শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে
Jobedali

Call

এখান থেকে ওখানে যাবেন, সেখান থেকে আবার আরেকটু দূরত্বে…ব্যাপারটা ওই স্বল্পের মধ্যে হলে পায়ে হেঁটেও মিটে যায়। যাঁরা রাস্তায় বেরিয়ে একটা স্টপেজ যেতেও যানবাহনের সাহায্য নেন, তাঁদের কথা বাদ দিন। যাইহোক, দূরত্বটা বেশি হলে আমাদের গাড়ির সাহায্য নিতেই হয়। বেশিরভাগ মানুষই অফিস-কাছারি, আবার জরুরি কাজে যাতায়াতের জন্য বাস, ট্যাক্সি, ট্রেন – ইত্যাদির সাহায্য নেন। কলকাতার মতো শহরে ছোটো রুটে অটোকেও বেছে নেন অনেকেই যাতায়াতের জন্য। দিল্লি, মুম্বইয়ের মতো এমন শহরও আছে, যেখানে অটোর মতো পরিবহন মাধ্যমকে ট্যাক্সির বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

এখন যেভাবে দূষণের মাত্রা বাড়ছে, তাতে পরিবেশবিদরা পরামর্শ দিচ্ছেন, পরিবেশকে বাঁচাতে বাস বা শাটল ট্যাক্সির মতো যানবাহনকে বেছে নিতে যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে। তাতে যেমন জীবাশ্ম জ্বালানি বাঁচবে, তেমনই পরিবেশে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রাতে লাগাম টানাও যাবে। তবে, সেসব অনেক ক্ষেত্রেই পরামর্শ হিসেবে থেকে যায়। কারণ, নিজের একটা দু’চাকা বা চার চাকার গাড়ির শখ সবারই থাকে। আর পকেটে দম থাকলে সেই শখ থেকে তাঁকে বিরত রাখার অধিকার কারওরই নেই। গাড়ি কেনার সময় সাধারণ মানুষ গতির তুলনায় প্রাধান্য দেন মাইলেজকে। কারণ, রোজকার যাতায়াতে ব্যস্ত রাস্তায় কোনওভাবেই গতির ঝড় তোলা সম্ভব নয়। তেলের দামটাও নজরে রাখতে হয়। তাই যে গাড়ি কম তেল খেয়ে বেশিদূর নিয়ে যেতে পারবে, সেই গাড়িকেই বেছে নেন সাধারণ মানুষ।

আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশ থেকে অনেক মানুষ বিদেশে পাড়ি দিলেও, সেই সংখ্যাটা কম। এদেশে এমন অনেক উচ্চবিত্তও আছেন, যাঁরা দেশের মধ্যে প্রচুর বেড়িয়েছেন, অথচ বিদেশে যাননি। ডোমেস্টিক এয়ারলাইন্স থাকলেও, ট্রেনে যাতায়াতকেই বেছে নেন অনেকে। কারণ, খরচটা বেশি। আবার প্রায় সমান সমান হলেও, যা বাঁচে তাই লাভ। তবে, বাইরে যেতে গেলে বিমানে চড়তে হবেই। আবার দেশের মধ্যে ত্রিপুরার মতোও জায়গা আছে, যেখানে বিমান ছাড়া যেতে পারবেনই না। বড়-ছোটো যাইহোক না কেন, একটা বিমানের আয়তন কিন্তু কোনও অংশে কম নয়। শয়ে শয়ে যাত্রী ও তাঁদের মালপত্র ছাড়াও বিমানকে চালানোর জন্য ব্যবহৃত ইঞ্জিন ও যন্ত্রাংশ রাখার জন্যও বেশ বড়সড় মাপের জায়গা লাগে। এবার আয়তন যত বড় হয় তার মালপরিবহন সক্ষমতাও ততটা বাড়ে, আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে জ্বালানি খরচ। কারণ, যত বেশি ওজন, তত বেশি জ্বালানির প্রয়োজন হয়

এই যেমন বোয়িং ৭৪৭ বিমান। এই বিমান প্রতি সেকেন্ডে চার লিটার করে জ্বালানি পোড়ায়। তাহলে ভাবুন, এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে যেতে দশ ঘণ্টার যাত্রা পথে কতোটা জ্বালানি খরচ হতে পারে। এক্ষেত্রে অ্যাভিয়েশন ফুয়েল বা বিমান জ্বালানির খরচের মাত্রা দেড় লক্ষ লিটার। বোয়িং সংস্থার ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী তাদের ৭৪৭ মডেলের বিমানটি প্রতি কিলোমিটারে ১২ লিটার করে জ্বালানি ব্যবহার করে।

মাইলেজের বিচারে এই হিসেব হার্ট-অ্যাটাক দেওয়ার সমান। তবে, এটাও ঠিক, বোয়িং ৭৮৭ বিমান ৫৬৮ জন মানুষ বহনে সক্ষম। গড়ে হিসেব করলে যাত্রী সংখ্যা যদি ৫০০ ধরা হয়, তাহলে কিলোমিটার প্রতি ওই সংখ্যক যাত্রীর জন্য ১২ লিটার জ্বালানি খরচ দাঁড়াচ্ছে। জন প্রতি হিসেব দাঁড়াচ্ছে ০.০২৪ লিটার। এবার দশ ঘণ্টার যাত্রা পথের হিসেবে মাথা পিছু জ্বালানি হ্রাস ৪২ কিলোমিটারে এক লিটার। আর সেখানে একটা ফোর সিটার গাড়ি কিন্তু ১৫ কিমি মাইলেজ দেয় প্রতি লিটারে। তাহলে, এবার কি বলবেন, বিমান রাখলে ভালো হয়, গাড়ির বদলে! কিন্তু, বিমান রাখার খরচ কিন্তু তো হাতি পোষার সমান। সে বোয়িং ৭৪৭-এর গতিবেগ ঘণ্টায় যতই ৯০০ কিমি হোক।

বিমানের আয়তন নিয়ে আগেই কথা বলছিলাম। বোয়িং বলুন আর এয়ারবাস বলুন, যে কোনও বিমানই রানওয়েতে ছুটতে, আর আকাশে নির্দিষ্ট উচ্চতায় পৌঁছতে এবং নামতে সবচেয়ে বেশি জ্বালানি পোড়ায়। তারপর হাওয়াতে যাত্রাপথ অতিক্রান্ত করতে, তার তুলনায় অনেক কম জ্বালানি খরচ করে। ফলে বিমানের যাত্রাপথ যত লম্বা হয়, তত জ্বালানি খরচ কমে কিলোমিটার অনুযায়ী। কারণ, বারবার ওঠানামা, করতে অনেক বেশি জ্বালানি খরচ হয়ে যায় কিলোমিটারের হিসেবে।

এবার একটা ছোট্টো হিসেব কষা যাক। ধরুণ একটা বিমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক থেকে ইংল্যান্ডের লন্ডন যাচ্ছে। মাঝের দূরত্ব ৩০০০ মাইল। এবার বোয়িং বিমানের যাত্রী সংখ্যা ৫০০ ধরলে, সম্মিলিত যাত্রাপথ দাঁড়াচ্ছে ১৫ লক্ষ মাইল। এবার যদি টিকিটের দাম এক হাজার মার্কিন ডলার হয়, আর সেই দামের জ্বালানি খরচ মূল্য দশ শতাংশ ধরা হয়, তাহলে যাত্রীদের সম্মিলিত জ্বালানি খরচ দাঁড়াচ্ছে ৫০ হাজার মার্কিন ডলার। এক গ্যালন বিমান জ্বালানির ক্রয়মূল্য ৩ মার্কিন ডলার। ফলে ৫০ হাজার মার্কিন ডলার খরচ করে একটি বিমান সংস্থা ১৬৬৬৭ গ্যালন অ্যাভিয়েশন ফুয়েল কিনতে পারবে। ওই পরিমাণ গ্যালন বিমান জ্বালানি দিয়ে ১৫ লক্ষ কিমিকে ভাগ করলে হিসেব দাঁড়াচ্ছে এক গ্যালন জ্বালানি খরচ করে একটি বোয়িং বিমান প্রতি মাইলে ৯০ জন যাত্রী বহন করে। মাথাপিছু হিসেব তাহলে প্রতি গ্যালনে ০.১৮ মাইল।

অর্থাৎ একজন যাত্রীকে এক মাইল পথ নিয়ে যেতে পাঁচ গ্যালন অ্যাভিয়েশন ফুয়েল খরচ করে বোয়িং। এভাবেই বিমানের জ্বালানি খরচ মাপা হয়। যাত্রী সংখ্যা যত কম হয়, লোকসানের পরিমাণ বাড়তে থাকে। এখন বলবেন, দশ শতাংশ জ্বালানিতে খরচ হলো, বাকি নব্বই শতাংশ তো পড়েই রইল। তাহলে বলে রাখি, এই নব্বই শতাংশ অর্থ থেকে বিমান কর্তপক্ষকে এয়ারপোর্টে বিমান রাখার ভাড়া, আকাশ পথ ব্যবহার করার ভাড়া, যেখানে নামবে সেখানকার ভাড়া, তেলের সারচার্জ, যে দেশে যাচ্ছে, সেখানকার সরকারকে কর প্রদাণের পর বিমানের কর্মচারীদের মাইনেও তো মেটাতে হবে। সঙ্গে আরও অনেক কর রয়েছে, যা সাধারণ মানুষ জানেনই না। এতো কিছু মেটাতে মেটাতে টিকিটের মূল্য হিসেবে নেওয়া অর্থ প্রায় নিঃশেষই হয়ে যায়। বাদবাকি যা পড়ে থাকে, সেটা বিমান পরিবহন সংস্থার অর্জিত অংশ বা লভ্যাংশ, যাই বলুন না কেন, ওইটাই। সেটার থেকেও সংস্থাকে আবার ব্যক্তিত আয়ের জন্য ট্যাক্স দিতে হয়।

আমাদের এয়ার ইন্ডিয়া সংস্থা লোকসানের অনেক খবর তো পড়েছেন। এয়ার ইন্ডিয়ার সম্পর্কেও সামান্য বলে রাখি। এই সংস্থা জাম্বো জেট বোয়িং ৭৪৭ চালায়। ৫০০ জন যাত্রী পরিবহনে সক্ষম এই ধরণের বিমান আগেই বলেছি। এছাড়া, দেড়শো যাত্রী আসন বিশিষ্ট এয়ারবাস এ৩২০’ও চালায় এয়ার ইন্ডিয়া। এয়ারবাস চালাতে প্রতি কিলোমিটারে তাদের জ্বালানি খরচ ২.৯১ কেজি। একশো কিমি যাত্রা পথ ধরলে সিট পিছু জ্বালানি খরচের পরিমাণ ২.৪৩ লিটার। বোয়িং ৭৪৭-এর ক্ষেত্রে এই খরচের পরিমাণ একশো কিলোমিটারে সিট প্রতি ৩.৪৩ লিটার। আর প্রতি কিলোমিটারের হিসেবে ১১.১১ কেজি জ্বালানি।

তবে, অ্যাভিয়েশনের ক্ষেত্রে মাইলেজের চাইতে এনডুরেন্সকে গুরত্ব দেওয়া হয়। এই এনডুরেন্স মাপা হয় কিভাবে সেটা বলছি। একটা বিমানের তেলের ট্যাঙ্ক পুরোপুরি ভর্তি করে দেওয়ার পর কতোটা সময় উড়তে পারে, সেটা মাপা হয়। এর মধ্যে, রানওয়েতে ছোটা, উপরে ওঠা, আকাশে ওড়া আবার নিচে নামা – সবই ধরা হয়। বিমান পরিবহনের ক্ষেত্রে ৭৮৭ মডলের বিমানকে সবচেয়ে বেশি লাভজনক হিসেবে ধরা হয়। কারণ, এই বিমান ২২৮ টন পর্যন্ত ওজন বহন করতে পারে। আর তার জন্য দু’টি ইঞ্জিন প্রতি ঘণ্টায় ৪৪০০ কেজি জ্বালানি হ্রাস করে। সেদিক থেকে ৭৩৭ মডেলের বিমান প্রতি ঘণ্টায় ২২০০ কেজি জ্বালানি খরচ করলেও সর্বাধিক ওজনে পরিবহনের মাত্রা ৭০ টনে সীমিত। যে কোনও বিমানের অয়েল ট্যাঙ্কটি থাকে একেবারে মাঝে। দশটি আলাদা আলাদা প্রকোষ্ঠে ভাগ করা থাকে। প্রত্যেকটা প্রকোষ্ঠই জোড়া থাকে একে অপরের সঙ্গে। দু’টি ইঞ্জিনেই সমান জ্বালানি যাওয়ার জন্য এই বন্দোবস্ত। কোনও একটা প্রকোষ্ঠ খালি হয়ে গেলেই আরেকটা প্রকোষ্ঠ থেকে তেল সঙ্গে সঙ্গে চলে আসে তেলের মাত্রা ঠিক রাখতে। এক একটা প্রকোষ্ঠ এতো বড় হয় যে তাতে আরামসে ছয়-সাতজন মানুষ ধরে যাবে।

এখানে একটি ছোট্টো তথ্য দিয়ে রাখি। এই যে রানওয়েতে বিমান যখন দাঁড়িয়ে থাকে, সেই সময় জ্বালানি ভরা হয় ঠিকই। কিন্তু, দেখে থাকবেন, একটা বড়সড় পাওয়ার ইউনিটও থাকে। একটা মোটা কেবল দিয়ে বিমানের সঙ্গে সেটা সবসময় জোড়া থাকে। বিমানের ইঞ্জিন যখন চালু হয়, তখনই তা খোলা হয়। কারণ, বিমানের ইঞ্জিন চালু না হলে, বিদ্যুৎ উৎপন্ন হবে না। ফলে, গোটা বিমানে পাওয়ার সাপ্লাই করা সম্ভব নয় কোনওভাবেই। এই অবস্থায় বাইরে থেকে পাওয়ার সাপ্লাই করতে হয়। ওই পাওয়ার ইউনিট সেজন্যই থাকে।

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ