আয়োডিনের ঘাটতি কি?
আয়োডিন একটি রাসায়নিক পদার্থ, যা আমাদের শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান থাইরয়েড হরমোন তৈরি করতে সহায়তা করে।

আয়োডিন হল একটি ট্রেস বা একক উপাদান এবং খাদ্যতালিকার অপরিহার্য পরিপোষক পদার্থ। আয়োডিন হল থাইরয়েড হরমোন থাইরক্সিন (চারটি আয়োডিন অণু নিয়ে টি৪) এবং ট্রাইডোথ্রাইরোনাইনের (তিনটি আয়োডিন অণু নিয়ে টি৩) একটি উপাদান। আমাদের শরীর নিজে আয়োডিন তৈরি করতে পারে না; সুতরাং, আমাদের খাবারের সাথে বাইরে থেকে এটা গ্রহণ করতে হয় অর্থাৎ আমাদের প্রতিদিনকার খাদ্যে যদি আয়োডিন উপয়াদানটি না থাকে তাহলে আমাদের আয়োডিনের ঘাটতি তৈরি হয়। আয়োডিনের অভাবে থাইরয়েড হরমোনের কম উৎপাদন হয় যার ফলে হাইপোথাইরয়েডিজম হয় (এটি হলে থাইরয়েড গ্রন্থির কাজে ব্যাঘাত ঘটে), গয়েটর (থাইরয়েড গ্রন্থির বৃদ্ধি), এর সাথে উচ্চতা কম বৃদ্ধি বা বামনত্ব এবং গর্ভাবস্থা-সম্পর্কিত সমস্যা হয়। গর্ভবতী এবং স্তন্যপান করানো মহিলাদের প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি আয়োডিনের প্রয়োজন হয় এবং তারা উচ্চ ঝুঁকিসম্পন্ন ও তাদের আয়োডিনের ঘাটতির হওয়ার সম্ভবনা বেশি।

আয়োডিনের ঘাটতি দেখা দিলে আমাদের শরীরে গলগন্ড রোগ দেখা দেয়। এটি মূলত আমাদের থাইরয়েড গ্রন্থি ফুলে যাওয়ার কারণে তৈরি হয়। আর অনেকদিন যদি আয়োডিনের ঘাটতি আমাদের শরীরে বিদ্যমান থাকে তাহলে তা বড় বড় রোগের জন্ম দেয়। এমনকি মহিলারা বন্ধ্যাও হয়ে যেতে পারে। এটি বুদ্ধিবৃত্তিও কমিয়ে দেয়।

আয়োডিনের ঘাটতির প্রধান লক্ষণ এবং উপসর্গগুলি কি কি?
আয়োডিনের অভাবসম্পন্ন রোগীর নিম্নলিখিত চিকিৎসাগত অবস্থার সাথে সম্পর্কিত উপসর্গগুলি থাকতে পারে:

  • শরীর প্রচন্ড দুর্বল লাগা।
  • মুখ ফুলে যাওয়া।
  • ভঙ্গুর নখ, চুল পাতলা এবং অমসৃণ হয়ে যাওয়া।
  • চোখে ফোলাভাব, শুষ্ক এবং বিবর্ণ ত্বক।
  • কলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি, পেশী বা সন্ধিতে ব্যথা, কঠিনত্ব।
  • ধীরগতিতে কথা বলা।
  • শ্রবণশক্তি চলে যাওয়া।
  • থাইরয়েড, স্তন, প্রস্টেট এবং অন্যান্য প্রজননতন্ত্র সম্পর্কিত সমস্যা।
  • স্মৃতিশক্তি হ্রাস।
  • থাইরয়েড গ্রন্থি ফুলে গিয়ে গলগন্ড রোগ, শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা, গিলতে সমস্যা এবং কখনও কখনও বিষম খাওয়া।
  • হাইপোথাইরোডিজম- ওজন বৃদ্ধি, অবসাদ, শুষ্ক ত্বক এবংবিষণ্ণতা।
  • মাংশপেশি নড়াচড়ায় কষ্ট হওয়া।
  • মহিলাদের মাসিক অনিয়মিত হয়ে পড়া।
  • অতিরিক্ত আয়োডিনের ঘাটতি হলে মহিলারা বন্ধ্যাও হয়ে যেতে পারে।
  • গর্ভাবস্থা সম্পর্কিত সমস্যা-গর্ভস্রাব, মৃত সন্তান প্রসব, অকালে জন্মদান এবং শিশুদের মধ্যে জন্মগত ত্রুটি।


আয়োডিনের অভাবে আরও যে সমস্যা হয়-

  • থাইরয়েড গ্রন্থি আকারে বেড়ে যায়, থাইরয়েড হরমোনের নিঃসরণ কমে গিয়ে হাইপো-থাইরয়েডিজম হয়, বুদ্ধির বিকাশ কমে যায়, মানসিক অসুস্থতা শুরু হয় এমনকি মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
  • স্নায়ু ও সংলগ্ন পেশির স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়ে গিয়ে পেশি দুর্বল হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।
  • হবু মায়ের আয়োডিন ঘাটতি হলে শিশুর বুদ্ধির বিকাশ হয় না, মানসিকভাবে বিপন্ন ও স্প্যাস্টিক শিশুর জন্ম হয়। এমনকি ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই ভ্রূণ মারা যেতে পারে।
  • বাচ্চাদের কানে কম শোনা ও কথা বলতে না পারার মত সমস্যার ঝুঁকি থাকে, জন্মের পর আয়োডিনে অভাব হলে বাচ্চা ক্রমশ জড়বুদ্ধি হয়ে পড়ে। বাচ্চার বেড়ে উঠতে সমস্যা হয়। বৃদ্ধি ব্যাহত হয়ে শিশুটি ডোয়ার্ফ বা বামন হয়ে যেতে পারে।
  • এ ছাড়া চুল ঝরে যাওয়া, ওজন বাড়া, ত্বক খসখসে হয়ে যাবার মত সমস্যা হয়।


আয়োডিনের ঘাটতির প্রধান কারণগুলি কি কি?
আয়োডিনের গুরুত্বপূর্ণ উৎস হল খাবার লবণ। খাদ্যতালিকায় কম লবন গ্রহণ, পাশাপাশি লবণে কম আয়োডিনের কারণে শরীরে আয়োডিনের অভাব ঘটে। লবণে আয়োডিনের মাত্রা কমে যায় রান্নার সময়। মাংসের তুলনায় ফল এবং শাকসব্জিতে আয়োডিন কম থাকে বা থাকেই না; অতএব, যে ব্যক্তি নিরামিশ খাদ্য গ্রহণ করেন তাঁর আয়োডিনের অভাব হওয়ার সম্ভবনা বেশি। শরীরচর্চার সময় প্রচুর পরিমানে আয়োডিন বেরিয়ে যায়, ফলে আয়োডিনের অভাব ঘটে।

আয়োডিনের ঘাটতি কিভাবে নির্ণয় করা হয় এবং এর চিকিৎসা কি?
কিছু পরীক্ষার দ্বারা আয়োডিনের অভাব নির্ণয় করা হয়:

  • মূত্রে আয়োডিনের পরিমান-আয়োডিনের ঘনত্ব মূত্র থেকে পরিমাপ করা হয়। লঘু পরিমাণে আয়োডিনের অভাব হলে আয়োডিনের ঘনত্ব, ৫০ থেকে ৯৯ এমসিজি/এল, মাঝারি পরিমাণে অভাব হলে ২০ থেকে ৪৯ এমসিজি/এল এবং গুরুতর অভাব হলে ২০র কম এমসিজি/এল।
  • থাইরয়েডের আকার- থাইরয়েডের আকার নির্ণয়ের জন্য আল্ট্রাসনোগ্রাফি হল সবচেয়ে সঠিক পদ্ধতি।
  • নিওনেটাল সিরাম থাইরয়েড - সদ্যজাতদের মধ্যে উদ্দীপক হরমোন (টিএসএইচ)।
  • সিরাম থাইরোগ্লোবুলিন।
  • রেডিওআয়োডিন- আয়োডিনের অভাবের কারণে থাইরয়েড দ্বারা রেডিওআয়োডিনের বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকে।


আয়েডিনের অভাবের চিকিৎসাগুলি হল:

  • লবণ আয়োডিনযুক্ত করা- খাদ্যতালিকায় আয়োডিনযুক্ত লবণের সংযোজন আয়োডিনের অভাবের চিকিৎসার একটি কার্যকর উপায়।
  • অন্যান্য পদ্ধতি- তেলে আয়োডিন মেশানো (লিপিওডল), এবং আয়েডিনযুক্ত পানি খাওয়া এবং আয়োডিন ট্যাবলেট বা ড্রপ ব্যবহার।
  • আয়োডিন সমৃদ্ধ খাবার বেশি করে গ্রহন, যেমন সমুদ্র-শৈবাল, টক দই, ভাজা কড মাছ, দুধ, মাছের কাঁটা, সাদা রুটি, চিংড়ি এবং খোসা সহ সাদা আলু।
  • যে খাদ্যের আয়োডিন কম শোষিত হয় থাইরয়েডের দ্বারা সেটি এড়িয়ে চলুন যেমন সয়াবিন, বাাঁধাকপি, ব্রোকলি এবং ফুলকপি।


আয়োডিনের মাত্রা বৃদ্ধির উপায়গুলি:

  • শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থগুলি দূর করা।
  • আয়োডিন খাদ্য হিসাবে গ্রহণ বাড়ানো।
  • সবসময় স্বাস্থ্যকর খাদ্যগ্রহণ করা।

শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে