মলদ্বারের ক্যান্সার বা অ্যানাল ক্যান্সার কি?
মলদ্বারের ক্যান্সার হল গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সিস্টেমের একটি বিরল ম্যালিগন্যান্সি বা খারাপ অবস্থা । অ্যানাল ক্যান্সার বলতে মলদ্বারের অথবা অ্যানাল ক্যানেল, যেটি পায়ুর একদম শেষ ভাগ তাকে বোঝায়। এই ক্যান্সারের প্রকোপ যথেষ্টভাবে যে বাড়ছে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

মলদ্বারের রোগের মধ্যে পাইলস ও ফিস্টুলা জটিল রোগ। আমাদের ধারণা, পায়ুপথের বিভিন্ন সমস্যা যেমন— রক্ত যাওয়া, ব্যথা হওয়া, ফুলে যাওয়া এসবই হয় পাইলসের কারণে। এ ধারণা ঠিক নয়। প্রতিটি উপসর্গই পায়ুপথে ক্যান্সার হতে পারে। ফিস্টুলা বা ভগন্দর রোগেও এমন উপসর্গ দেখা দিতে পারে। পায়ুপথে ক্যান্সার হলে সেটিও ফিস্টুলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে।

মলদ্বারের ক্যান্সার এর প্রধান লক্ষণ এবং উপসর্গগুলো কি কি?
সাধারণ লক্ষণ এবং উপসর্গ গুলি হল:

  • মলদ্বার থেকে রক্তপাত এবং ব্যথা।
  • ফিস্টুলাসের উপস্থিতি (অ্যানাল ক্যানাল অথবা পায়ুনালী এবং নিতম্বের ত্বকের মধ্যে অস্বাভাবিক সরু নালীর মতো সংযোগ)।
  • পায়খানার সঙ্গে রক্ত ও মিউকাস বা আম যাওয়া।
  • কিছুদিন পাতলা পায়খানা এবং এরপর কিছুদিন কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়া।
  • মল ত্যাগের অভ্যাসে পরিবর্তন।
  • খুব সকালে পায়খানার বেগ হওয়া।
  • মল ত্যাগের পর আরও মল রয়ে গেছে এরূপ অনুভূতি হওয়া।
  • শারীরিক পরীক্ষা করার সময় সহজে সনাক্ত করা যায় এমন স্ফীত লিম্ফ নোড।
  • পায়ুর প্রান্তে ক্যান্সারে যে সকল ঘায়ের বৈশিষ্টগুলি প্রকাশ পায় তা হল, উত্থিত, শক্ত কিনারা দেখা যায়।


বিরল লক্ষণ এবং উপসর্গগুলো হল:

  • মলদ্বারে একটি মাংসপিন্ডের উপস্থিতি।
  • চুলকানি এবং তার সাথে তরলের নির্গমণ।
  • পেশীচক্র (স্ফিঙ্কটার), যা মল নির্গমণ নিয়ন্ত্রণ করে তার কার্যক্ষমতা কমে যাওয়া, ফলে পায়ুর মল ধরে রাখার ক্ষমতা হারিয়ে যায়।
  • লিভার বা যকৃৎ-এর আকৃতি বেড়ে যাওয়া।


মলদ্বারের ক্যান্সার হওয়ার প্রধান কারণগুলি কি কি?
সবচেয়ে সাধারণ কারণ হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের সংক্রমণ, একটি যৌনবাহিত রোগ, যা ধীরে ধীরে অ্যানাল ক্যান্সারের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ঝুঁকির কারণগুলি হল:

দুর্বল রোগ প্র্রতিরোধক ক্ষমতা।

  1. অ্যাকুয়ার্ড ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি সিনড্রোম (এইডস)।
  2. দুর্বল রোগ প্র্রতিরোধক ক্ষমতা বা রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ীভাবে অকার্যকরী থাকা।


বয়স এবং লিঙ্গ

  1. বয়স্ক পুরুষ ও মহিলাদের এটা বেশি হয়ে থাকে।


চিকিৎসাগত অবস্থা

  1. সার্ভিক্স, স্ত্রীযোনিদ্বার বা যোনির ক্যান্সার।
  2. আগে থেকেই দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহজনক আন্ত্রিক রোগ থাকলে।


জীবনযাত্রা

  1. ধূমপান।
  2. একাধিক সঙ্গীর সাথে সহবাস করা।
  3. সমকামীতা, বিশেষ করে পুরুষদের মধ্যে।


কিভাবে মলদ্বারের ক্যান্সার বা অ্যানাল ক্যান্সার নির্ণয় এবং চিকিৎসা করা হয়?
রোগ নির্ণয়
অ্যানাল ক্যান্সার শুধুমাত্র চিকিৎসাকেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে এবং উপসর্গের ভিত্তিতে নির্ণয় করা যায় না। টিউমারের পরীক্ষা করার জন্য অচেতন করার পর শারীরিক পরীক্ষার পাশাপাশি, ডাক্তার অ্যানাল ক্যান্সার সনাক্ত করার জন্য নিচের পরীক্ষাগুলি করার পরামর্শ দেন:

  • এন্ডো-অ্যানাল আল্ট্রাসাউন্ড ইমেজিং
  • ম্যাগনেটিক রেসোনেন্স ইমেজিং (এম আর আই)
  • কম্পিউটেড টোমোগ্রাফি (সি টি) স্ক্যান/পজিট্রন এমিশন টোমোগ্রাফি (পি ই টি) স্ক্যান


চিকিৎসাঃ

  • বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অ্যানাল ক্যান্সারের প্রাথমিক চিকিৎসা করা হয় রেডিওথেরাপি দিয়ে, সঙ্গে কেমোথেরাপি অথবা কেমোথেরাপি ছাড়া। বয়স্ক ও দুর্বল রোগীদের জন্য, কেমোথেরাপি এবং অ্যান্টিবায়োটিক প্রফিল্যাক্সিস উন্নত করা জরুরি।
  • রেডিওথেরাপি করার ক্ষেত্রে অসুবিধা হল রেডিওনেক্রসিস (বিকিরণ-এর কারণে টিস্যুর ক্ষতি বা নষ্ট হওয়া), যার কারণে অস্ত্রপ্রচার একটি নিরাপদ বিকল্প হয়ে ওঠে। আক্রমনাত্মক ক্যান্সারের ক্ষেত্রে অ্যাবডোমিনোপেরিনিয়াল এক্সিশন বা ছেদন (মলদ্বার অপসারণ, যেখানে মলাশয় এবং মলদ্বারের একটা অংশ কেটে বাদ দিয়ে দেওয়া) করা হয়। মারাত্মক ধরণের ক্যান্সারের ক্ষেত্রে বা যেসব ক্যান্সারের বারবার পুনরাবৃত্তি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাদের ক্ষেত্রে টিউমার এর অংশটা কেটে বাদ দেওয়াটাই হল উপযুক্ত চিকিৎসা।
  • ইনগুইনাল লিম্ফ নোডের জন্য রেডিয়েশন থেরাপি প্রয়োজনীয়। রেডিয়েশন থেরাপির ফলে অবনতি বা ব্যর্থতার ক্ষেত্রে, লিম্ফ নোডের অপসারণে অস্ত্রপ্রচার প্রয়োজন হয়।
  • বারবার হওয়া অ্যানাল ক্যান্সার এর জন্য অ্যাবডোমিনোপেরিনিয়াল রেসেক্শন বা অংশ ছেদনের সাথে একটি কলোসটমি (কোলন বা মলাশয় কেটে বাদ দেওয়া) প্রয়োজন।
  • ইনট্রা-অপারেটিভ রেডিওথেরাপি এবং ব্র্যাকিওথেরাপি (তেজস্ক্রিয় ইমপ্লান্টগুলি বসানো) মলদ্বারে ক্যান্সারের চিকিৎসা হওয়ার পর তার পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা কমায়।
  • অন্যান্য চিকিৎসার বিকল্পগুলি হল ফটোডাইনামিক (একটি নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো ব্যবহার করে) থেরাপি এবং ইমিউনোথেরাপি।


মলদ্বারের ক্যান্সার প্রতিরোধে করণীয়-

  • স্ক্রিনিং- যাদের বয়স ৫০ এর উপরে, যাদের বংশগত মলদ্বারের ক্যান্সারের ইতিহাস আছে বা যাদের দীর্ঘদিন আন্ত্রের ঘা জাতীয় সমস্যা আছে অথবা আদের উপরোল্লিখিত লক্ষণসমূহ আছে তাদের জন্য স্ক্রিনিং গুরুত্বপূর্ণ।
  • আহার ও পুষ্টি- প্রচুর পরিমাণে শাক সব্জি, আশঁযুক্ত খাবার, ফলমূল ও ভাল মানের শর্করা জাতীয় খাবার গ্রহণ। ঘনঘন উচ্চমাত্রার প্রোটিন বা লাল মাংস পরিহার, সম্পৃক্ত চর্বি জাতীয় খাবার পরিহার ও এর বদলে স্বাস্থ্যকর চর্বি যেমন- এভোকেডো, জলপাইয়ের তেল, মাছের তেল বা বাদাম উপকারী। এছাড়া ভিটামিন সি ও প্রত্যহ এক কাপ কফি এই ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
  • ব্যায়াম- দেখা গেছে নিয়মিত হাল্কা বা মাঝারি ব্যায়ামের কারনে মলদ্বারের ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।
  • শরীরের ওজন- শরীরের বাড়তি ওজন বা স্থূলতার কারনে মলদ্বারের ক্যান্সার সহ অন্যান্য ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।

শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে