জলবসন্ত (চিকেন পক্স) কি?
জলবসন্ত একধরনের অত্যন্ত সংক্রামক ব্যাধি। ভ্যারিসেলা জুস্টার ভাইরাস (varicella zoster) নামক একপ্রকার ভাইরাস দ্বারা এই রোগ সংঘটিত এবং সংক্রামিত হয়ে থাকে। শিশুদের ক্ষেত্রে এই রোগটি বেশি হয়। তবে বয়স্করাও এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। জলবসন্ত একটি ছোঁয়াচে রোগ। কাশি, কফ, ব্যবহৃত জামাকাপড় ইত্যাদি থেকেও এই রোগ ছড়াতে পারে। গরম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অস্বস্তিকর পরিবেশের বা শুষ্ক আবহাওয়ায় ভাইরাসটির আক্রমণ একটু বেশি দেখা দিয়ে থাকে। ছোট-বড়, নারী-পুরুষ—সবাই এ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে শিশুদের মধ্যে আক্রান্তের হার একটু বেশি, বিশেষ করে ১০ বছরের কম বয়সীদের বেলায়।

জলবসন্ত থেকে জ্বরের উপসর্গ দেখা যায় এবং সারা গায়ে চুলকানি-সহ র‌্যাশ ফুটে ওঠে। ভ্যারিসেলা টিকা বার হওয়ার পর থেকে জলবসন্তের প্রাদুর্ভাব আর দেখা যায় না বললেই চলে। একবার জলবসন্তের ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করলে ১০ থেকে ২১ দিনের মধ্যে উপসর্গ দেখা দেয় এবং তা ৫ থেকে ১০ দিন পর্যন্ত থাকে। র‌্যাশ বেরোবার আগে মাথা ব্যথা বা জ্বর জাতীয় উপসর্গ দেখা দেয়। সাধারণভাবে জলবসন্ত খুব একটা কঠিন রোগ নয়, তবে তার থেকে নিউমোনিয়া, এনসেফেলাইটিস, জলবসন্তের সময় যাঁরা অ্যাসপিরিন নিয়ে থাকেন তাঁদের রেয়ি’জ সিনড্রোম, এবং ডিহাইড্রেশন জাতীয় জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। যে সব রোগীর ক্ষেত্রে ঝুঁকি থাকে তাঁদের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

যাঁদের টিকা নেওয়া থাকে তাঁদের ভাইরাস সংক্রমণ হয় না; যদি কারোর টিকা নেওয়ার পরেও জলবসন্তের সংক্রমণ হয় তাহলে তা অত্যন্ত মৃদু হয়। জলবসন্তের টিকা সম্পূর্ণ নিরাপদ, কার্যকর এবং রোগ প্রতিরোধে সর্বোত্তম উপায়। এই টিকা প্রায় সমস্ত রকমের জটিল জলবসন্তের সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারে।

জলবসন্ত (চিকেন পক্স) কীভাবে ছড়ায়?
দ্রুত বাতাসের মাধ্যমেই একে অন্যকে আক্রমণ করে। তা ছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, কাশি, কাপড়চোপড় বা আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে জলবসন্তের ফলে সৃষ্ট ফোসকা ফেটে গিয়ে যে পদার্থ নির্গত হয়, তা অন্যের সংস্পর্শে এলে এই রোগ সংক্রমিত হতে পারে—ভাইরাসটি ছড়াতে থাকে যত দিন না সব কটি গুটি শুকিয়ে যায়।

জলবসন্ত (চিকেন পক্স) এর উপসর্গ:
যদি কেউ জলবসন্তের টিকা না নিয়ে থাকেন বা কারোর জলবসন্তের সংক্রমণ না হয়ে থাকে তবে তাঁর এই সংক্রমণ হতে পারে। জলবসন্ত থেকে যে অসুস্থতা দেখা দেয় তা ৫ থেকে ১০ দিন পর্যন্ত থাকে।
শুরুর দিকে শরীর ম্যাজম্যাজ করা, মাথাব্যথা করা, গা-হাত-পা ব্যথা করা, এমনকি পিঠেও ব্যথা হতে পারে। একটু সর্দি-কাশিও হতে পারে। এরপর জ্বর জ্বর ভাব হবে। এগুলো রোগের পূর্বলক্ষণ। এরপর শরীরে ঘামাচির মতো কিছু র‌্যাশ উঠতে দেখা যায়। তারপর সেটা একটু পর বড় হতে থাকে এবং ভেতরে পানি জমতে থাকে। খুব দ্রুতই শরীর অনেক দুর্বল হয়ে যায়। জলবসন্ত হয়ে গেলে রোগীর অনেক জ্বর আসবে। শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা হবে আর সঙ্গে সর্দি-কাশিও থাকবে।

শরীরে র‌্যাশ বেরোতে দেখা যায় যা জলবসন্তের সংক্রমণের স্বাভাবিক উপসর্গ। এই র‌্যাশ তিনটি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে চলে:

  • প্রথমে গোলাপি অথবা লাল রংয়ের ফুস্কুড়ির মত ওঠে যাকে বলা হয় প্যাপিউলস; এগুলি কয়েকদিন ধরে বার হয়।
  • তারপর সেগুলি জলীয় পদার্থ ভর্তি ছোট ছোট গুটি বা ফোড়ার মত ভেসিক্যালসে পরিবর্তিত হয়, একদিনের মধ্যে সেগুলি সাধারণত ফেটে গিয়ে ভিতর থেকে জলীয় পদার্থ বার হয়ে আসে।
  • শেষে সেগুলির মামড়ি ওই ফেটে যাওয়া ফোড়াগুলির ওপর একটি আস্তরণ তৈরি করে এবং নিরাময় হতে সময় লাগে।


নতুন করে ফুস্কড়ির মত র‌্যাশ উঠতে পারে বেশ কয়েকদিন পর্যন্ত। কাজেই একবার র‌্যাশ, ফুস্কড়ি, ফোড়া, এবং মামড়ির আস্তরণের তিনটি ক্রম পার হয়ে আবার রোগীর দ্বিতীয়দিনের জন্য আবার একই অভিজ্ঞতা হতে পারে। র‌্যাশ বার হওয়ার আগে ভাইরাস ৪৮ ঘণ্টা ধরে ছড়াতে পারে। যতক্ষণ না সমস্ত ক্ষতের ওপর আস্তরণ পড়ে ততক্ষণ পর্যন্ত সংক্রমণটি ছোঁয়াচে।

প্রথমে বুকে, পিঠে, এবং মুখে র‌্যাশ বেরোতে পারে, পরে যৌনাঙ্গ, চোখের পাতা, বা মুখের ভিতরে তা ছড়িয়ে যায়। এক সপ্তাহের মধ্যেই সমস্ত গুটি মামড়িতে পরিণত হয়।

যদি কেউ জলবসন্তের টিকা নিয়ে থাকেন তাঁদেরও জলবসন্তের সংক্রমণ হতে পারে। যাঁরা জলবসন্তের টিকা নিয়েছেন তাঁদের ক্ষেত্রে উপসর্গ অত্যন্ত মৃদু হয়। তাঁদের মৃদু জ্বর হতে পারে, না ও হতে পারে, এবং কম গুটি বা লাল ক্ষত হয়। তবে কোনও কোনও রোগীর টিকা নেওয়া থাকলেও যাঁরা টিকা নেননি তাঁদের মতই জটিলতা দেখা দেয়।

অবশ্যই চিকিৎসককে খবর দিন যদি:

  • যদি জলবসন্ত সংক্রমিত হয়েছে বলে মনে হয় (পুঁজ বেরোয়, মামড়ি বড় হয়)
  • ষষ্ঠদিনের পর নতুন করে জলবসন্ত বার হয়।
  • আপনার সন্তানের শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়।


জলবসন্ত (চিকেন পক্স) রোগীকে কী খাওয়াবেন?
দিনে কমপক্ষে আট গ্লাস পানি পান করাবেন। এ সময়ে রোগীকে অনেক পুষ্টিকর খাবার দেওয়া প্রয়োজন হয়। তবে খাবারের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, সবজি—সবকিছুই খাওয়া যাবে।

জলবসন্ত (চিকেন পক্স) এর জটিলতা:
নানা ধরনের জটিলতা হতে পারে। ত্বকের সংক্রমণ, স্কারলেট জ্বর, নিউমোনিয়া, হাড়ের সংক্রমণ, মস্তিষ্ক ও কিডনির প্রদাহ, পাতলা পায়খানা ইত্যাদি রোগ হতে পারে। গর্ভবতী মায়ের ক্ষেত্রে বিশেষ জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। মায়ের গর্ভের সন্তানের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে অথবা সন্তান বিকলাঙ্গ হয়ে জন্ম গ্রহণ করতে পারে।

জলবসন্ত (চিকেন পক্স) এর চিকিৎসা:
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জ্বর কমানোর জন্য প্যারাসিটামল ট্যাবলেট ব্যবহার করা হয়। অতিরিক্ত চুলকানোর জন্য অ্যান্টি হিসটামিন-জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা হয়। কখনো কখনো চিকিৎসকরা ইমুলিয়েন্ট (সুদিং ক্রিম) ক্রিম ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। বিশেষ ক্ষেত্রে অ্যান্টি ভাইরাল ওষুধ ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

জলবসন্ত (চিকেন পক্স) এর রোগীর পরিচর্যা:
এ অসুখের সময় শিশুর বিশেষ যত্ন নিতে হবে। তাকে নরম হালকা সুতি কাপড় পরাতে হবে। তরল বা নরম জাতীয় খাবার খাওয়াতে হবে। বেশি করে পানি পান করাতে হবে। এর সঙ্গে অবশ্যই মায়ের দুধ খাওয়াতে হবে। বেশিরভাগ সময়ই এ রোগ বাড়িতে সাধারণ চিকিৎসার মাধ্যমে ভালো হয়ে যায়। তাই হাসপাতালে নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তবে কোনো কারণে জলবসন্ত যদি বেশি মাত্রায় ছড়ায় বা ইনফেকশন তৈরি করে তবে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করার প্রয়োজন পড়তে পারে। বাড়িতে নিম্নলিখিত ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ করা প্রয়োজন।

  • যেহেতু ফোসকার স্থানে চুলকানির অনুভূতি হয়, তাই এ অবস্থায় আক্রান্ত স্থানে ক্যালামিন লোসন লাগানো যায়।
  • প্রতিদিন গোসল করতে হবে। এতে চুলকানি কমবে বা ফোসকার স্থানে ময়লা জমা প্রতিহত হবে।
  • মাথা বা শরীরে ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ গ্রহণ করতে হবে।
  • মুখের ভেতর ফোসকা হলে নরম বা তরল জাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হবে।
  • প্রচুর পানি বা পানিজাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হবে।
  • অতিরিক্ত ঝাল ও মসলাযুক্ত খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে।
  • আক্রান্ত ব্যক্তিকে পরিবারের অন্যান্য সদস্য থেকে নির্দিষ্ট সময় অর্থাৎ ফোসকা বিলুপ্ত না হওয়া পর্যন্ত নিরাপদ দূরত্বে রাখতে হবে। প্রয়োজনে তার জন্য আলাদা ঘর, আলাদা কাপড়-চোপড়ের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
  • শেষ ফোসকা বিলুপ্ত না হওয়া পর্যন্ত আক্রান্ত ব্যক্তির বাইরে যাওয়া বা আক্রান্ত বাচ্চার স্কুলে যাওয়া বা আক্রান্ত ব্যক্তির অফিসে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
  • যে কোনো মূল্যে ফোসকা ফাটানো থেকে বিরত থাকতে হবে এবং আক্রান্ত স্থানে চুলকানো যাবে না।
  • প্রতিদিন আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত কাপড় ও বিছানার চাদর অ্যান্টিসেপটিকযুক্ত গরম পানিতে ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে।


জলবসন্ত (চিকেন পক্স) প্রতিরোধে করণীয়:
জলবসন্ত অতিরিক্ত সংক্রমক। তাই এটি প্রতিরোধের অন্যতম উপায় হচ্ছে আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে না যাওয়া এবং রোগাক্রান্ত ব্যক্তির পাশে বেশিক্ষণ অবস্থান না করা। বিশেষ করে ছোট শিশু বা বয়স্করা কোনোভাবেই আক্রান্ত ব্যক্তির কাছে যাবেন না। আক্রান্ত ব্যক্তিকে বাসায় বিশ্রামে থাকতে হবে। বিশেষ করে শিশুদের এটি হলে কিছুদিনের জন্য স্কুলে যাওয়া বা বাইরে খেলাধুলা করা বন্ধ করতে হবে।


শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে