষরের সংখ্যা ছিল ২৪টি। ওরা ব্যঞ্জনবর্ণের সঙ্গে স্বরবর্ণের ব্যবহার চালু করেছিল। পরে গ্রিকদের কাছ থেকে অক্ষর গ্রহণ করে রোমানরা। ওদের অক্ষর সংখ্যা ছিল ২৩টি। রোমানরা এক সময় জয় করে নিয়েছিল গ্রেট ব্রিটেন। ব্রিটেনবাসীরা গ্রহণ করে রোমান হরফ। পাঁচটি স্বরবর্ণ এবং একুশটি ব্যঞ্জনবর্ণ নিয়ে মোট ছাব্বিশটি অক্ষর দিয়ে গঠিত হয় ইংরেজি বর্ণমালা।
অনেক পন্ডিত মনে করেন, প্রাচীন ফিনিশীয় লিপি থেকে সৃষ্টি হয়েছে ব্রাহ্মীলিপির। কিন্তু সিন্ধুর মহেনজোদারো এবং পাঞ্জাবের হরপ্পা সভ্যতা আবিষ্কৃত হওয়ার ফলে পন্ডিতদের এ ধারণা পাল্টে গেছে। তাঁরা এখন মনে করেন, বিদেশী লিপির প্রভাব থাকলেও প্রাচীন ভারতবাসীরা নিজেরাই স্বধীনভাবে লিপি আবিষ্কার করেছে এবং সিন্ধূলিপি ব্রাহ্মীলিপির পূ্বসূরি। অবশ্য মহেনজোদারো ও হরপ্পার লিপি এখনও কেউ পড়ে উঠতে পারেন নি। ঋগ্বেদে একধিকবার অক্ষর কথাটির উল্লেখ আছে এবং ঐতরেয় ব্রাহ্মণেও অক্ষর শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। খ্রিষ্টের জন্মের পাঁচশ বছর আগে থেকে ৩৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রাচীন ভারতবর্ষে ব্রাহ্মীলিপি চালু ছিল। এ লিপির প্রথম বিবর্তন লক্ষ্য করা যায় অশো্কলিপি বা মৌর্যলিপিতে এর পরের স্তর পাওয়া যায় কুষানলিপি। প্রথম থেকে তৃ্তীয় খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে কুষানরাজাদের আমলে এ লিপির প্রচলন ছিল বলে এ লিপির এই নামকরণ হয়েছে। এরপর ব্রাহ্মীলিপিকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। একটি উত্তরী আর একটি হল দক্ষিণী। উত্তরীর মধ্যে আছে গুপ্তলিপি(চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত প্রচারিত)। গুপ্তলিপি থেকে সৃষ্টি হয়ছে কুটিল লিপি(ষষ্ঠ থেকে নবম শতাব্দী পর্যন্ত প্রচারিত)। কুটীল লিপি থেকে উদ্ভব হয়েছে নাগরিক লিপির। প্রাচীন নাগরী বা উত্তর ভারতীয় কুটীল লিপির পূর্ব শাখা থেকে উৎপত্তি হয়েছে বংলা লিপি বা অক্ষরের। দশম শতাব্দীর শেষ ভাগে মূল বংলা বর্ণমালার উদ্ভব হয়েছে বলে জানা যায়। কম্বোজের রাজা নয়পালদেবের ইর্দার দানপত্রে এবং প্রথম মহীপালের বাণগড়ের দানপত্রে সর্বপ্রথম আদি বাংলা বর্ণমালা দেখতে পাওয়া যায়। বাংলা অক্ষর দুই রকম- স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণ। অ, আ, ই, ঈ ইত্যাদি এগারোটি স্বরবর্ণ এবং ক, খ, গ, ঘ ইত্যাদি ঊনচল্লিশটি ব্যঞ্জনবর্ণ। বংলা ভাষায় মোট অক্ষরের সংখ্যা ৫০। এদের বলা হয় বর্ণমালা।
অক্ষর কোনো একক ব্যক্তির অবদান নয়। প্রথমে মানুষ মাটিতে বা পাতায় দাগ দিয়ে তথ্য মনে রাখত। মৌখিক ভাষার প্রচলনের পর তথ্য জমা রাখার তাগিদে বিভিন্ন চিহ্নের প্রয়োজন হয়। শুরুতে ছবি একেঁ বোঝানো হত। কিন্তু তা সময়সাপেক্ষ হওয়ায় ধীরেধীরে মানুষ সহজ চিহ্ন ব্যবহার করতে থাকে। এভাবে অক্ষরের সূচনা হয়। পরে কালের প্রবাহে তা বিভিন্ন রূপ লাভ করে। ভাষার মতো অক্ষরও কোনো একক জনপদে সীমাবদ্ধ না থাকায় অক্ষরেরও বিভিন্ন রূপভেদ দেখা যায়।