মাথায় আঘাত কি?
মাথা, স্ক্যাল্প বা মস্তিষ্কের আঘাতকে মাথায় আঘাত হিসাবে উল্লেখ করা হয়। মাথার উপর একটি হালকা আচমকা আঘাত লাগা থেকে জোরে ধাক্কা লাগার ঘটনা অথবা মাথার হাড়ের ফেটে যাওয়া পর্যন্ত মাথায় আঘাত হতে পারে।

মাথায় আঘাতের প্রধান লক্ষণ ও উপসর্গগুলি কি কি?
আঘাতের প্রভাবের উপর নির্ভর করে, ব্যক্তি ভেদে উপসর্গগুলি বিভিন্ন মাত্রার হতে পারে, যা হালকা, মাঝারি বা গুরুতর হতে পারে।
হালকা আঘাত।

  • মাথার উপরে আচমকা ঠুকে যাওয়া বা কালশিটে।
  • স্ক্যাল্পের উপর কেটে যাওয়া।
  • মাথা ব্যথা।
  • আলোকাতঙ্ক রোগ (আলোতে সংবেদনশীলতা)।
  • বমি বমি ভাব।
  • বিভ্রান্তি।
  • মাথা হালকা অনুভব করা।
  • ঘুমের প্যাটার্নের পরিবর্তন।
  • ঝাপসা দেখা।


মাঝারি আঘাত।

  • কিছুক্ষনের জন্য চেতনা হারানো।
  • মাথায় প্রচন্ড ব্যথা।
  • বমি বমি ভাব ও বমি করা।
  • ফ্যাকাশে ত্বক।
  • খিটখিটে ভাব বা আচরণগত পরিবর্তন।
  • উন্মুক্ত ক্ষত।


গুরুতর আঘাত।

  • জ্ঞান হারানো।
  • তন্দ্রালু ভাব।
  • সিজার্স।
  • অসংলগ্ন কথা।
  • বিস্তারিত বা স্থির চক্ষুতারা।
  • প্রগতিহীন অবস্থা।


মাথায় আঘাতের প্রধান কারণগুলি কি কি?
মাথায় আঘাতের কারণ বিভিন্ন হয়। এখানে শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে কারণের বিভিন্নতা রয়েছে। শিশুদের ক্ষেত্রে, উঁচু থেকে পরে গিয়ে, মারামারি বা খেলাধুলা করতে গিয়ে এটা হতে পারে, যদিও প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে, রাস্তায় যানবাহন দুর্ঘটনা (গাড়িতে দুর্ঘটনা), শারীরিক নির্যাতন বা হিংসা, পড়ে গিয়ে বা খেলাধুলা করতে গিয়ে আঘাতের কারণে হতে পারে।

মাথায় আঘাত লাগলে যা করবেনঃ

  • রুগীর মাথা ও ঘাড়ের নিচে হাত রেখে সাপোর্ট দিন যাতে নাড়াচাড়া না হয়।
  • ক্ষত থেকে কোন রক্তপাত হলে পরিষ্কার কাপড় দিয়ে ক্ষত চেপে ধরুন।
  • যদি রুগী বমি করে, তাহলে বমি যাতে শ্বাস পথে না যায়, সে জন্য রুগীর মাথা, ঘাড় ও শরীর একপাশে কাত করে দেবেন।
  • শিশুদের মাথায় আঘাত পেলে সচরাচর একবার বমি করে। এটি তেমন কোন সমস্যা নয়, তবে অবশ্যই চিকিৎসককে অবহিত করুন।
  • ফোলা জায়গায় বরফ সেঁক দিতে পারেন।


মাথায় আঘাত লাগলে যা করবেন নাঃ

  • আঘাত মারাত্বক হলে রুগীর মাথা নাড়াচাড়া করবেন না।
  • যদি ক্ষতস্থানে চেপে ধরা কাপড় রক্তে ভিজে যায় তাহলে সেটিকে সরিয়ে ফেলবেন না। এর উপর আরেকটি কাপড় দিয়ে রাখুন।
  • যদি মনে হয় খুলি ভেঙ্গে গেছে তাহলে সেখানে সরাসরি চাপ দেবেন না।
  • ক্ষত থেকে কোন মরা টিস্যু সরাবেন না।
  • মাথার ক্ষত গভীর হলে বা অধিক রক্তপাত হলে মাথা পরিষ্কার করবেন না।
  • প্রয়োজন ছাড়া রুগীকে নাড়াচাড়া করবেন না বা ঝাঁকি দেবেন না।


কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন?
মাথায় আঘাতের পর যদি অসুস্থতা অনুভূত হয় তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। এক্ষেত্রে মাথা ঘোরা, হতবুদ্ধিতা, সিদ্ধান্তহীনতা, মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব, আঘাতের স্থানে ফুলে যাওয়া, রক্তপাত, হাঁটতে অসুবিধা ইত্যাদি লক্ষণগুলো দেখা গেলেও অবহেলা করবেন না।

কখন হাসপাতালে নিয়ে যাবেন?

  • যদি রুগীর খুব ঘুম আসে।
  • যদি অস্বাভাবিক আচরণ করে।
  • যদি মারাত্বক মাথাব্যথা হয় কিংবা ঘাড় শক্ত হয়ে যায়।
  • যদি দুই চোখের মনি দুই রকম হয়ে যায়।
  • যদি রুগীর হাত বা পা শক্ত হয়ে যায়।
  • জ্ঞান হারিয়ে ফেললে।
  • একবারের বেশি বমি হলে।
  • যদি রুগীর শ্বাস-প্রশ্বাস ও হৃদস্পন্দন ঠিক থাকে কিন্তু রুগী অজ্ঞান থাকে তাহলে, তাহলে বুঝতে হবে তাঁর স্পাইনাল ইনজুরি হয়েছে।


মাথায় আঘাত কিভাবে নির্ণয় ও চিকিৎসা করা হয়?
গ্লাসগো কোমা স্কেলের (জিসিএস) সাথে একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ ক্লিনিকাল পরীক্ষা মাথার আঘাত নির্ণয় করতে সাহায্য করে। জিসিএসের কম স্কোর গভীর আঘাত এবং তার বিপরীতকে নির্দেশ করে। কখনও কখনও, আচ্ছন্ন অবস্থার কারণে এটির মেডিকেল ইতিহাস পাওয়া কঠিন। নির্দিষ্ট পরিক্ষাগুলি মস্তিষ্কে কোষগুলির ক্ষতি এবং আঘাতের পরিমাণ পরীক্ষা করার জন্য বাধ্যতামূলক। পরীক্ষাগুলি হল:

  • কম্পিউটেড টোমোগ্রাফি (সিটি) স্ক্যান: এটি মাথার খুলিতে ফাটল, রক্তপাত, এবং টিস্যুর ফোলা নিরীক্ষণ করতে সাহায্য করে।
  • ম্যাগনেটিক রেসোনেন্স ইমেজিং (এমআরআই) স্ক্যান: সিটি স্ক্যানের থেকেও এটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং অধিক যথাযথ।


হালকা আঘাতের জন্য পর্যবেক্ষণ অথবা ব্যাথার জন্য সাধারণ বেদনানাশকের (বারবার বরফের প্যাক ব্যবহারের সাথে) ব্যবহার প্রয়োজন, যদিও মাঝারি ও মারাত্মক আঘাতের জন্য সাধারণ ওষুধ থেকে সার্জারি বা কখনও কখনও জরুরী ওয়ার্ডে ভর্তি করে চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।

মাথায় আঘাতের জন্য চিকিৎসাগুলি হল:

  • এন্টি সিজার্স মেডিকেশন - সিজার্স মাথায় আঘাতের একটি প্রচলিত উপসর্গ এবং এটি মস্তিষ্কের ক্ষতি করতে পারে, এক্ষেত্রে এন্টি-সিজার্স ওষুধগুলি খুবই সাহায্য করে।
  • ডিউরেটিক্স - মস্তিষ্কের চারপাশ ফুলে যাওয়ার কারণে কিছু ধরনের মাথায় আঘাত হয়; ডিউরেটিক্সের ব্যবহারে ফোলা কমে এবং চাপের উপসর্গগুলি উপশম করতে সহায়তা করে।
  • কোমা ইনডিউসিং ড্রাগস - যখন মস্তিষ্ক নিজে থেকে আরোগ্যলাভের চেষ্টা করে তখন এটি অতিরিক্ত অক্সিজেনের ব্যবহার শুরু করে। কিন্তু, রক্তবাহগুলি প্রভাবিত থাকার কারণে, এগুলি পর্যাপ্ত পরিমানে অক্সিজেন পায় না, এবং এটি আঘাতকে আরো বাড়িয়ে তোলে এবং মস্তিষ্কের কোষগুলির মৃত্যু ঘটায়। তাই, অধিকতর আঘাতকে রোধ করার জন্য, কোমা-ইনডিউসিং ওষুধগুলি ব্যবহার করে সাময়িকভাবে মস্তিষ্কের কোষগুলির কার্যকারিতা হ্রাস করা হয়।


মাথায় আঘাতের অস্ত্রোপচারগত চিকিৎসা হল:

  • মাথার খুলির ফাটলের মেরামত করা।
  • রক্তাক্ত মস্তিষ্কের ধমনীগুলির সেলাই করা।
  • মস্তিষ্কের চাপ কমানোর জন্য মাথার খুলিতে ফাঁক তৈরি করা।
  • অস্ত্রোপচার ও ওষুধ ছাড়া, মস্তিষ্কের ক্ষতির কারণে আক্রান্ত মস্তিষ্ক ও অঙ্গগুলির কার্যকারিতা উন্নত করার জন্য পুনর্বাসনের প্রয়োজন। পুনর্বাসনের মধ্যে রয়েছে ফিজিওথেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি, কাউন্সেলিং এবং রিক্রিয়েশনাল থেরাপি।

শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে