গলব্লাডারের পাথর (পিত্তথলির পাথর) কি?
আমাদের লিভারের পাশেই রয়েছে গলব্লাডার বা পিত্তথলি। পিত্তথলি থেকে নিঃসৃত পিত্তরস খাবার হজমে সাহায্য করে। রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে, বিলিরুবিনের আধিক্য দেখা দিলে বা পিত্তরস জমে গিয়ে পিত্তথলিতে পাথর সৃষ্টি করতে পারে। পুরুষদের তুলনায় মহিলারাই গলব্লাডারের সমস্যায় বেশি আক্রান্ত হন।

এই পাথর গলব্লাডারের নালীকে রোধ করতে পারে যা ব্যথা এবং অন্যান্য উপসর্গগুলির কারণ হয়ে দ্বারায়। কখনও কখনও, যতক্ষণ না উপসর্গগুলি সুস্পষ্ট হচ্ছে ততক্ষণ আক্রান্ত ব্যক্তি গলব্লাডারে পাথরের অবস্থান নাও বুঝতে পারেন। তাই নিচে উল্লেখিত লক্ষণ দেখলেই দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যান। এই উপসর্গগুলিকে একেবারেই অবহেলা করবেন না। সামান্য সমস্যাতেও ইচ্ছে মতো গ্যাসের ওষুধ না খেয়ে কোনও চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

পাথর দুই ধরনের হয়:

  • কলেস্টেরল পাথর
  • পিগমেন্ট পাথর


গলব্লাডার স্টোন বা পিত্তথলিতে পাথর হওয়ার প্রধান লক্ষণ এবং উপসর্গগুলি কি কি?
অনেক ক্ষেত্রে, গলস্টোনের কোন উপসর্গ দেখা দেয় না। দীর্ঘকাল ধরে তারা গলব্লাডারে চুপ করে থাকতে পারে। কিন্তু, একবার পাথরগুলি নালীতে বাধা দিলে উপসর্গগুলি দেখা দেয়। এর মধ্যে রয়েছে:

  • পেটের ওপরের অংশে ডান দিকে তীব্র ব্যথা হওয়া এবং ওই ব্যথা ডান কাঁধে ছড়িয়ে পড়া।
  • তলপেটে মোচড়
  • কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসতে পারে।
  • জ্বরের সঙ্গে বমি বমি ভাব বা বমিও হতে পারে।
  • চর্বিজাতিয় খাবার, অতিরিক্ত তৈলাক্ত খাবার বা মাংস খেলেই পেটে ব্যথা হওয়া।
  • জ্বরের সঙ্গে জন্ডিসের লক্ষণও প্রকাশ পেতে পারে।


গলব্লাডার স্টোন বা পিত্তথলিতে পাথর হওয়ার প্রধান কারণগুলি কি কি?

  • পিত্তে অত্যধিক কোলেস্টেরল, কোলেস্টেরল পাথরের কারণ হতে পারে। যদি পিত্তে অত্যধিক কোলেস্টেরল থাকে, সেটা অবশেষে ভেঙে যায় না এবং পাথর গঠনের জন্য শক্ত হয়ে ওঠে।
  • পিত্তের মধ্যে একটি রঞ্জক পদার্থ থাকে যাকে বিলিরুবিন বলা হয়। লিভারের কিছু রোগে বা রক্ত কোষের রোগগুলিতে, অত্যধিক বিলিরুবিন গঠিত হয়, যা রঞ্জক পাথরের গঠনের কারণ হয়।
  • যদি গলব্লাডার ঠিক করে কাজ না করে, তার ভিতরের সামগ্রী খালি হয় না এবং তা জমতে থেকে পাথরে পরিণত হয়।
  • কিছু ঝুঁকির বিষয়ের মধ্যে রয়েছে ডায়াবেটিস, হরমোনগত অসামঞ্জস্যতা, ওবিসিটি এবং ওরাল কন্ট্রাসেপ্টিভ।


গলব্লাডার স্টোন বা পিত্তথলিতে পাথর নির্ণয় এবং চিকিৎসা কিভাবে করা হয়?
চিকিৎসক আক্রান্তের উপসর্গগুলি মূল্যায়ন করবেন তারপর অন্যান্য পরীক্ষার পরামর্শ দেবেন। পাথর ধরার সবচেয়ে বড় উপায় হচ্ছে আলট্রাসনোগ্রাফ। এছাড়া এমআরসিপি এবং সিটি স্ক্যান করা যেতে পারে। যকৃৎ এবং গলব্লাডারের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার জন্য লিভার ফাংশন পরীক্ষা অন্তর্ভুক্ত আছে। এক্স-রের মাধ্যমে নালীর দ্বারা বিশেষ রঞ্জক পদার্থের প্রবাহ ব্যবহার করে পিত্ত নালীর রোধ হওয়া পরীক্ষা করা হয়। এছাড়াও রক্ত পরীক্ষা কোনো সংশ্লিষ্ট জটিলতা এবং সংক্রমণ চেক করতে সাহায্য করে।

যদি রোগীর গলপাথরের উপসর্গগুলি দেখা না দেয় তাহলে কোন চিকিৎসার দরকার নেই। যার বারাবার হওয়ার প্রবণতা থাকে, সার্জারির মাধ্যমে গলব্লাডারকে সরিয়ে দেওয়া হল গলপাথরের সঙ্গে মোকাবিলা করার সবার থেকে পছন্দসই উপায়। অনেকের প্রশ্ন থাকে, ওষুধ দিয়ে পাথর গলানো যাবে কিনা? আসলে পাথর গলানোর কোনো ওষুধ নাই। তবে বিদেশে এক ধরনের পদ্ধতি আছে - যারা পেট কাটতে চায় না তাদের জন্য। এই পদ্ধতিতে কিডনীর পাথর যেভাবে ভেঙ্গে দেওয়া হয় ঠিক সেভাবে গলব্লাডারের পাথরও ভেঙে দেওয়া হয়। কিন্তু ভেঙে দেওয়া পাথরটা বের করার জন্য ইআরসিপি করতে হয়। কিন্তু ইআরসিপি করা অনেক বড় ব্যপার। তাই সবচেয়ে ভাল উপায় হচ্ছে অপারেশন করা। এর ফলে গলব্লাডারের পুরো থলিটাই ফেলে দেওয়া হয়। অপসারণের পরে গলব্লাডারের অনুপস্থিতিতে শরীরের কোন শারীরিক কার্যকরীতায় এর প্রভাব পড়ে না।

গলব্লাডারে পাথর হলে অপারেশন ছাড়া যেমন গতি নেই, অপারেশন–পরবর্তী জীবনেও খাবারে একটু বিধি-নিষেধ থাকে। জেনে নিন কি কি বিষয় মেনে চলবেন:

  • লো ক্যালোরির সুষম খাবার খান। দরকার হলে পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিন।
  • খাবারে যেন বৈচিত্র্য থাকে। রোজ এক ধরনের খাবার না খেয়ে সব রকম খাবার মিলিয়ে মিশিয়ে খান।
  • ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার রাখুন খাদ্যতালিকায়। যেমন, শাকসবজি, ফল, হোল-গ্রেন তথা ব্রাউন রাইস, আটা–জোয়ার–বাজরা ইত্যাদির রুটি, ব্রাউন ব্রেড, খোসাওলা ডাল ইত্যাদি।
  • মাংস বা চিকেনের যে অংশে চর্বি কম থাকে সেই অংশ খান। চিকেনের গায়ের উপরের পাতলা চামড়া ছাড়িয়ে নেবেন অবশ্যই। মাঝেমধ্যে নিরামিষ প্রোটিনও খাবেন।
  • ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার রাখুন পাতে।
  • রোজ কিছু না কিছু উপকারি ফ্যাট খান। বাদাম, মাছের তেল, অ্যাভোক্যাডো, অলিভ অয়েল তো খাবেনই, ঘি–মাখন বা অন্য তেলও পুরোপুরি বাদ দেওয়ার দরকার নেই। কারণ ফ্যাট না খেলে গল-স্টোন হয় না- এমন নয়। উপকারি ফ্যাট না খেলে বরং নানা রকম সমস্যা হতে পারে। তবে তা যেন মাত্রা না ছাড়ায়।
  • চিনির কোনো উপকার নেই, বরং অপকার আছে বিস্তর। কাজেই সব রকম মিষ্টি স্বাদের খাবার খাওয়া বন্ধ করুন। ব্যতিক্রম ফল। তবে ফলের রস চলবে না একেবারেই। প্রতি দিন দু’টো ফল খান চিবিয়ে।
  • ক্যাফিনসমৃদ্ধ খাবার বা পানীয় কম করে খান। চকোলেট বা নরম পানীয়র ব্যাপারেও সতর্ক থাকুন। চা একটু বেশি খাওয়া যায়। তবে তাও যেন মাত্রা না ছাড়ায়।


জীবনযাপন:

  • ওজন যাতে না বাড়ে সে দিকে খেয়াল রাখুন। বেড়ে গেলে রাতারাতি কমানোর চেষ্টা না করে স্বাস্থ্যকর পদ্ধতিতে সময় নিয়ে কমান।
  • লো ক্যালোরির সুষম খাবার খাওয়ার পাশাপাশি নিয়মিত হালকা ব্যায়াম করুন যাতে ওবেসিটি, ডায়াবিটিস ও হাই কোলেস্টেরলের প্রকোপ কম থাকে।
  • চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে গর্ভনিরোধক বড়ি খাবেন না। ঋতুবন্ধের পর নিতান্ত প্রয়োজন না হলে হরমোন থেরাপি করানোর দরকার নেই।
  • মধ্যবয়সের মানসিক চাপ ও তার হাত ধরে ভুলভাল খাওয়া ও ওজন বৃদ্ধির সমস্যা এড়াতে দরকার রিল্যাক্সেশন থেরাপি। নিয়মিত ব্যায়াম, যোগা, মেডিটেশন ও কোনও ভাল লাগার কাজের চর্চা সে কাজে সাহায্য করতে পারে। প্রয়োজনে কাউন্সেলিং করে হলেও মানসিক চাপ এড়ানোর চেষ্টা করবেন।
  • ভাল করে ঘুমোতে হবে অবশ্যই।

শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে