১০ বছরের রিমা রংপুর শহরের নামকরা একটি বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণির ছাত্রী। তার বাবা দেশের একটি প্রথম সারির ওষুধ কোম্পানির জেলা বিক্রয় ব্যবস্থাপক। একদিন হঠাৎ রিমার কানে, গলায় ও নাকে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়। তবে প্রচলিত ব্যথানাশক ওষুধ সেবনে তা সঙ্গে সঙ্গে ভালোও হয়ে গেল। কিন্তু পরের দিন আবারও দেখা গেল সেই ব্যথা, সঙ্গে শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করতে না পারার সমস্যা।

রিমার বাবা মা তাকে স্থানীয় নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে গেলেন। কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার পর চিকিৎসক জানালেন রিমার মেনিনজাইটিসে আক্রান্ত হওয়ার মত উপসর্গ আছে, তাই দেরি না করে দ্রুত তাকে যেন রংপুর মেডিকেল কলেজ-হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সঙ্গে সঙ্গেই রিমাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও রাত পেরোবার আগেই খবর এলো রিমা চলে গেছে না ফেরার দেশে।

প্রিয় পাঠক, রিমার মত বিশ্বে প্রতি মিনিটে ১ জন মানুষ মেনিনজাইটিসে আক্রান্ত হয়, আর প্রতি ২৪ ঘণ্টায় মারা যায় একশত সাইত্রিশ জন। মেনিনজাইটিসের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া প্রতি ৫ জন রোগীর অন্তত ১ জনের চিরস্থায়ী অঙ্গহানি, মস্তিষ্কের সমস্যা, বধিরতা বা দৃষ্টি শক্তি হারানোর মত করুণ পরিণতি ভোগ করতে হয়।

এবার চলুন দেখি জানা যাক, মেনিনজাইটিস কি ধরনের রোগ।

মেনিনজাইটিস রোগ কি?
দুরারোগ্য নয়, কিন্তু বাড়তে দিলে বিপদ। অল্পবিস্তর রোগেও হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসা করা দরকার। মেনিনজাইটিস সম্পর্কে এমনটাই পরামর্শ চিকিৎসকদের। মস্তিস্ক ও সুষুম্নাকাণ্ডের চারপাশে ঘিরে থাকা যে টিস্যু স্তরের আবরণগুলি এদের সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করে সেটি হল মেনিনজেস। মেনিনজিস হল আমাদের মস্তিষ্কের একদম বাইরের আবরণ। এর আবার তিনটি স্তর আছে। একদম বাইরের স্তরের নাম ড্যুরাম্যাটার, মাঝের স্তর অ্যারকনয়েড ম্যাটার আর একদম ভিতরে পায়াম্যাটার। এই তিনটে স্তরের মাঝখানে থাকে অজস্র সুক্ষ্ম রক্তজালক। কোনও ভাবে এখানে জীবাণু পৌঁছে গেলেই গোলমালের সূত্রপাত। ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ারা এখানে পৌঁছে আক্রমণ করলে মেনিনজিসের প্রদাহ হয় ও ফোলাভাব দেখা দেয়। একেই মেনিনজাইটিস বলা হয়। সংক্রমণ যদি আরও ভেতরে পৌঁছে যায়, তখন মারাত্মক বিপদের ঝুঁকি বাড়ে। তাই সময়মত ধরা না পড়লে এবং চিকিৎসা না হলে এই সমস্যার ফলে প্রাণহানি হতে পারে।

মেনিনজাইটিসের প্রকারভেদঃ

  • ব্যাকটেরিয়াল মেনিনজাইটিস: বয়সভেদে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাকটেরিয়া ভিন্ন ভিন্ন ব্যাকটেরিয়াল মেনিনজাইটিসের জন্য দায়ী। সদ্যজাত থেকে শুরু করে ৩ মাস বয়সী শিশুর ক্ষেত্রে প্রধানত গ্রুপ-বি স্ট্রেপটেকক্কি ও লিস্টেরিয়া। সাধারণত মনোসাইটোজিনেসিস দ্বারা মেনিনজাইটিস হয়ে থাকে। পরিণত শিশুদের মেনিনজাইটিসের জন্য দায়ী নাইসেরিয়া মেনিনজাইটিডিস, স্ট্রেপটোকক্কাস নিউমোনিয়া এবং হেমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ-বি। বড়দের শতকরা ৮০ ভাগ ব্যাকটেরিয়াল মেনিনজাইটিসের কারণ নাইসেরিয়া মেনিনজাইটিডিস ও স্ট্রেপটোকক্কাস নিউমোনিয়া। পঞ্চাশোর্ধ ব্যক্তির ক্ষেত্রে লিস্টেরিয়া মনোসাইটোজিনেসিস জনিত মেনিনজাইটিসের হার অনেক বেশি।
  • ভাইরাল মেনিনজাইটিস: ভাইরাস জনিত মেনিনজাইটিস ব্যাকটেরিয়া জনিত মেনিনজাইটিসের চাইতে কম ভয়ংকর। ভাইরাল মেনিনজাইটিসের প্রধান জীবানু এন্টেরোভাইরাস। এর বাইরেও কিছু ভাইরাস এই রোগের সৃষ্টি করে যা মশার মাধ্যমে একজনের কাছ থেকে অন্য জনে ছড়াতে পারে।
  • ফাংগাল মেনিনজাইটিস: ফাংগাল মেনিনজাইটিসের প্রধান জীবানু ক্রিপটোকক্কাস নিউফরমান্স। রোগ প্রতিরোধকারী ক্ষমতা হ্রাসের ওষুধ সেবনকারী, এইডস/এইচআইভি আক্রান্ত রোগী ও বয়স্ক মানুষ ফাংগাল মেনিনজাইটিসের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ফাংগাল মেনিনজাইটিসের প্রকোপ আফ্রিকা মহাদেশে সবচাইতে বেশি এবং তা ২০ থেকে ২৫% এইডস আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর কারণ। অন্য যেসব ফাংগাস মেনিনজাইটিস ঘটায় সেগুলো হলো হিস্টোপ্লাজমা ক্যাপসুলাটাম, কক্কিডায়োআইডেস ইমিটিস, ব্লাস্টোমাইসেস ডার্মাটাইটিস, ক্যানডিডা স্পেসিস প্রভৃতি।
  • প্যারাসাইটিক মেনিনজাইটিস: এই ধরনের মেনিনজাইটিসের প্রধান প্রধান জীবানু হলো এ্যাংজিও স্ট্রংগিলাস, ক্যান্টোনেনসিস, গ্যান্থোসটোমা স্পিনিজেরাম, সিস্টোসোমা প্রভৃতি। প্যারাসাইটিক মেনিনজাইটিসে সেরেব্রো স্পাইনাল ফ্লুইডে ইসোনোফিল (এক ধরনের শ্বেত কনিকা) পাওয়া যায়।
  • জীবানুবিহীন মেনিনজাইটিস: জীবানুর বাইরেও কিছু কারণে মেনিনজাইটিস হতে পারে যার মধ্যে ক্যান্সারের বিস্তৃতি, কিছু বিশেষ ওষুধ সেবন (ব্যথা ও প্রদাহ বিরোধী ওষুধ, ইমিউনোগ্লোবিন, জীবানু বিরোধী ওষুধ), সারকোডিয়াসিস, কানেকটিভ টিস্যু ডিজঅর্ডার, সিস্টেমিক লুপাস ইরাথেমেটাসাস বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কোন কোন ক্ষেত্রে মাইগ্রেন থেকেও মেনিনজাইটিস হতে পারে যদিও এ হার অনেক কম।


মেনিনজাইটিসের প্রধান লক্ষণ ও উপসর্গগুলি কি কি?

  • এই রোগের প্রাথমিক পর্যায়ের পরিচিত উপসর্গগুলি হল ঘাড় শক্ত হয়ে যাওয়া, জ্বর এবং বিভ্রান্তির পাশাপাশি বমিভাব, বমি ও মাথা যন্ত্রণা।
  • অন্যান্য উপসর্গের মধ্যে আছে আলোর প্রতি সংবেদনশীলতা, বিরক্তি এবং ক্ষুধার হ্রাস।
  • অসুখ আরো অগ্রসর হলে অর্ধচেতনা, মস্তিষ্কের ক্রিয়া দুর্বল হয়ে পড়া ও সিজারের মতো লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
  • ব্যাকটেরিয়াল মেনিনজাইটিস একটি সংক্রামক ও গুরুতর প্রকৃতির মেনিনজাইটিস। এক ধরনের ব্যাকটেরিয়াল মেনিনজাইটিসে পরের দিকের উপসর্গ হিসাবে ত্বকে ফুসকুড়ি দেখা যায়। এই রোগের সাথে যুক্ত কিছু দীর্ঘস্থায়ী উপসর্গ হল ব্রেন ড্যামেজ বা মস্তিষ্কের ক্ষতি, দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তি লোপ।
  • ভাইরাল মেনিনজাইটিসের ফলে প্রাণহানি এবং সংক্রামক হওয়ার ঘটনা অতি বিরল, তবে এর ফলে মাথা যন্ত্রণা ও স্মৃতিশক্তির সমস্যার মত কিছু দীর্ঘস্থায়ী উপসর্গ দেখা যেতে পারে।
  • ফাঙ্গাল মেনিনজাইটিস রোগটি বিরল। দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ, যেমন ক্যান্সার বা এইডস রোগীদের মধ্যে এটি দেখা যেতে পারে।


মেনিনজাইটিসের প্রধান কারণগুলি কি?
মেনিনজাইটিস রোগটি সংক্রামক অথবা অসংক্রামক হতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেনিনজাইটিসের কারণ হল বিভিন্ন প্রকারের ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ফাংগাস, প্রোটোজোয়া প্রভৃতি। তবে বিভিন্ন ধরনের ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় বা ক্যান্সারের কারণেও মেনিনজাইটিস হতে পারে।

সংক্রামক মেনিনজাইটিস ঘটায় কিছু জীবাণু যারা রক্তপরিবহনের মাধ্যমে দেহে ছড়িয়ে পড়ে মস্তিস্ক বা সুষুম্নাকান্ডে পৌঁছে যায়। এইসব জীবাণু মেনিনজেস ও চারিপাশের তরলে সংক্রমণ ঘটালে সেখানে প্রদাহ ও ফোলাভাব সৃষ্টি হয়। মেনিনজাইটিসের জন্য দায়ী জীবাণুগুলি হল:

  • ব্যাকটেরিয়া- সট্রেপ্টোকক্কাস নিউমোনি, নিসারিয়া মেনিনজাইটিডিস।
  • ভাইরাস- ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস, মিসলস (হাম) ভাইরাস, এইচআইভি এবং একোভাইরাস।
  • ফাঙ্গি বা ছত্রাক- ক্যান্ডিডা এলবিক্যান্স, ক্রিপ্টোকক্কাস নিওফর্মানস এবং হিস্টোপ্লাজমা।


অসংক্রামক মেনিনজাইটিসের কারণগুলি হল:

  • ক্যান্সার।
  • রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া।
  • মাথার আঘাত বা মস্তিষ্কে এবসেস (সীমাবদ্ধ প্রদাহ)।
  • লুপাস।
  • বিভিন্ন ধরনের ওষুধের প্রতিক্রিয়া।


মেনিনজাইটিস রোগ কিভাবে নির্ণয় এবং চিকিৎসা করা হয়?
দ্রুত চিহ্নিতকরণ এবং চিকিৎসা করা হলে এই রোগটির ফলে মৃত্যু ও মস্তিষ্কের ক্ষতি এড়ানো সম্ভব।

মেনিনজাইটিস নির্ণয় করার জন্য নিম্নোক্ত পরীক্ষাগুলি করা অবশ্য প্রয়োজনীয়:

  • লাম্বার পাংচার- ব্যাকটেরিয়াল মেনিনজাইটিস নিশ্চিত নির্ণয়ের জন্য মস্তিষ্কসুষুম্না তরল সংগ্রহ করে মাইক্রোবিয়াল কালচার, সিবিসি, প্রোটিন ও গ্লুকোজ মাত্রা এবং সি-রিআক্টিভ প্রোটিন (ইনফেকশন মার্কার) প্রভৃতি পরীক্ষা করা হয়।
  • শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যা বৃদ্ধি।
  • মাথার সিটি স্ক্যান।
  • মেনিনজাইটিসের ফুসকুড়ির পজিটিভ গ্লাস টেস্ট।


মেনিনজাইটিসের চিকিৎসায় যে পদ্ধতিগুলি ব্যবহৃত হয়:

  • ব্যাকটেরিয়াল মেনিনজাইটিসে ইনট্রাভেনাস এন্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা হয় যা শরীর থেকে সংক্রামক ব্যাকটেরিয়া অপসারণে সাহায্য করে।
  • ফাঙ্গাল মেনিনজাইটিসের চিকিৎসায় এন্টিফাঙ্গাল ওষুধ ব্যবহার হয়।
  • ভাইরাল মেনিনজাইটিসে ইনট্রাভেনাস এন্টিভাইরাল ওষুধ দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু সাধারণত নিজে থেকেই এটির নিরাময় হয়ে যায়।
  • মেনিঙ্গকক্কাল ভ্যাকসিন এবং হিমোফিলাস ইনফ্লুয়েনজি টাইপ বি ভ্যাকসিনের মত কিছু টীকা মেনিনজাইটিস থেকে সুরক্ষা দিতে পারে।
  • সুষ্ঠ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং মেনিনজাইটিসের প্রাদুর্ভাব আছে এরকম অঞ্চলে যাওয়ার আগে প্রয়োজনীয় টীকা নেওয়ার মাধ্যমে এই রোগটিকে এড়ানো সম্ভব।

শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে