গ্যাস্ট্রাইটিস (পেটে জ্বালাপোড়া) কি?
আমাদের পাকস্থলীর গায়ে সূক্ষ্ম একটা ঝিল্লি আছে। পাকস্থলীকে ক্ষতিকর জীবাণু ও খাবারের অ্যাসিড থেকে বাঁচায় ওটা। কোনও কারণে ওই ঝিল্লি ক্ষতিগ্রস্ত হলে অ্যাসিডের সংস্পর্শে সেখানে তথা মিউকাস মেমব্রেনে এক ধরনের জ্বালাপোড়া বা প্রদাহ দেখা দেয়। এই অবস্থাকে গ্যাস্ট্রাইটিস রোগ বলে।

গ্যাস্ট্রাইটিস পরিপাক নালীর একটি অতি সাধারণ রোগ। পাকস্থলীর এই প্রদাহের জন্য পেটের উপর দিকে ব্যথা, জ্বালা, বুকজ্বালা, ঢেকুর তোলা, খাদ্য ওগরানো, বমির ভাব এবং কখনও কখনও বমি হয়। দীর্ঘ দিন ধরে বেদনা-নাশক ওষুধ খাওয়া (এনএসএআইডি), ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ, ধূমপান করা, মদ্যপান করা এবং কয়েকটি অটো-ইমিউন পরিস্থিতির ফলাফল হল গ্যাস্ট্রাইটিস। এই রোগ অনেক সময় কয়েক বছর ধরে চলতে থাকে।

গ্যাস্ট্রাইটিসের সময় শ্লেষ্মার পরিমাণ কমে যায়, ফলে নিজের তৈরি অ্যাসিডই পাকস্থলীকে আক্রমণ করে। ফলে পেটে ব্যথা এবং জ্বালা হয়। খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন এবং ওষুধ দিয়ে গ্যাস্ট্রাইটিসের নিয়ন্ত্রণ এবং নিরাময় করার হার খুবই উচ্চ।

সবার জীবনেই বিভিন্ন কারণে অন্তত একবার এই রোগ হয়। এই রোগ দীর্ঘ স্থায়ী কিম্বা তীব্র হতে পারে। যদি উপসর্গগুলি খুব বেশি ও তীব্র হয় এবং কয়েক দিনের ভিতরে নিরাময় হয় তখন তাকে একিউট গ্যাস্ট্রাইটিস বলা হয়। তুলনায় ক্রনিক গ্যাস্ট্রাইটিসের উপসর্গগুলি খুব কম বা মধ্য মাত্রার হয় এবং রোগ বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকে।

গ্যাস্ট্রাইটিস (পেটে জ্বালাপোড়া) এর উপসর্গ:
বিভিন্ন প্রকারের গ্যাস্ট্রাইটিসের বিভিন্ন প্রকারের উপসর্গ দেখা যায়। সব চেয়ে সাধারণ উপসর্গগুলি হল পাকস্থলীতে জ্বালা হওয়া এবং বুকের মাঝ খানে বুকজ্বালা হওয়া। অনেক মানুষের কোন উপসর্গই থাকে না, শুধু বদহজম হয়। গ্যাস্ট্রাইটিসের উপসর্গগুলির অন্তর্গত হল:

  • পাকস্থলীতে অথবা পেটের উপরের অংশে জ্বালাপোড়া।
  • বুক জ্বালাপোড়া।
  • অতিরিক্ত ঢেকুর তোলা।
  • খাদ্য নালী বা মুখের মধ্যে খাদ্য ওগরানো।
  • পেট ফোলা।
  • বমি বমি ভাব।
  • বমি হওয়া।
  • বদ হজম হওয়া।
  • হেঁচকি ওঠা।
  • খাবারে অরুচি।
  • পেট ফেঁপে থাকা।
  • মাথা ঘুরানো।
  • অল্প খাবার এর পর পেট পুরে গেছে মনে হওয়া।
  • গ্যাস্ট্রো ইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজের ক্ষেত্রে বুকে ব্যথা, সাথে অধিক হারে ঢেকুর ও বমিভাব।
  • ডিউডেনাম আলসার হলে পেটের মাঝামাঝি ব্যথা এবং ব্যাথা পুরো পেটে ছড়িয়ে পড়া।
  • গ্যাস্ট্রিক আলসারের সবচেয়ে অসাধারণ উপসর্গ হচ্ছে খাবার চাহিদা বেড়ে যাওয়া। অধিকহারে খাবার পরেও রোগীর ক্ষিধা লাগবে। কারণ আলসারের কারণে অনেক সময় দেখা যায়, পাকস্থলি থেকে ব্রেইনের হাংগার সেন্টারে তথা ক্ষিধা নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে নার্ভ সিগনাল সঠিকভাবে পরিচালিত হতে পারেনা। তাই রোগী পেট ভরে খেলেও ক্ষিধা নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে সঠিক মেসেজ না পাওয়ার কারনে ক্ষিধার পরিমান বাড়িয়ে দেয়।


গ্যাস্ট্রাইটিসের কারণ এবং প্রকারের উপরে নির্ভর করে এর উপসর্গগুলির তীব্রতা। কিন্তু কিছু বিপদজনক লক্ষণ আছে যেগুলি দেখা গেলে অবশ্যই ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা উচিত:

  • পেটের উপরের দিকে বা পাকস্থলীতে তীব্র ব্যথা (ছুড়ি মারা বা মোচড়ানোর মত ব্যথা)
  • রক্ত বমি (হেমাটেমেসিস)।
  • গাঢ় বা কালো রঙের মল।
  • মাথা ঘোরা বা দুর্বলতা।
  • নিঃশ্বাসের অসুবিধা।
  • ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া।

এই উপসর্গগুলি গুরুতর গ্যাস্ট্রাইটিস বা ক্ষয়কারী গ্যাস্ট্রাইটিসের ইঙ্গিত দেয়, যার জন্য জরুরী ভিত্তিতে চিকিৎসা শুরু করা প্রয়োজন।

গ্যাস্ট্রাইটিস (পেটে জ্বালাপোড়া) এর চিকিৎসা:
সৌভাগ্যবশত, সব রকমের গ্যাস্ট্রাইটিসের কার্যকরী চিকিৎসা এবং নিরাময় আছে। গ্যাস্ট্রাইটিস হওয়ার কারণ জানা গেলে তার জন্য নির্দিষ্ট চিকিৎসা করলে রোগ সেরে যায়। গ্যাস্ট্রাইটিসের চিকিৎসা তার উপসর্গ অনুযায়ী করা হয় এবং এন্টিবায়োটিক বা এন্টি-প্যারাসাইটিক ড্রাগগুলি এর নির্দিষ্ট চিকিৎসার অন্তর্গত থাকে।

  • এন্টাসিড: এই রকমের ওষুধে থাকে ম্যাগনেশিয়াম এবং এলুমিনিয়ামের লবণগুলি, যেগুলি পাকস্থলীর অ্যাসিডকে নিষ্ক্রিয় করে ব্যথা এবং জ্বালা কমায়। তবে, এদের জন্য উদরাময় বা কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে।
  • প্রোটোন-পাম্প ইনহিবিটারস: এই রকমের ওষুধগুলি পাকস্থলীতে অ্যাসিডের উৎপাদন হ্রাস করে। এতে উপসর্গগুলি কমে যায় এবং জ্বালা ও প্রদাহের উপশম হয়। এই ধরণের কয়েকটি ইনহিবিটার হল প্যান্টোপ্রাজোল, ওমিপ্রাজোল, রাবেপ্রাজোল এবং এসোমিপ্রাজোল।
  • এইচ২ ব্লকার্স: এই রকমের ওষুধগুলি পাকস্থলীতে অ্যাসিডের উৎপাদন হ্রাস করে কিন্তু এরা প্রোটোন পাম্প ইনহিবিটারগুলির চেয়ে কম কার্যকরী। এই রকমের কয়েকটি ওষুধ হল র‍্যানিটিডিন, নিজাটিডিন এবং ফ্যামোটিডিন।
  • এন্টিবায়োটিক: যে ব্যাকটেরিয়াগুলি, বিশেষত এইচ পাইলোরি, সংক্রমণ করে পাকস্থলীর আস্তরণের ক্ষতি করে, এই এন্টিবায়োটিকগুলি সেই ব্যাকটেরিয়াগুলির বৃদ্ধি প্রতিরোধ করে এবং তাদের ধ্বংস করে। এই এন্টিবায়োটিকগুলির উদাহরণ হচ্ছে এমোক্সিসিলিন, মেট্রোনিডাজোল অথবা ক্ল্যারিথ্রোমাইসিন।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে কয়েকটি চিকিৎসা পদ্ধতির সম্মিলন করে এবং সাথে জীবনধারার পরিবর্তন করে গ্যাস্ট্রাইটিসের চিকিৎসা করা হয়।

গ্যাস্ট্রাইটিস প্রতিরোধে পরামর্শ:

  • নিয়মিত সঠিক সময়ে খাবার খাওয়া।
  • বেশী বেশী পানি পান করা, প্রতিদিন আড়াই থেকে তিন লিটার পানি পান করা।
  • তৈলাক্ত খাবার ও চর্বি জাতীয় খাবার পরিহার করা, এবং নিয়মিত শাক সবজি ইত্যাদি খাওয়া।
  • অতিরিক্ত ঝাল খাবার পরিহার করা।
  • রাতের খাবার রাত ৯ টার মধ্যে শেষ করা, এবং খাবারের পর ২০ থেকে ৩০ মিনিট হাঁটাহাঁটি করা।
  • রেগুলার সকাল বেলায় ইসুপগুলের ভূসি ভিজিয়ে পানি পান করা। এতে করে অতিরিক্ত হাইড্রোক্লোরিক এসিড নিউট্রালাইজড হয়ে যাবে।
  • সকালে খালি পেটে ২ গ্লাস পানি পান করা।
  • দৈনিক কখনোই যেন ১৩০ গ্রামের বেশী গোস্ত খাওয়া না হয়।
  • অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকা।
  • হজম শক্তি ভালো না হওয়া পর্যন্ত দুধের তৈরি খাবার এড়িয়ে চলা উচিত।
  • ধুমপান, অ্যালকোহল ইত্যাদি পরিহার করা।
  • রাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমানো, সর্বনিম্ন ৬ থেকে ৭ ঘন্টা ঘুমানো।

শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে