অবসাদ (ডিপ্রেশন) কি?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অর্থাৎ হু অবসাদের একটি সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছে। হু’র মতে, “সারা ক্ষণ মনের মধ্যে একটা দুঃখের ভাব, সাধারণত যে সমস্ত কাজ করতে আপনি ভালবাসতেন তাতেও উৎসাহ হারিয়ে ফেলা, রোজের রুটিন মেনে চলার অক্ষমতা— এগুলি যদি দু’সপ্তাহ বা তার বেশি স্থায়ী হয়”, তবে আপনি অবসাদগ্রস্ত।
বিশ্ব জুড়ে সবচেয়ে পরিচিত স্বাস্থ্য সমস্যা হল অবসাদ। আগেকার দিনে অবসাদ মেলাঙ্কলিয়া নামে পরিচিত ছিল। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা হিসাবে এর তেমন পরিচিত ছিল না। গত কয়েক দশক ধরে অবসাদের ঘটনা বেড়েছে এবং সেই জন্য এই রোগ সম্পর্কে সচেতনতাও বাড়ছে। সাম্প্রতিক কালে, অবসাদ শুধুমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদেরই নয় বাচ্চাদেরও প্রভাবিত করেছে। অবসাদের ক্রমবর্ধমান প্রসার এটি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে যে এই অবস্থাটি তাড়াতাড়ি নির্ণয় করে তার চিকিৎসা শুরু করা উচিত।
চিকিৎসার পরিভাষাতে অবসাদ হল মেজাজের ব্যাধি। অবসাদের লক্ষণগুলি হল নেতিবাচক চিন্তা, সমাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া এবং ক্রমাগত বিষণ্ণতায় ডুবে থাকা। অবসাদ বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে, যেমন, প্রসবের পরের অবসাদ (পোস্টপারটাম ডিপ্রেশান), লাগাতার হালকা অবসাদ (ডিসথাইমিয়া), মৌসুম বদলের সাথে অবসাদ এবং দ্বিধা-বোধ ব্যাধি (বাইপোলার ডিসরডার)। চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে অবসাদের চারটি পর্যায় আছে। ব্যাধি যত বাড়তে থাকে, এটি রোগীর কার্যকর ভাবে নিজের কাজ করাতে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে পারে।
অবসাদ নিয়ে বেশ কয়েকটি উদ্বেগজনক পরিসংখ্যানও দিচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তার কয়েকটি হল—
- বিশ্ব জুড়ে ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সিরা যে অসুখে সবচেয়ে বেশি ভোগে, সেই তালিকায় চতুর্থ স্থানে রয়েছে অবসাদ।
- ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সিরা সারা বিশ্ব জুড়ে যে অসুখে সবচেয়ে বেশি ভোগে, সেই তালিকায় ১৫ নম্বরে রয়েছে অবসাদ।
- বিশ্বে অর্ধেকেরও বেশি মানসিক অসুখের সূত্রপাত ১৪ বছর বয়সে। অথচ, বেশিরভাগই নির্ণয় করা যায় না বা নির্ণয় করা গেলেও তার চিকিৎসা শুরু হয় না।
- সারা বিশ্বে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সিদের মৃত্যুর তৃতীয় বড় কারণ হল আত্মহত্যা।
অবসাদ (ডিপ্রেশন) এর উপসর্গ:
অবসাদের অনেকগুলি লক্ষণ আছে যা দেখে এক জন আরেক জনের বা নিজের রোগ নির্ণয় করতে পারেন। অবশ্য, এই লক্ষণগুলির কয়েকটি থাকলেই যে নিশ্চিত হওয়া যাবে যে অবসাদ আছে, তা কিন্তু নয়। এই লক্ষণগুলি বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে বিভিন্ন তীব্রতায় থাকতে পারে।
আচরণগত লক্ষণ:
- নিজের শখের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলা।
- দৈনন্দিন কাজ কর্মে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা।
- সমাজের বিভিন্ন মানুষদের সাথে, এমন কি নিজের পরিবারের সদস্যদের সাথেও সামাজিক যোগাযোগ হ্রাস পাওয়া।
- মনঃসংযোগ করতে অসুবিধা।
- অবিরাম অস্থিরতা বা কোনও একটি কাজ শেষ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলা।
- একলা থাকতে চাওয়া।
- ভুলে যাওয়া।
- ঘুমিয়ে পড়তে অসুবিধা।
- অত্যধিক ঘুম।
শারীরিক উপসর্গ:
- কাজ করার শক্তি কমে যাওয়া।
- অবিরাম ক্লান্তি।
- কথা বলা কমে যাওয়া বা ধীরে ধীরে কথা বলা।
- ক্ষুধামান্দ্য।
- অত্যধিক ঘুম।
- হঠাৎ ওজন হ্রাস (এটি সঠিক ভাবে না খাওয়ার নির্দেশক হতে পারে)।
- মাথাব্যথা।
- কোন কারণ ছাড়াই হজমের গোলমাল।
- পেশীর সংকোচন বা শরীরের ব্যথা।
মানসিক লক্ষণ:
- স্থায়ী দুঃখবোধ।
- অত্যধিক অপরাধ অনুভব।
- উদ্বেগ।
- আশাহীন বা মূল্যহীন অনুভব করা।
- আত্মহত্যা বা নিজের ক্ষতির চিন্তা ভাবনা।
- বিরক্ত বা উত্তেজিত বোধ।
- আনন্দদায়ক ক্রিয়াকলাপে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা।
কখন ডাক্তার দেখাবেন?
যে কোনও বয়সের যে কোনও মানুষ অবসাদগ্রস্ত হতে পারেন। বয়ঃসন্ধিকালীন অবস্থায় অবসাদে ভোগার সম্ভাবনাও যথেষ্ট। বিশেষ করে, কোনও শারীরিক বা আবেগজনিত জোরালো আঘাত (ট্রমা) বা হেনস্থার ফলে এমন হতে পারে। কখন বা কী অবস্থায় এক জন মনস্তত্ত্ববিদের কাছে যেতেই হবে, পরামর্শ নিয়ে সঠিক রোগ চিহ্নিত করতে হবে, তারও কিছু লক্ষণ রয়েছে। যেমন—
- ঘুমের ধরনে পরিবর্তন: বেশি ঘুমানো, খুব কম ঘুমানো, ঘুমের মধ্যেও অস্থিরতা
- খাদ্যাভ্যাসে আমূল পরিবর্তন: খুব বেশি খাওয়া, কম খাওয়া, বার বার খাওয়া
- সামাজিক ব্যবহারে আমূল পরিবর্তন: রাগের সঙ্গে মারাত্মক আবেগপ্রবণতা, এক টানা কান্না, আগ বাড়িয়ে ঝগড়া করা
- ক্লান্তি অনুভব করা, আশাহীনতা, অসহায়তায় ভোগা, দুশ্চিন্তায় ভোগা
- পছন্দের কাজ, হবি, খাবার, খেলা, ক্লাস, বন্ধুদের সম্পর্কে উৎসাহ হারিয়ে ফেলা
- পড়াশোনা খারাপ হতে থাকা: মনোযোগ কমা, আগের তুলনায় পড়াশোনার কাজে গতি কমে আসা, স্কুলে যেতে অনীহা
- বন্ধুবান্ধব এবং পরিবার থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখা
- নিজের ক্ষতি করার চেষ্টা বা নেশায় আসক্তি
- ধূমপান বা মদ্যপানের অভ্যাস শুরু করা
- আত্মহত্যার চিন্তা বা আত্মহত্যার চেষ্টা।
আপনার যদি মনে হয়, এ মধ্যে যে কোনও একটা আচরণ আপনার সন্তানের মধ্যে দেখা যাচ্ছে, দ্রুত মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। মাথায় রাখতে হবে— এর মধ্যে মাত্র এক-দুটো উপসর্গ নিয়মিত ভাবে থাকলে, বা সবকটা উপসর্গই অনিয়মিত ভাবে থাকলে তা অবসাদের লক্ষণ নাও হতে পারে। তবে রোগ আছে কি নেই তা নির্ণয়ের জন্য একজন মনস্তত্ত্ববিদ বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অবশ্যই নিতে হবে।
অবসাদ (ডিপ্রেশন) এর চিকিৎসা:
অবসাদের তীব্রতার উপর নির্ভর করে বিভিন্ন প্রকারের চিকিৎসা পদ্ধতি আছে।
১। অল্প অবসাদ
অবসাদের তীব্রতার উপর নির্ভর করে বিভিন্ন প্রকারের চিকিৎসা পদ্ধতি আছে:
- ব্যায়াম: নিয়মিত ব্যায়াম অবসাদের উপসর্গগুলি কাটিয়ে উঠতে খুব সহায়ক হতে পারে। দৈনিক ব্যায়াম শুধুমাত্র মেজাজই ভাল করে না, ব্যায়াম একজনকে সক্রিয় থাকতেও সাহায্য করে। যাদের অল্প থেকে মাঝারি মাত্রার অবসাদ আছে, ব্যায়াম তাদের পক্ষে খুবই সাহায্যকারী। একজন থেরাপিস্ট দৈনিক ৩০ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা এবং সপ্তাহে অন্তত তিন দিন ব্যায়াম করার পরামর্শ দিতে পারেন। বয়স্ক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে সন্ধ্যাবেলা ৩০ মিনিট হাঁটা খুবই সাহায্যকারী।
- সহায়ক দল: অল্প অবসাদের ক্ষেত্রে, বিশেষত যে অবসাদ জীবনের কোন দুঃখজনক ঘটনার সাথে জড়িত, তাকে একটি সহায়ক দলের সাথে নিজেকে যুক্ত করার পরামর্শ দেওয়া হয়। এই গোষ্ঠীর সদস্য হয়ে রোগী বুঝতে পারেন যে তিনি একা নন, তার মত অনেক মানুষ আছেন। তখন তিনি নিজের মনের কথা খুলে বলতে পারেন।
২। অল্প থেকে মাঝারি মাত্রার অবসাদ
মাঝারি মাত্রার অবসাদের জন্য বিভিন্ন প্রকারের চিকিৎসার পরামর্শ দেওয়া হয়। কগনিটিভ থেরাপি রোগীকে তার চিন্তাধারার উপর মনোযোগ দিয়ে তা পরিবর্তন করার জন্য উৎসাহিত করে। এতে রোগীকে আরও ইতিবাচক এবং আশাবাদী হতে সাহায্য করে। মাঝারি মাত্রার অবসাদের চিকিৎসার আরেকটি উপায় হল কাউনসেলিং করা। প্রতিটি কাউনসেলিং সেশন একজন রোগীর আবেগের বহিঃপ্রকাশের একটি মাধ্যম হিসাবে কাজ করতে পারে। এতে রোগীর অবসাদ হ্রাস করতে খুবই সাহায্য করে।
৩। মাঝারি থেকে তীব্র মাত্রার অবসাদ
মাঝারি থেকে তীব্র মাত্রার অবসাদের জন্য বিভিন্ন রকমের চিকিৎসা পদ্ধতি আছে। এগুলি হচ্ছে:
- এন্টিডিপ্রেশান্ট: মাঝারি থেকে তীব্র মাত্রার অবসাদের জন্য ওষুধ পাওয়া যায়। এই ওষুধগুলি শুধু রোগীর উদ্বেগের অনুভূতিই হ্রাস করে না, রোগীকে খুশি রাখতেও সাহায্য করে। বিভিন্ন প্রকারের অবসাদের জন্য বিভিন্ন প্রকারের এন্টিডিপ্রেশান্ট পাওয়া যায়। যাদের অবসাদ আছে তারা জানাচ্ছেন যে এই ওষুধগুলি খুবই কার্যকর এবং খুব তাড়াতাড়ি ফল দেয়। এই ওষুধগুলির অবশ্য কিছু পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া আছে। যেমন, কোষ্ঠকাঠিন্য, মাথা ঘোরা, বমির ভাব, পেট খারাপ, এবং ত্বকের চুলকানি। এই এন্টিডিপ্রেশান্টগুলির প্রধান পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হল প্রত্যাহার লক্ষণ। একজন ব্যক্তি যখন এই ওষুধ গ্রহণ বন্ধ করেন তখন এই লক্ষণগুলি দেখা দিতে পারে। তাই ওষুধ গ্রহণ এবং বাদ দেওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
- সম্মিলিত চিকিৎসা: অল্প থেকে মাঝারি মাত্রার অবসাদের রোগীদের সব চেয়ে সাহায্যকারী চিকিৎসা পদ্ধতি হল সম্মিলিত চিকিৎসা পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে এন্টিডিপ্রেশান্ট ওষুধের সাথে কগনিটিভ আচরণগত থেরাপি (সি-বি-টি) করা হয়।
- মানসিক চিকিৎসা: অবসাদ যদি গভীর হয়, তাহলে রোগীকে একটি মানসিক চিকিৎসা দলের কাছে যেতে বলা হয়। এই দলে থাকেন মনো-বৈজ্ঞানিক, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং পেশাগত থেরাপিস্ট। এই দলগুলি নিবিড় যত্ন প্রদান করতে সহায়তা করে যাতে থাকে ওষুধ-পত্র, বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা এবং তাদের কার্যকারিতা। যে রোগীদের গভীর অবসাদ সাথে মনো-ব্যাধির (সাইকোসিস) লক্ষণ থাকে, তাদের জন্য ই-সি-টি (ইলেকট্রোকনভালসিভ থেরাপি) এবং ব্রেইন স্টিম্যুলেশান টেকনিকগুলির প্রস্তাব করা হয়।
অবসাদের জন্য পেশাদারী সাহায্য নেওয়ার সময় কয়েকটি জরুরী বিষয় মনে রাখবেন:
- থেরাপিস্ট বা কাউন্সিলরকে যে তথ্য প্রদান করবেন তা গোপনীয় থাকবে। রোগী তার কাউন্সিলরকে নিরাপদে তার ব্যক্তিগত তথ্য দিতে পারেন কারণ এটি কখনই তৃতীয় কোন পক্ষের সাথে শেয়ার করা হবে না।
- পেশাদার সাহায্য গ্রহণের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে সম্মতি প্রদান। রোগীর বিনা অনুমতিতে তাকে কোন ওষুধই দেওয়া যাবে না, তবে যে সমস্ত রোগীর মনোরোগের অবসাদ আছে শুধু তাদের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হতে পারে।
- পেশাদার সাহায্য গ্রহণের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে কাউন্সিলরের কাছে প্রয়োজনীয় কোনো তথ্য গোপন করা যাবেনা। তার প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে হবে।
- সাহায্য প্রার্থী ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরাও তার চিকিৎসা সফল করতে সহায়ক হতে পারেন।
জীবনধারা পরিবর্তন:
যখন একজন ব্যক্তি অবসাদের সাথে লড়াই করছেন এবং চিকিৎসার মধ্যে আছেন, তখন কতগুলি বিষয় তার নিরাময়ে সাহায্য করতে পারে। শারীরিক রোগের ক্ষেত্রে দীর্ঘ দিন ধরে ওষুধ-পত্র নেওয়া যেতে পারে, কিন্তু অবসাদের মত রোগে দীর্ঘ সময় ওষুধের উপর নির্ভর করে থাকা উচিত নয়।
যে কোন ধরণের চিকিৎসার লক্ষ্য থাকে যাতে রোগী নিজের সমস্যা-জর্জরিত চিন্তা এবং ব্যবহার নিজেই ঠিক করতে পারেন। ইতিবাচক ভাবে অবসাদের মোকাবেলায় কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে:
- নিজেকে অন্যদের থেকে আলাদা করে ফেলবেন না।
- চিকিৎসার অগ্রগতি সম্পর্কে বন্ধুদের এবং পরিবারের ঘনিষ্ঠ সদস্যদের সাথে কথা বলুন।
- থেরাপিস্ট এর সঙ্গে সৎ থাকুন।
- নিজেকে নিরাময় করার সময় দিন।
- শারীরিক কার্যক্রম যেমন শখ এবং ব্যায়ামে নিজেকে ব্যস্ত থাকুন।
- নিজের অবসাদকে কলঙ্ক হিসাবে দেখবেন না।
- প্রক্রিয়াজাত খাবার খাবেন না। ঐ খাবারগুলির চিনির পরিমাণ আপনার ওষুধের সাথে গণ্ডগোল করতে পারে এবং এছাড়াও আপনার মেজাজকে নেতিবাচক ভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
- আপনার চিন্তাভাবনাকে আত্মদর্শী করার চেষ্টা করুন।
- লেখাতে আপনার চিন্তা প্রকাশ করুন।
- মদ বা নেশার সামগ্রী আপনার উপসর্গগুলিকে বাড়িয়ে তুলবে। কারণ এগুলি আপনার চিকিৎসার উপরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং অবশেষে আপনার অবস্থাকে আরও খারাপ করবে।