ফুলে যাওয়া বা ইডিমা কি?
শরীরের টিস্যুতে অতিরিক্ত ফ্লুইড জমা হয়ে গেলে যে পরিস্থিতির তৈরি হয় তাকে ইডিমা বা ফুলে যাওয়া বলা হয়। ফুলে যাওয়া টিস্যুর ওপরে ত্বক উষ্ণ, নরম এবং টানটান হয়ে যায়। সাধারণত হাত এবং পায়ে ইডিমা হয়ে থাকে (পেরিফেরাল ইডিমা), তবে শরীরের অন্যান্য অঙ্গেও হতে পারে। চোখ এবং তার চারপাশের টিস্যুও একই পরিস্থিতিতে পড়তে পারে যেমন প্যাপিলইডিমা এবং ম্যাকিউলার ইডিমা, পাকস্থলীতে অ্যাসাইটিক্স, সারা শরীরে অ্যানাসারকা, ত্বক এবং শ্লেষ্মা ঝিল্লিতে (সাধারণত গলা, মুখ, ঠোঁট, এবং জিভে) অ্যানজিইডিমা, ফুসফুসে পালমোনারি ইডিমা এবং মস্তিষ্কে সেরিব্র‌্যাল ইডিমা। পেরিফেরাল ইডিমা, যা হাতে এবং পায়ে হয়, তা মূলত হয়ে থাকে রক্ত সংবহনতন্ত্রে (শিরার অক্ষমতা) ত্রুটি, কনজেসটিভ হৃদরোগ, কিডনির সমস্যা, রক্ত সেরাম প্রোটিনে ঘাটতি, যকৃতে সমস্যা এবং লিম্ফ্যাটিক সিস্টেমে ক্ষতির (লিম্ফিইডিমা) কারণে।

স্বাস্থ্যের বিভিন্ন অন্তর্নিহিত কারণের জন্য শরীরে ইডিমা হতে পারে। প্রসূতি মহিলাদের মধ্যে, ঋতুচক্র চলাকালীন সময়ে, এবং দীর্ঘদিন ধরে জন্মনিরোধক বড়ি খেলে মহিলাদের মধ্যে পেরিফেরাল ইডিমা খুবই সাধারণ একটি ঘটনা। যাঁরা দীর্ঘদিন রক্তাল্পতায় এবং থাইরয়েড সমস্যায় ভুগছেন তাঁদের মধ্যেও এটি প্রায়শ দেখা যায়। অবসাদ রোধী ওষুধ বা অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট, ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার্স (উচ্চ রক্ত চাপের জন্য) এবং স্টেরয়েড-এর মত কিছু ওষুধ থেকেও ইডিমা হতে পারে। অন্তর্নিহিত কারণের ওপর নির্ভর করে ইডিমা অল্পদিন থাকবে নাকি দীর্ঘদিন ধরে ভোগাবে। অন্তর্নিহিত কারণের চিকিৎসা হল ইডিমা নিয়ন্ত্রণের প্রাথমিক পর্যায়।

ফুলে যাওয়া বা ইডিমার উপসর্গ:
ইডিমার অগ্রগতির সঙ্গে শরীরে কিছু কিছু চিহ্ন এবং উপসর্গ দেখা দেবে। তার মধ্যে আছে :

  • পা বা অন্য আক্রান্ত এলাকা ফুলে যায়, বা স্ফীত হয়ে যায়।
  • ফুলে যাওয়া এলাকার রং পাল্টে যায়।
  • যেখানে ইডিমা হয়েছে অর্থাৎ ইডিমেটাস এলাকায় আঙুল দিয়ে চাপ দিলে সেখানটি বসে যায় (পিটিং ইডিমা)।
  • যখন শরীরের গাঁট প্রভাবিত হয় তখন শরীরের আক্রান্ত অংশ ভারী হয়ে যায় এবং সেগুলি নড়াচড়া করায় অসুবিধা হয়।
  • যে অংশটি ফুলে গিয়েছে সেখানকার ত্বক গরম হয়ে যায় এবং টানটান হয়ে পড়ে। সাধারণ ইডিমা হলে জামা-কাপড় পরতে অসুবিধা হয়।
  • শিরায় রক্ত জমাট হওয়ার কারণে যে ইডিমা বা ভেরিকোজ ভেইন হয়, তার ফলে আক্রান্ত পা স্পর্শকাতর এবং যন্ত্রণাদায়ক হয়ে থাকে।
  • ইডিমার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উপসর্গ হচ্ছে শ্বাসকষ্ট যা ঘটে হৃদযন্ত্র বিকল হলে, বৃক্কের (কিডনি) অসুখে, যকৃতের সমস্যায় বা ফুসফুসের সমস্যায়।
  • সাধারণ ইডিমার সঙ্গে সঙ্গে ওজন বৃদ্ধি ঘটে।


ফুলে যাওয়া বা ইডিমার চিকিৎসা:
ইডিমার চিকিৎসা এবং নিয়ন্ত্রণ নির্ভর করে অন্তর্নিহিত কারণের ওপর এবং চিকিৎসায় নিম্নলিখিত পন্থাগুলি কার্যকর করা হয়:

  • শোবার সময়ে পা গুলিকে ওপরের দিকে রাখলে এবং প্রাথমিক পর্যায়ে কমপ্রেশন স্টকিং (মোজা) পরলে ইডিমা কমাতে তা সাহায্য করে। যাদের প্লাক গঠনের (অ্যাথেরোস্কেরোসিস) জন্য পায়ের ধমনী শক্ত এবং সংকীর্ণ হয়ে যায় তাদের ক্ষেত্রে মোজা ব্যবহার করা হয় না। এ সব ক্ষেত্রে নিউম্যাটিক কমপ্রেশন ডিভাইস নামে একটি বৈদ্যুতীন যন্ত্র ব্যবহার করা হয় যাতে পায়ে রক্ত জমাট না হয়। যাঁদের পায়ে আলসার আছে, পা পুড়ে গিয়েছে বা পেরিফেরাল ব্লাড ভেসেল রোগ আছে তাঁদের ক্ষেত্রে নিউম্যাটিক যন্ত্র ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হয় না। পায়ের ওপরে কাফ জড়িয়ে রাখা হয় এবং বাতাস দিয়ে ভর্তি করা হয়। এর ফলে টিস্যুগুলির ওপর চাপ বাড়ে এবং শিরার মধ্য দিয়ে রক্ত সংবহন বাড়ে এবং রক্ত জমাট হওয়ার সমস্যা রোধ হয়।
  • যখন কনজেসটিভ হার্ট ফেইলিওরের সঙ্গে শিরার অপ্রতুলতা যুক্ত হয় তখন এমন ওষুধ ব্যবহার করা হয় যাতে প্রস্রাব বেশি হয় এবং শরীর থেকে অতিরিক্ত পানি বার হয়ে যায়।
  • শিরার অপ্রতুলতার কারণে যখন ইডিমা হয় তখন ত্বকের যত্ন নেওয়া খুব জরুরি। ত্বক নরম করার ক্রিম এবং হাল্কা কর্টিকোস্টেরয়েড মলম ত্বককে শুষ্ক হতে দেয় না এবং যে জায়গা ফুলে গিয়েছে সেখানে প্রদাহ এবং ফোলা কমায়।
  • ডিপ ভেইন থ্রম্বসিস-এর চিকিৎসায় অ্যান্টিকোঅ্যাগুলেন্ট বা ক্লট-বাস্টার (হেপারিন বা ওয়ারফারিন) ওষুধের ব্যবহার করা হয়, যা পায়ে রক্ত জমাট হওয়া প্রতিরোধ করতে কাজে লাগে। যাঁরা দীর্ঘস্থায়ী শিরার অপ্রতুলতার কারণে এবং ডিপ ভেইন থ্রম্বসিস-এ ভুগছেন তাঁদের ক্ষেত্রে মোজা এবং ব্যান্ডেজ রক্ত জমাট হওয়া প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।
  • লিম্ফইডিমায় ফিজিওথেরাপি, ম্যাসাজ, এবং ব্যান্ডেজ ব্যবহার করা হয় যাতে রক্ত সরবরাহ বাড়ে এবং লিম্ফ্যাটিক শিরায় বাধা থাকলে তা সরিয়ে দেয় যা শেষ পর্যন্ত ইডিমা কমাতে সাহায্য করে। লিম্ফইডিমায় ইডিমা উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে একটি নিউম্যাটিক কমপ্রেশন ডিভাইস বেশি কার্যকরী হয়। যে লিম্ফ্যাটিক শিরা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে আছে তাকে পাশে সরিয়ে রেখে (বাইপাস) অস্ত্রোপচার করাকে চিকিৎসার পরিভাষায় বলা হয় সার্জিক্যাল ডিবাল্কিং, যখন বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতিতে লিম্ফইডিমা সাড়া না দেয় তখন এটি করা হয়।
  • যখন ওষুধের কারণে ইডিমা হয়, তখন উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসার জন্য ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার না ব্যবহার করা, কারণ তার ফলে দু’টি পায়েই ইডিমা হতে পারে, অন্যান্য ওষুধ যেমন অ্যানজিওটেনসিন-কনভার্টিং এনজাইম ইনহিবিটরস বা ACE ইনহিবিটরস ব্যবহার হয়।
  • যকৃতের অসুখ, কিডনির অসুখ এবং অন্ত্রের সমস্যার কারণে গঠিত ইডিমা, যা শরীরে প্রোটিনের ক্ষতি করে, তার চিকিৎসায় প্রোটিন ইনজেকশন দেওয়া হয়, প্রাথমিক পর্যায়ে পানি এবং লবণ খাওয়া সীমিত করা হয়, এবং ডাইরেটিক ব্যবহার হয়।
  • ওজন কমানো এবং নিরবচ্ছিন্ন বায়ু চাপ যন্ত্রের (CPAP) ব্যবহার ফুসফুসের কার্যকারিতা বাড়ায় এবং স্লিপ অ্যাপনিয়ার কারণে পায়ে যে ইডিমা হয়, তা কমাতে সাহায্য করে।
  • অজ্ঞাত কারণে পায়ে ইডিমা হলে (ইডিওপ্যাথিক ইডিমা), তা নিরাময়ে জীবনশৈলীর পরিবর্তন ব্যতিরেকে অলডোস্টেরন অ্যান্টাগনিস্টস ওষুধের সাহায্যে তার চিকিৎসা করা হয়।
  • আঘাতের ফলে ইডিমা হলে যন্ত্রণা এবং ফোলা কমাতে সিস্টেমিক স্টেরয়েড এবং ট্রাইসাইক্লিক অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধ ব্যবহার করা হয়।


জীবনশৈলীর ব্যবস্থাপনা:
দৈনন্দিন কিছু সাধারণ পদক্ষেপ গ্রহণ করলে ইডিমা নিয়ন্ত্রণে উপকার হতে পারে:

  • খাদ্যতালিকায় লবণ এবং চিনি কম থাকলে পানি কম ধরে রাখা এবং ইডিমা কমতে সাহায্য হয়।
  • রক্ত সঞ্চালন বাড়াতে হাঁটা, জগিং, পা তুলে ধরার ব্যায়াম করলে ইডিমা কমতে সাহায্য হয়।
  • রক্ত সঞ্চালনের উন্নতি এবং হার্টে রক্ত সংবহন বাড়াতে নিয়মিত ম্যাসাজ করান।
  • ওজন বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ এবং রোধ করতে স্বাস্থ্যকর এবং সুষম খাবার খান।
  • ধূমপান এবং মদ্যপান করবেন না।
  • শরীর নিরোগ আছে কিনা তা নজরে রাখতে প্রতি ছয় মাস অন্তর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান।

শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে