ভ্যাজাইনাল ইস্ট ইনফেকশন (যোনিতে সংক্রমণ)কি?
নারীদের জরায়ুতে খুব পরিচিত সমস্যা হলো ভ্যাজাইনাল ইস্ট ইনফেকশন। অধিকাংশ মহিলার জীবনের কোনও না কোনও সময় তা হয়ে থাকে। ভ্যাজাইনাল ইস্ট ইনফেকশন হলে যৌনাঙ্গে এবং যোনিদ্বারে জ্বালা করে, অস্বস্তি হয়, যৌনাঙ্গে চুলকানি এবং ঘন সাদাস্রাব নিঃসরণ হয়। এই লক্ষণগুলি অবশ্য অন্যান্য সেক্সুয়ালি ট্রান্সমিটেড ইনফেকশনের (এসটিআই) ক্ষেত্রেও হতে পারে। নারীদের যৌনাঙ্গে ইস্ট সংক্রমণ হচ্ছে এক ধরনের ফাঙ্গাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়া। এটি ভ্যাজাইনাল ক্যান্ডিডিয়াসিস নামেও পরিচিত। এটি কোনও যৌনসংসর্গ জনিত কারণে সংক্রমণ নয়, কিন্তু একজন মহিলা মুখ থেকে যৌনাঙ্গের সংস্পর্শে ফাঙ্গাসের সংক্রমণ ঘটাতে পারেন। এমন ‘ইস্ট ইনফেকশন’ হলে তা নিয়ে তেমন ভয় পাওয়ার দরকার নেই, চিকিৎসার মাধ্যমে সহজেই এর নিরাময় সম্ভব।

ভ্যাজাইনাল ইস্ট ইনফেকশনের উপসর্গ:
যদিও ভ্যাজাইনাল ইস্ট ইনফেকশনের মাত্রা অল্প হয়ে থাকে, কিছু মহিলার সংক্রমণ জটিল হয়ে দাঁড়ালে আক্রান্ত এলাকা ফুলে যেতে পারে, যৌনাঙ্গের ভিতরের ত্বক ফেটে যেতে পারে, এবং লাল বর্ণ ধারণ করতে পারে। যৌনাঙ্গের অন্যান্য সংক্রমণের মত ভ্যাজাইনাল ইস্ট সংক্রমণের উপসর্গগুলিও একই ধরনের। চিকিৎসক পরীক্ষা করে নির্ণয় করবেন, যে আপনার ক্যান্ডডায়াসিস হয়েছে নাকি অন্য কোনও সংক্রমণ হয়েছে। ভ্যাজাইনাল ইস্ট সংক্রমণের উপসর্গ নিম্নরূপ::

  • প্রস্রাবের সময় জ্বালা এবং ব্যাথা অনুভব।
  • চুলকানি এবং যোনিদ্বারের (ভালভা) টিস্যুতে এবং যোনিতে অস্বস্তি।
  • শারীরিক মিলনের সময় যন্ত্রণা।
  • যৌনাঙ্গে ক্ষত বা যন্ত্রণা।
  • যোনিদ্বার (ভালভা) ফুলে যাওয়া এবং লাল বর্ণ ধারণ করা।
  • যৌনাঙ্গে র‌্যাশ।
  • ছানার মত সাদা, ঘন, দুর্গন্ধমুক্ত স্রাব।
  • যৌনাঙ্গ থেকে পানির মত স্রাব।


যদি নিম্নলিখিত উপসর্গগুলি দেখতে পান তাহলে বুঝতে হবে আপনার জটিল ভ্যাজাইনাল ইস্ট ইনফেকশন হয়েছে:

  • বছরে চার কিংবা তার বেশি বার ইস্ট সংক্রমণ হয়ে থাকলে।
  • আপনি যদি গর্ভবতী হন।
  • আপনার অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থাকলে।
  • ফুলে যাওয়া বা চুলকানির মত গুরুত্বপূর্ণ উপসর্গ থাকলে, যা থেকে ত্বক ফেটে যায়, ছিড়ে যায় বা ক্ষত হয়, বা টকটকে লাল বর্ণ হয়ে যায়।
  • কোনও ওষুধ বা পরিস্থিতির জন্য আপনার রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা কমে গেলে, যেমন HIV.
  • ক্যান্ডিডা অলবিকানস থেকে না হয়ে ক্যান্ডিডার অন্য প্রজাতির কারণে সংক্রমণ হলে।


কাদের ঝুঁকি বেশি?
ইস্ট ইনফেকশন যে কোনও বয়সি মহিলারই হতে পারে। তবে পিউবার্টির আগে কিংবা মেনোপজ়ের পরে সাধারণত এই রোগের উপসর্গ দেখা যায় না। সন্তানসম্ভাবনার সময়ে, হরমোনাল বার্থ কন্ট্রোল পিল সেবন করলে, স্টেরয়েড বা অ্যান্টিবায়োটিক নিয়মিত খেলে, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হলে, রক্তে শর্করার মাত্রা বেশি থাকলে সেই সকল মহিলার এই সংক্রমণের কবলে পড়ার সম্ভাবনা বেশি। এই কারণগুলির মধ্যে রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ঠিক মাত্রায় হরমোনের ওষুধ বা স্টেরয়েড খাওয়া— এগুলি নিজেদের আয়ত্তেই থাকে। এ ছাড়া সুতির অন্তর্বাস ব্যবহার করলে এই ধরনের ইনফেকশনে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমে।

ভ্যাজাইনাল ইস্ট ইনফেকশনের কারণ:
প্রথমত ব্যাক্টেরিয়া সংক্রমণ থেকেই ভ্যাজাইনাল ইনফেকশন হয়ে থাকে। তবে আরও অনেক কারণে এই সমস্যা হতে পারে–

  • মধুমেহ বা ডায়াবেটিস – রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে গেলে অনেকসময়ে যোনিদেশে মিউকাসের পরিমাণও বেড়ে যায় ফলে ফাঙ্গাল ইনফেকশন হতে পারে।
  • হরমোনের তারতম্য – নানা কারণে যখন মহিলাদের শরীরে হরমোনের ভারসাম্য বজায় থাকে না, তখন এধরণের সমস্যা হওয়া স্বাভাবিক।
  • গর্ভ নিরোধক বড়ি – অবাঞ্ছিত প্রেগন্যান্সি রোধ করতে অনেকেই নিয়মিত গর্ভ নিরোধক বড়ির উপর ভরসা করেন, তাঁদেরও কিন্তু ভ্যাজাইনাল ইনফেকশন হতে পারে।
  • অ্যান্টিবায়োটিক – অনেকসময়েই অনেক মহিলাকে নানা শারীরিক কারণে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ খেতে হয়। অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধগুলো খারাপ ব্যাক্তেরিয়ার সঙ্গে ভাল ব্যাক্টেরিয়াও নির্মূল করে ফলে ব্যাজাইনাল ইনফেকশন হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
  • অপরিচ্ছন্নতা – নিয়মিত যোনিদেশ পরিষ্কার না রাখলে, অন্তর্বাস না বদলালে, এমনকি ময়লা বিছানায় শুলেও কিন্তু vaginal yeast infection হতে পারে।
  • অসুরক্ষিত যৌন মিলন – যদিও ভ্যাজাইনাল ইস্ট ইনফেকশন সেক্সুয়ালি ট্রান্সমিটেড ডিজিজের মধ্যে পড়ে না, কিন্তু জীবাণু সংক্রমণের সময়ে শারীরিক মিলনে রত থাকলে তা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়।


এছাড়াও–

  • শারীরিক দুর্বলতা
  • অতিরিক্ত চিনি বা মিষ্টি খাওয়া
  • প্রস্রাবের পর ঠিকভাবে যোনিদেশ পরিষ্কার না করা
  • ওয়াক্সিং
  • অনিদ্রা
  • ধকল এগুলিও যোনিদেশে ফাঙ্গাল ইনফেকশন হওয়ার কারণ।


ভ্যাজাইনাল ইস্ট ইনফেকশন নির্ণয় এবং চিকিৎসা:
রোগ চেনার উপায়

কী করে বুঝবেন, অন্য কোনও যৌনবাহিত রোগ নয়, ভেজাইনাল ক্যানডিডিয়াসিসেই ভুগছেন আপনি? স্রাবের নমুনা সংগ্রহ করে তা ল্যাবে পরীক্ষার জন্য পাঠাতে হয় ফাঙ্গাল কালচারের জন্য। অনেক সময়ে আবার উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসাও করা হয়ে থাকে। এই সংক্রমণে আক্রান্ত হওয়ার সময়ে কারও সঙ্গে যৌন সংসর্গে এলে সেই ব্যক্তিরও সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। তাই অসুখ সারিয়ে নিয়ে তবেই স্বাভাবিক যৌনজীবনে ফেরা ভাল।

ভ্যাজাইনাল ইস্ট ইনফেকশন ডায়গনসিস করা খুব একটা জটিল নয়, তবে নিজে থেকে ডাক্তারি করতে যাবেন না একদম, এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। যদি যোনিদেশে চুলকানি, র‍্যাশ, দুর্গন্ধযুক্ত সাদাস্রাব বা অন্য কোনও রঙের (হলুদ বা সবজে বা খয়েরি) ঘন স্রাব বেরোয়, প্রস্রাব করার সময়ে বা যৌন মিলনের সময়ে জ্বালা বা ব্যথা করে, তাহলে তা অবহেলা না করে বরং চিকিৎসকের সাহায্য নিন।

জটিল নাকি সরল ইস্ট সংক্রমণ হয়েছে, তার ওপর ভ্যাজাইনাল ইস্ট সংক্রমণের চিকিৎসা হয়।

যদি আপনার ইস্ট সংক্রমণ বারবার না হয়, এবং উপসর্গ যদি হাল্কা থেকে মাঝারি মাত্রার হয়, তাহলে বুঝতে হবে এটি জটিল সংক্রমণ নয়। সরল সংক্রমণের জন্য নিম্নলিখিত চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরণ করার পরামর্শ দেওয়া হয়।

যখন সমস্যা কম থাকে
মহিলাদের যোনিদেশে যদি কোনও কারণে কখনও জীবাণু সংক্রমণ হয় তাহলে প্রথমদিকে কিন্তু সমস্যার প্রকোপ খুব বেশি থাকে না, তখন সহজভাবে কিছু দু-তিনদিনের ওষুধ খেলেই তা উপশম হতে পারে। তবে আবারও সেই একই কথা বলব, চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে তবেই ওষুধ খাবেন। আবার এমনও হতে পারে যে তিনি আপনাকে কোনও অয়েন্টমেন্ট দিলেন। যাই হোক না কেন, চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

সমস্যা যখন বেড়ে যায়
বেশিরভাগ মহিলা যেটা করে থাকেন, সমস্যা প্রথমদিকে এড়িয়ে যান এবং যখন সংক্রমণ খুব বেশিভাবে ছড়িয়ে পড়ে তখন চিকিৎসকের কাছে সাহাজ্যের জন্য যান। সেক্ষেত্রে অনেকসময়ে প্রায় দু-তিন সপ্তাহের খাওয়ার ওষুধের সঙ্গে অয়েন্টমেন্ট দেওয়া হয়। অনেকসময়ে ইনসারটিং পিলও দেওয়া হয়, এগুলি ট্যাবলেটের মত দেখতে হয় যা চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে নির্দিষ্ট সময়ে মহিলাদের যোনিদেশে প্রবেশ করাতে হয়। এগুলো সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিক ট্যাবলেট হয় কাজেই ভয়ের কোনও কারণ নেই। তবে সমস্যা যদি খুব বেশি বেড়ে যায় তখন চিকিৎসা দু-তিন সপ্তাহের বদলে মাস ছয়েক পর্যন্ত চলতে পারে!

প্রতিরোধে করণীয়:
যৌনাঙ্গের সাধারণ সংক্রমণ থেকে বাঁচতে পরিচ্ছন্ন থাকার পাশাপাশি কয়েকটি সাধারণ নিয়ম মেনে চলুন।

  • জেট স্প্রে ওয়াশের মাধ্যমে যৌনাঙ্গের ভিতরে সজোরে পানি দেবেন না। এতে এমন কিছু ব্যাকটিরিয়া ধুয়ে চলে যায়, যা যৌনাঙ্গকে সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করে।
  • যৌনাঙ্গে সুগন্ধিযুক্ত কোনও প্রডাক্ট, বাবল বাথ, স্প্রে, সুগন্ধি প্যাড কিংবা ট্যাম্পনের ব্যবহার না করাই ভাল।
  • নিয়মিত প্যাড, প্যান্টি পাল্টে পরুন। তা যেন খুব টাইট না হয়। অনেক সময়ে বেশিক্ষণ জিনস পরে থাকলেও ঘাম ও ময়শ্চারে ফাঙ্গাল ইনফেকশন দেখা দিতে পারে। অন্তর্বাস সুতির তৈরি হলেই ভাল।
  • যৌনাঙ্গের সংক্রমণ ও তার অস্বস্তি সবচেয়ে পীড়াদায়ক। তাই ছোট ছোট কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখলেই এড়ানো সম্ভব ইনফেকশন।

শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে