ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি) কি?
দীর্ঘস্থায়ী অবরোধক ফুসফুসীয় ব্যাধি বলতে ফুসফুসের তীব্র প্রদাহজনক রোগকে বোঝায় যার কারণে ফুসফুসে বায়ু চলাচল বাধাগ্রস্ত হয় এবং শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যার সৃষ্টি হয়। একে ইংরেজি পরিভাষায় ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (Chronic obstructive pulmonary disease, সংক্ষেপে COPD) বলে। এর প্রাথমিক লক্ষণগুলি হল শ্বাসকষ্ট এবং কাশির সাথে কফ বের হওয়া। লক্ষণগুলি সময়ের সাথে সাথে আরও ক্ষতিকর হয়ে উঠে। হাঁটাচলা করা বা সিঁড়ি বেয়ে ওঠা কষ্টকর হয়ে উঠে। সর্বাধিক পরিচিত দীর্ঘস্থায়ী অবরোধক ফুসফুসীয় ব্যাধি হল ক্লোমস্ফীতি বা কলাবায়ুস্ফীতি (এমফাইসিমা, Emphysema) এবং দীর্ঘস্থায়ী ক্লোমনালীপ্রদাহ (ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস, chronic bronchitis), তবে এদেরকে বর্তমানে আর আলাদা করে দেখা হয় না।

সারা বিশ্বে, মৃত্যুহার এবং রোগ উপসর্গের একটি অন্যতম প্রধান কারণ হল সিওপিডি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাবলুএইচও) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সারা বিশ্বে ৬৫ মিলিয়ন মানুষ সিওপিডি রোগে মাঝারি থেকে গুরুতর রকমভাবে আক্রান্ত।

ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজের প্রধান লক্ষণ ও উপসর্গগুলি কি কি?
প্রাথমিক অবস্থায়, সিওপিডি হয়েছে কি না তা বুঝতে পারা সহজ হয় না কারণ উপসর্গগুলি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত অন্যান্য সমস্যার মতোই মনে হয়। সিওপিডি-র সাধারণ উপসর্গগুলি হল:

  • শ্বাস নিতে অসুবিধা
  • কাশি
  • কাশির সাথে অত্যাধিক শ্লেষ্মা নির্গত হওয়া
  • শ্বাস নেবার সময় বুকে সাঁইসাঁই শব্দ হওয়া
  • বুকে চাপ অনুভব
  • ঠোঁট অথবা হাতের নখের রঙ নীলচে হয়ে যাওয়া
  • ক্লান্তি
  • অকারণে ওজন হ্রাস
  • পায়ের নীচের দিকে ইডিমা বা ফোলা
  • হাঁটাচলা করলে হয়রান হয়ে যাওয়া।

সিওপিডি হল ফুসফুসের তিনটি প্রগতিশীল সমস্যা – দীর্ঘস্থায়ী ব্রংকাইটিস, এমফিসেমা, এবং স্থায়ীভাবে শ্বাসকষ্ট। কোনো ব্যক্তির দীর্ঘস্থায়ী ব্রংকাইটিস হলে তার উপসর্গগুলি হবে একনাগাড়ে কাশি আর তার সঙ্গে শ্লেষ্মা ক্ষরণ। এফিসেমার ক্ষেত্রে, অ্যালভিওলাই (ফুসফুসের মধ্যে থাকা ছোটো ছোটো বায়ুথলি) আক্রান্ত হয় এবং বিভিন্ন বায়বীয় অস্বস্তিকারক পদার্থের কারণে ধবংস হয়ে যায়, যেমন, সিগারেটের ধোঁয়া।

ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজের প্রধান কারণগুলি কি কি?
সিওপিডির ঝুঁকির বিষয়গুলি ও কারণগুলি হল ধূমপান, জৈব জ্বালানি অথবা ঘরবাড়িতে উৎপন্ন ধোঁয়ার সংস্পর্শে আসা। এ ছাড়া বায়ুদূষণ, ধুলা ইত্যাদি ফুসফুসে প্রদাহের সৃষ্টি করে, যা সিওপিডির কারণ। যাঁরা কলকারখানায় কাজ করেন বা রান্নাঘরে ধোঁয়ার মধ্যে অনেকক্ষণ সময় থাকেন তাঁদেরও এই অসুখের ঝুঁকি আছে। অন্যান্য ঝুঁকির কারণগুলি হল হৃদযন্ত্রের সমস্যা, বুকজ্বালা, বিষণ্ণতা অথবা ডায়াবেটিস বা মধুমেহ রোগের মতো একাধিক মারাত্মক সমস্যা। পরোক্ষ ধূমপান ও বিরল জিনঘটিত সমস্যার কারণে শরীরে যদি আলফা-১ এর ঘাটতি হয়, তা থেকে সিওপিডি হতে পারে। হাঁপানি বা শ্বাসকষ্ট থাকলে তা সিওপিডির সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। এ ছাড়া শৈশবে ফুসফুসের গুরুতর সংক্রমণ হলেও সিওপিডির ঝুঁকি থাকে। এ রোগের কারণে ফুসফুসের স্থায়ী ক্ষতি হয়।

ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ কিভাবে নির্ণয় ও চিকিৎসা করা হয়?
সিওপিডি নির্ণয় করতে নিম্নলিখিত পরীক্ষাগুলি করা হয়:

  • ফুসফুসের কার্যকারিতা পরীক্ষা: ফুসফুসের কার্যক্ষমতা জানার জন্য।
  • বুকের এক্স-রে: ফুসফুসের অন্য কোনও সমস্যা আছে কি না সে সম্পর্কে নিশ্চিত হতে।
  • ধমনীর মধ্যে রক্ত ও অক্সিজেন সরবরাহের বিশ্লেষণ।
  • পরীক্ষাগারের পরীক্ষাগুলি।


সিওপিডি রোগীর চিকিৎসার জন্য সাধারণত গোল্ড গাইডলাইনস ব্যবহার করা হয়। চিকিৎসার অন্তর্গত হল:
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা:

  • ধূমপান ত্যাগ করা এবং যতটা সম্ভব ধোঁয়া ও শ্বাসযন্ত্রের অস্বস্তি বাড়ানো পদার্থ এড়িয়ে চলা।


ওষুধপত্র:

  • ব্রঙ্কোডিলেটরস।
  • নিঃশ্বাসের মাধ্যমে স্টেরয়েড নেওয়া।
  • একাধিক ইনহেলার ব্যবহার করা।
  • ফসফোডিয়েস্টেরেস-৪ ইনহিবিটরস।
  • অ্যান্টিবায়োটিকস।


ওষুধপত্রের ব্যবহার ছাড়া চিকিৎসা:

  • অক্সিজেন থেরাপি।
  • ফুসফুস পুনর্ক্ষম করার প্রক্রিয়া।


অস্ত্রোপচার:

  • ফুসফুসের আয়তন কমানোর অস্ত্রোপচার।
  • ফুসফুস প্রতিস্থাপন।
  • বুলেকটমি।


সিওপিডি রোগের ক্ষেত্রে সঠিক পদক্ষেপ হলো রোগ প্রতিরোধ এবং রোগের বৃদ্ধি রোধ করা। এই রোগ কখনও সম্পূর্ণ সারে না। কিন্তু, সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা করলে, সিওপিডি আক্রান্ত ব্যক্তিও সুস্থভাবে জীবনযাপন করতে পারেন।

সিওপিডিকে স্মোকার্স ডিজিজ বলা হলেও অজস্র মহিলা ফুসফুসের এই ক্রনিক অসুখে আক্রান্ত যারা জীবনে ধূমপান করেননি। মূলত, এদের ফুসফুসের অসুখের মূলে আছে নাগাড়ে রান্নাঘরের ধোঁয়ার মধ্যে থাকা। বিশ্বে মোট মৃত্যুর এক তৃতীয়াংশ সিওপিডির কারণে হয়। অথচ একটু সতর্ক হলেই অসুখটা এড়িয়ে চলা খুব কঠিন নয়। মূলত ৩৫ থেকে ৪০ বছর বয়সে এই অসুখের সূত্রপাত হয়। বিশেষ করে টানা ১০ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে যারা ধুমপান করছেন এবং কাজের কারণে বদ্ধ জায়গায় ধোয়ার মধ্যে থাকতে হয় তাঁদের ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজের ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি। একটা সিগারেটে টান দিলেই যে সঙ্গে সঙ্গে ফুসফুসের এই অসুখ করবে ব্যাপারটা সেরকম নয়। নাগাড়ে ধুমপান করতে থাকলে ধীরে ধীরে এই অসুখের সূত্রপাত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দীর্ঘদিন ধরেই অসুখটি সম্পর্কে সচেতন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ধুমপানপ্রীতি কমার কোনও উৎসাহ নেই।


শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে