হার্ট ফেইলিওর কি?
আমাদের শরীরের ঠিক বুকের মাঝে অবস্থিত হৃৎপিন্ড মায়ের গর্ভাবস্থায় ২২ দিন থেকে আমৃত্যু দেহের সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গসমূহে শোধিত রক্ত ও জীবকোষসমূহের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্য তথা বিভিন্ন জৈব উপাদান সরবরাহ করে যা কিনা পরিশেষে আমাদের সুস্বাস্থ্য ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে সহায়তা করে। এই হৃৎপিণ্ডের অকৃতকার্যতা, যা ইংরেজিতে হার্ট ফেইলিউর (এইচএফ), কনজেসটিভ হার্ট ফেইলিওর (সিএইচএফ), ডিকম্পেনসেটিও কর্ডিস (ডিসি) এবং কনজেসটিভ কার্ডিয়াক ফেইলিউর (সিসিএফ) বা হার্ট ফেল নামেও পরিচিত হলো এমন একটি অবস্থা যখন হৃৎপিণ্ড, বিপাকের জন্য প্রয়োজনীয় রক্ত দেহকলাতে সরবরাহ করতে পারে না।

হার্ট ফেল হল একটি সাধারণ অবস্থা যেখানে হৃৎপিন্ডের পাম্পিং ফাংশনটি ব্যাপকভাবে হ্রাস পায় যেমন এটি শরীরের বাকি অংশে যথেষ্ট পরিমাণে রক্ত সরবরাহ করতে পারে না। এটি প্রায়ই বয়ষ্ক ব্যক্তি এবং যারা অনেক বছর ধরে হার্টের অসুখে ভুগছেন, তাদের মধ্যে দেখা যায়। এটি একটি জরুরী অবস্থা এবং অবিলম্বে হাসপাতালে চিকিৎসা করা আবশ্যক।

হার্ট ফেইলিওর এর প্রধান লক্ষণ ও উপসর্গগুলি কি কি?
হার্ট ফেইলিউর এমন একটি প্যাথোফিজিওলজিকাল অবস্থা যেখানে কার্ডিয়াক আউটপুট শরীর এবং ফুসফুসের রক্তের চাহিদা মেটাতে ব্যার্থ হয়। এর সাধারণ লক্ষণ ও উপসর্গগুলি হল:

  • শ্বাসকষ্ট
  • অল্পেই হাঁপিয়ে ওঠা
  • পায়ে পানি জমা
  • মাথাব্যথা, বিভ্রান্ত বোধ হওয়া
  • উদ্বিগ্নতা
  • হৃদস্পন্দন বা নাড়ির গতি বৃদ্ধি (ট্যাকিকার্ডিয়া)
  • নিম্ন রক্তচাপ (হাইপোটেনশন)
  • রক্তজমা
  • টিস্যু এবং ফুসফুস বা শরীরের অন্যান্য অংশের শিরাগুলিতে তরল তৈরি হওয়া
  • অ্যাসাইটিস (তলপেটে তরল জমা হওয়া)
  • রাত্রে বারবার প্রস্রাব পাওয়া
  • বুক ধড়ফড় করা
  • বুকের অংশে ব্যথা অনুভব এবং তা তলপেটের দিকে ছড়িয়ে যাওয়া আবার উপর দিকে উঠে আসা ইত্যাদিকে হার্ট ফেইলিউরের সাধারণ লক্ষণ হিসেবে ধরা হয়।


হার্ট ফেইলিউরের লক্ষণগুলি সাধারণভাবে বাম এবং ডান হার্ট ফেইলিউরে বিভক্ত।

যদি হৃৎপিণ্ডের কোনও একটি ভেন্ট্রিকল ফেইলিউরের একজন ব্যক্তি দীর্ঘকাল বেঁচে থাকেন তবে এটি উভয় ভেন্ট্রিকল ফেইলিউরের দিকে অগ্রসর হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, বাম ভেন্ট্রিকলের ফেইলিউরে পালমোনারি এডিমা এবং পালমোনারি হাইপারটেনশন ঘটায় যা ডান ভেন্ট্রিকলের উপর চাপ বাড়ায়। ডান ভেন্ট্রিকুলার ফেইলিউর বাম ভেন্ট্রিকল ফেইলিউরের মতো ক্ষতিকারক নয়, তবে এটি নিরীহও নয়।

হার্ট ফেইলিওর এর কারণগুলি কি কি?
হার্ট ফেইলিউর হৃৎপিণ্ডের বিপুল সংখ্যক রোগের সর্বশেষ ফলাফল। হার্ট ফেল করার মুখ্য কারণগুলি নিচে উল্লেখ করা হল:
কার্ডিয়াক বা হৃদপিণ্ড জনিত কারণ-

  • উচ্চ রক্তচাপ
  • স্টেনোসিস (অর্টিক অথবা পালমোনারির মতো রক্তবাহিকাগুলির সংকীর্ণতা)
  • ইন্টারেট্রিয়াল অথবা ইন্টারভেন্ট্রিকুলার সেপ্টাল ত্রুটির মতো পরিকাঠামোগত ত্রুটি (হৃদপিণ্ডের দেওয়ালগুলির মধ্যে ছিদ্র)
  • মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন (হৃদপিণ্ডের পেশীর ক্ষতি)
  • সংক্রামক এন্ডোকার্ডাইটিস।


অন্যান্য কারণগুলির মধ্যে রয়েছে-

  • সংক্রমণ
  • পালমোনারি এম্বোলিজম (ফুসফুসে রক্ত জমাট বাঁধা)
  • বিটা-ব্লকার, স্টেরোয়েড বিহীন প্রদাহরোধী ওষুধ ইত্যাদির মতো ওষুধের উচ্চমাত্রা
  • শারীরিক ও আবেগজনিত চাপ।
  • রক্তে চর্বির আধিক্য
  • গ্লুকোজের পরিমাণ বেশি হওয়া।


হার্ট ফেইলিওর কিভাবে নির্ণয় ও চিকিৎসা করা হয়?
উপসর্গগুলি বুঝতে, রক্তচাপের রিডিংগুলি নিতে এবং হৃদস্পন্দনের শব্দ পরীক্ষা করে দেখতে চিকিৎসক রোগীর ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য নেন।

রোগ নির্ণয় করতে চিকিৎসক ল্যাবরেটরি টেস্ট ও শারীরিক পরীক্ষা, উভয়ের সাহায্যই নেন। নিম্নলিখিত জিনিসগুলি জানার জন্য ল্যাবরেটরি পরীক্ষাগুলি করা হয়-

  • ইউরিয়া
  • ইলেক্ট্রোলাইট
  • কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট
  • বিএনপি (ব্রেন নেট্রিইউরেটিক পেপ্টাইড)
  • লিভার বা যকৃতের কাজকর্ম পরীক্ষা
  • কিডনি বা বৃক্কের কাজকর্ম পরীক্ষা
  • ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাম (ইসিজি), বুকের এক্স-রে এবং ইকোকার্ডিওগ্রাফির মতো ইমেজিং টেস্ট বা পরীক্ষাও করা হয়।


হার্ট ফেইলিওর এর চিকিৎসার সাথে যুক্ত ওষুধ:
বেশ কয়েকটি ওষুধ এই রোগের কারণকে প্রশমিত করতে পারে। যেমন মিথাইলেফিনেডট, ট্রাইসাইক্লিক এন্টিডিপ্রেসেন্টস, লিথিয়াম, অ্যান্টিসাইকোটিকস, ডোপামিন অ্যাগ্রোনিস্টস, টিএনএফ ইনহিবিটারস, ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকারস, সালবুটামল এবং ট্যামসুলোসিন ।

হৃদপিণ্ড প্রায় বিকল হয়ে পড়া রোগীর দেখভালের জন্য যেসব পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়:

  • শারীরিক ও মানসিক বিশ্রাম
  • ওজন কমানো
  • অক্সিজেন থেরাপির মাধ্যমে শ্বাসকষ্টে সুরাহা দেওয়া
  • খাদ্য তালিকার পরামর্শ
  • মদ্যপান ও ধূমপানে অবসান
  • নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম।


সুশৃঙ্খল জীবনযাপনই হার্ট ফেইলিওর রোগীর উপসর্গ কমাতে পারা তথা সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। নিয়মিত ওষুধ সেবন, পানি পরিমিত সর্বসাকুল্যে ৮শত থেকে ১২শত মিলি (বেশি পানি ফুসফুস তথা পায়ে জমাতে পারে যাতে করে রোগীর শ্বাসকষ্ট বেড়ে যেতে পারে), সহজে হজম হয় এমন নরম খাবার তিনবারের স্থানে ছয়বার খাওয়া শ্রেয়। সহনীয় পর্যায়ে কায়িক পরিশ্রম বা হাঁটা, ধূমপান, অ্যালকোহল বর্জন, বাড়তি বা আলগা কাঁচা লবণ না খাওয়াসহ রক্তে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণই পারে হার্ট ফেইলিওর রোগীকে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে। মনে রাখতে হবে, এসব ক্ষেত্রে প্রতিকার নয় প্রতিরোধ সর্বদা উত্তম। প্রাথমিক অবস্থায় হার্টের এসব লক্ষণে চিকিৎসকের পরামর্শ নিলে জটিলতা অনেকটাই এড়ানো যায়। তাই অবহেলা না করে হার্টের বিভিন্ন সমস্যা ও রোগের লক্ষণ নিয়ে সতর্ক ও সচেতন হতে হবে। এতে করে অনেক জটিলতা প্রাথমিক অবস্থায় এড়ানো যায়।


শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে