কোলেস্টেরল কি?
শরীরে যকৃত থেকে চর্বি উৎপন্ন হয় যাকে কোলেস্টরল বা লিপিড বলা হয়। রক্তের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল কোলেস্টেরল। রক্তে উপস্থিত ৭৫ শতাংশ কোলেস্টেরল স্বাভাবিকভাবে আমাদের দেহে এমনিই উত্পাদন হয়। কিন্তু বাকি ২৫ শতাংশ কোলেস্টেরল আসে বিভিন্ন প্রাণীজ খাবার থেকে। শরীরে কোলেস্টরলের দৈনিক প্রয়োজনীয়তা খাদ্যতালিকায় থাকা ডিমের কুসুম, দুগ্ধজাত পদার্থ, এবং মাংস থেকে মিটে যায়। শরীরের বিভিন্ন জৈবিক কার্যপ্রণালির জন্য উপযুক্ত পরিমাণে কোলেস্টরল জরুরি। ইস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টেরন, টেস্টোস্টেরন, কর্টিসল, এবং অল্ডোস্টেরন জাতীয় হরমোন উৎপাদনের জন্য এটি আবশ্যক। এছাড়া এটি শরীরে ভাইটামিন A, D, E এবং K গ্রহণে সহায়ক হয়। তাছাড়া, এটি কোষের ঝিল্লির (সেল মেমব্রেন) গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ এবং কোষের গঠন ঠিক রাখতে সাহায্য করে। সূর্যালোকের উপস্থিতিতে কোলেস্টরলের সাহায্যে শরীরে ভাইটামিন D উৎপন্ন হয়। রক্তের মধ্যে প্রোটিনের (লাইপোপ্রোটিন) সঙ্গে কোলেস্টরল চলাচল করে। ভাল কোলেস্টরল (বেশি ঘনত্বের লাইপোপ্রোটিন- HDL) হার্টের সুরক্ষায় কাজ করে, যেখানে অতিরিক্ত খারাপ কোলেস্টরল (কম ঘনত্বের লাইপোপ্রোটিন- LDL) এবং খুব কম ঘনত্বের লাইপোপ্রোটিন- VLDL) হৃদরোগের আশঙ্কা বাড়ায়।

কোলেস্টেরলের প্রকারভেদ:
রক্তে উপস্থিত এই কোলেস্টেরল দুধরনের।

  • LDL (লো ডেনসিটি লিপিড প্রোফাইল) একে বলা হয় 'ব্যাড কোলেস্টেরল'।
  • HDL (হাই ডেনসিটি লিপিড প্রোফাইল)। একে বলা হয় কে বলা হয় 'গুড কোলেস্টেরল'

এই গুড ও ব্যাড কোলেস্টেরলের মধ্যে ভারসাম্যের অভাব ঘটলেই শরীরে বিভিন্ন রকম উপসর্গ দেখা দেয়। এক্ষেত্রে এইচডিএল বাড়তে শুরু করলে শরীরের পক্ষে ভালো। অপরদিকে এলডিএল বাড়লে শরীর খারাপ হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে।

হাই কোলেস্টেরল কি?
হাই কোলেস্টেরল বর্তমান সময়ে একটি খুব সাধারণ সমস্যা এবং এই সমস্যাটি অনেকের মধ্যে দেখা যায়। কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে গেলে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে।

একজন সুস্থ ব্যক্তির জন্য কোলেস্টেরল উপাদান:
মোট কোলেস্টেরল: ২০০ থেকে ২৩৯ mg/dL এর কম
HDL: ৬০ mg/dL এর বেশি
LDL: ১০০ mg/dL এর কম
এর চেয়ে পরিমাণে বেশি হলেই তাকে হাই কোলেস্টেরল হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

হাই কোলেস্টেরলের উপসর্গ:
রক্তে বেশি কোলেস্টেরল এলেই শারীরিক নানা সমস্যা শুরু হতে পারে। এর প্রভাব শরীরের বহিরঙ্গেও দেখা দেয়। তাই একটু সচেতন হলেই বুঝে যাওয়া যায় কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ছে কি না।

  • চোখের নীচে বা চোখের পাতায় সাদাটে বা হলদেটে ব্যথাহীন ফোলা অংশ দেখা দিলে দ্রুত রক্ত পরীক্ষা করান। এতে চোখের কোনও সমস্যা দেখা না দিলেও এটি রক্তে কোলেস্টেরল থাকার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপসর্গ।
  • কিছু দিন ধরে মাঝে মাঝে বুকে ব্যথা হচ্ছে, অথচ ইসিজি রিপোর্টে তেমন কিছু সমস্যা খুঁজে পাননি? এমন হলে এক বার রক্ত পরীক্ষা করিয়ে দেখে নিন রক্তে কোলেস্টেরল প্রবেশ করেছে কি না। আসলে উচ্চ কোলেস্টেরল থাকলে রক্তনালীতে অক্সিজেন সরবরাহ কমে। পর্যাপ্ত অক্সিজেনের অভাবে হৃদযন্ত্রে চাপ পড়ে বুকে ব্যথা হতে পারে। কোলেস্টেরল জমলে মস্তিষ্কেও রক্ত সঞ্চালন কমে। এই কারণে ঘাড়ে ও মস্তিষ্কের পিছনের দিকে মাঝে মাঝে একটানা ব্যথা হয়।
  • শারীরিক পরিশ্রম করলে বা কোনও উদ্বেগের কারণে হৃদস্পন্দনের হার বেড়ে যেতেই পারে। কিন্তু কোনও কারণ ছাড়া মাঝে মাঝেই কি হৃদগতি বেড়ে যায়। এমনটা হলে আর সময় নষ্ট না করে রক্ত পরীক্ষা করান। কোলেস্টেরল হৃদগতিকে বাড়িয়ে দ‌েয়।
  • খুব ভাল করে লক্ষ্য করে দেখুন তো, চোখের মণির চারপাশে ধূসর রঙের কোনও গোল দাগ দেখা যাচ্ছে? তা হলে জানবেন, তা চোখের সমস্যা নয়, বরং কোলেস্টেরলের কারণেই এমনটা হচ্ছে। তাই দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।


হাই কোলেস্টেরলে শরীরে কী ক্ষতি হতে পারে?
রক্তে উচ্চ মাত্রার কোলেস্টেরল যখন থাকে, এই কোলেস্টেলগুলো রক্তনালিতে জমাট বাঁধে। রক্তনালির একটি নির্দিষ্ট Diameter রয়েছে। যখন এটি জমা হয় রক্তনালির Diameter আস্তে আস্তে সংকুচিত হয়ে যায়। রক্তনালির ভেতর তো রক্ত যায়। Cholesterol জমাট বাঁধলে স্বাভাবিকভাবে যে পরিমাণ রক্ত যাওয়ার কথা, সে পরিমাণ রক্তো যেতে পারবে না। এই রক্তের একটি কাজ রয়েছে। এই রক্ত আমাদের টিস্যুতে অক্সিজেন ও খাবার পরিবহন করে। এটি সব জায়গার টিস্যুতে। হার্টের রক্তনালিতে কোলেস্টেরল জমা হলে Heart ব্লক হয়ে যাবে। আরো সহজ করে বললে চর পড়বে।

আসলে রক্তে বাজে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বাড়লে রক্তনালিতে ব্লক হওয়ার ঝুঁকি অনেকখানি বেড়ে যায়। Stroke এর মতো ঘটনা ঘটতে পার.Cholesterol এর মাত্রা বেশি থাকা একটি উল্লেখযোগ্য স্বাস্থ্য সমস্যা কারণ তা বহু রোগের ঝুঁকি বাড়ায়, বিশেষত হৃদরোগ এবং রক্ত সংবহণ সম্পর্কিত অসুস্থতা। রক্তে কোলেস্টরল মাত্রা বেশি থাকলে হৃদরোগে আক্রান্ত বা বুকে ব্যাথার সঙ্গে মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন সম্পর্কিত অসুস্থতা যেমন Stroke বা সন্ন্যাস রোগ বাড়ে।

কোলেস্টেরল এর চিকিৎসা:
নিম্নলিখিত অবস্থায় হাই কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে ওষুধ প্রয়োগ জরুরি:

  • যখন জীবনশৈলী এবং খাদ্যতালিকায় পরিবর্তন করেও হাই কোলেস্টরলের মাত্রা কমানো যায় না।
  • হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ইতিহাস থাকে।
  • খারাপ কোলেস্টরলের (LDL) মাত্রা বেশি থাকে।
  • ৪০ থেকে ৭৫ বছরের ব্যক্তি যাঁদের হৃদরোগের ঝুঁকি বেশি থাকে।
  • যাদের ডায়াবেটিস অথবা হার্টের রোগ থাকে।


রক্তে হাই কোলেস্টরলের মাত্রা কমাতে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। আপনার বয়স, স্বাস্থ্যের বর্তমান পরিস্থিতি, হৃদরোগ বা স্ট্রোকের সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে আপনার চিকিৎসক আপনার জন্য নির্দিষ্ট ওষুধের পরামর্শ দেবেন। ওষুধের মধ্যে থাকে:

  • হাই কোলেস্টরলের মাত্রা কমাতে সাধারণত স্ট্যাটিন ব্যবহার করা হয়। যকৃতে কোলেস্টরলের উৎপাদন বন্ধ করে দেয় স্ট্যাটিন।
  • যকৃতের ওপর PCSK9 (Proprotein convertase subtilisin/kexin type 9) ইনহিবিটরের মত ওষুধ ভাল কাজ করে এবং রক্ত LDL মুক্ত করতে যকৃতকে সাহায্য করে। রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইড কমাতেও এই ওষুধ সাহায্য করে।
  • বাইল অ্যাসিড সিকোয়েসট্র‌্যান্ট (খাদ্যে গুণমান বাড়ায়) বাইল অ্যাসিডের ওপর প্রতিক্রিয়া করে রক্তে কোলেস্টরলের মাত্রা কমায়।
  • নিয়াসিন (ভাইটামিনB3 বা নিকোটিনিক অ্যাসিড) LDL (খারাপ কোলেস্টরল) কমায় এবং HDL (ভাল কোলেস্টরল) বাড়ায়।
  • ফাইব্রেটস রক্ত খুব কম-ঘনত্বের লাইপোপ্রোটিন (VLDL) থেকে মুক্ত করে। তারা HDL মাত্রাও বাড়ায়। যাই হোক, যখন স্ট্যাটিনের সঙ্গে একযোগে ব্যবহার হয় তখন ফাইব্রেটস পেশির সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
  • খাদ্য থেকে কোলেস্টরল শোষণে বাধা সৃষ্টি করতে পারে এজাটিমিব।
  • যকৃত থেকে VLDL কোলেস্টরল ক্ষরিত হয়ে রক্তে মিশতে বাধার সৃষ্টি করে লোমিটাপাইড এবং মাইপোমার্সেন। জিনের কারণে যাঁদের শরীরে কোলেস্টরলের মাত্রা বেশি তাঁদের জন্য এটি ব্যবহৃত হয়।
  • শরীরের বাইরে একটি পরিষ্করণ যন্ত্র বসিয়ে রক্তকে খারাপ কোলেস্টরল মুক্ত করার পদ্ধতি হল লাইপোপ্রোটিন অ্যাফেরেসিস। সাধারণত যাঁদের শরীরে বংশানুক্রমিকভাবে কোনও সমস্যার জন্য হাই কোলেস্টরল মাত্রা থাকে তাঁদের জন্য এই চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়।
কোলেস্টেরলের মাত্রা ঠিক রাখতে করণীয়:
দেহে কোলেস্টেরলের মাত্রা ঠিক রাখতে আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত কিছু খাদ্যাভ্যাস মেনে চলা। লাইফস্টাইলেও কিছু পরিবর্তন আনা।
কী খাবেন
  • ওটস, বার্লির মত পুষ্টি উপাদানে ভরপুর দানাশস্য
  • স্যালমন, টুনা ও সার্ডিনের মত ফ্যাটি মাছ
  • ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডে সমৃদ্ধ ভেজিটেবল অয়েল যেমন অ্যাভোকাডো, ফ্লাক্স সিড, অলিভ অয়েল ও ক্যানোলা অয়েল
  • বিনস
  • চিনাবাদাম ও কাঠবাদাম
  • অ্যান্টি অক্সিড্যান্ট সমৃদ্ধ ফল ও শাকসবজি।

কী খাবেন না
  • রেড মিড
  • দুগ্ধজাত দ্রব্য
  • প্রসেসড মিট
  • স্যাচুরেটেড তেল যেমন নারকেল ও তাল তেল
  • ভাজা খাবার
  • ধূমপান ও মদ্যপান।
এছাড়া শরীরে কোলেস্টরেলের মাত্রা ঠিক রাখতে সবসময় নিজেকে শারীরিকভাবে সচল রাখা উচিত। প্রতি রাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমানো উচিত।

শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে