ইনফ্লামেটরি বাওয়েল ডিজিজ কি?
পরিপাকতন্ত্রে মারাত্মক প্রদাহ সৃষ্টিকারী একটি রোগ ‘ইনফ্লামেটরি বাওয়েল ডিজিজ’ বা ‘আইবিডি’। বিশ্বে প্রায় এক কোটি আইবিডি রোগী আছে। দীর্ঘায়িত সময়ের জন্য প্রদাহ হলে গ্যাস্ট্রোইন্টেসটিনাল (জিআই/GI) ট্র্যাক্টের ক্ষতি হয়।

‘আইবিডি’ বা ‘ইনফ্লামেটরি বাওয়েল ডিজিজ’ দুই ধরনের হয়ে থাকে।

  • আলসারেটিভ কোলাইটিস : এটি প্রধানত বৃহদন্ত্রে প্রদাহ বা আলসার তৈরি করে থাকে।
  • ক্রন্স ডিজিজ : এই রোগে পরিপাকতন্ত্রের যেকোনো অংশ (মুখ থেকে পায়ুপথ) আক্রান্ত হতে পারে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শুধু ক্ষুদ্রান্ত্র, বৃহদন্ত্র অথবা উভয় অংশই আক্রান্ত হতে পারে।


আইবিডি একটি দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা যা বছরের পর বছর চলতে থাকে এবং হঠাৎ হঠাৎ বেড়ে যাওয়া ও কমে যাওয়ার আচরণ দেখায়। আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশে ক্রনস ডিজিজ-এর চেয়ে আলসারেটিভ কোলাইটিস এ মানুষ বেশী আক্রান্ত হচ্ছে। আর ওষুধ খেয়ে রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখছে ।

ইনফ্লামেটরি বাওয়েল ডিজিজের প্রধান লক্ষণ এবং উপসর্গগুলো কি কি?
অধিকাংশ ক্ষেত্রে, ১৫ থেকে ৪০ বছর বয়সের পর্যায়ে থাকা মানুষদের আইবিডি নির্ণয় করা হয়। উপসর্গগুলি প্রত্যেক মানুষের ক্ষেত্রে ভিন্ন হতে পারে। কিছু উপসর্গ নীচে উল্লেখ করা হল:

  • ব্যথা বা পেটে মোচড়।
  • ওজন কমে যাওয়া।
  • ক্লান্তি ভাব।
  • শরীরের ওজন কমে যাওয়া।
  • খাবারে অরুচি।
  • ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানা।
  • মলের সঙ্গে রক্ত বা পুঁজ যাওয়া।
  • মলত্যাগ করার জন্য প্রচন্ড তাড়াহুড়ো করা।
  • রোগের সক্রিয় পর্যায়ের সময় জ্বর হওয়া।

যদি আইবিডি স্থায়ী হয়, তবে উপসর্গগুলি প্রদাহের মাত্রার ওপর নির্ভর করে আসে ও যায়। যখন জ্বালা তীব্র হয়, তখন রোগটা সক্রিয় পর্যায়ে থাকে, এবং যখন জ্বালা কমে যায়, তখন রোগটা মৃদু উপসর্গগুলির সাথে উপশম হচ্ছে বলে বিবেচনা করা হয়।
‘আইবিডি’ হলে অন্ত্রনালি সরু হয়ে যাওয়া, ফিস্টুলা, চোখ, ত্বক ও অস্থিসন্ধির প্রদাহজনিত অসুখ, কোলন ক্যান্সার ইত্যাদিও হতে পারে।

ইনফ্লামেটরি বাওয়েল ডিজিজের প্রধান কারণগুলো কি কি?
আইবিডি এর প্রকৃত কারণ জানা যায়নি। তবে জেনেটিক জন্মগত এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার সাথে এর সম্পর্ক রয়েছে। পূর্বে খাদ্যাভাস ও মানসিক চাপকে এর কারণ হিসেবে সন্দেহ করা হত, কিন্তু এখন জানা গেছে যে , এ ফ্যাক্টর গুলো আইবিডি বাড়িয়ে তোলে কিন্তু রোগের কারণ নয়।

  • জেনেটিক কারণঃ যদি পরিবারের কারো অথবা পিতা মাতার এ রোগটি থাকে তাহলে তা বংশানুক্রমে হবার সম্ভাবনা থাকে কিন্তু বেশিরভাগ রোগীর ক্ষেত্রেই পারিবারিক ইতিহাস পাওয়া যায় না।
  • রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভিত্তিক কারণ।
  • সাধারণত ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দেহকে বিভিন্ন রোগ উৎপন্নকারী ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া থেকে রক্ষা করে। কিন্তু আইবিডি এর ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ইমিউনিটি রেসপন্স বা সাড়া প্রদানের কারণে রোগজীবাণু না থাকা সত্ত্বেও ইমিউন সিস্টেম দেহের নিজস্ব পরিপাক নালির কোষকে আক্রমণ করে বসে। এ প্রক্রিয়াকে অটো ইমিউন রেসপন্স বলে। প্রদাহ কয়েক মাস থেকে বছর পর্যন্ত থেকে যায়।


ইনফ্লামেটরি বাওয়েল ডিজিজের ঝুঁকিপূর্ণ ফ্যাক্টর:

  • ধূমপান।
  • যে কোনো বয়সে হতে পারে তবে ৩৫ বছরের পূর্বে শুরু হয় বেশি ।
  • পরিবারের ভাই-বোন , বাবা- মা বা অন্যদের থাকলে এ রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
  • শহরে ও শিল্প কারখানা ভিত্তিক দেশে যারা বাস করে তাদের ঝুঁকি বেশি ।
  • যারা চর্বি ও প্রক্রিয়াজাত খাবার বেশি খায়।
  • শীত প্রধান দেশে এর প্রভাব বেশি।
  • এটি উভয় লিঙ্গের মানুষকে আক্রান্ত করে । তবে আলসারেটিভ কোলাইটিস পুরুষদের ক্ষেত্রে এবং ক্রোন’স ডিজিজ মহিলাদের ক্ষেত্রে বেশি হয় ।


ইনফ্লামেটরি বাওয়েল ডিজিজ কিভাবে নির্ণয় এবং চিকিৎসা করা হয়?
শারীরিক পরীক্ষা এবং বিশদ ইতিহাস নেওয়া ছাড়াও, আইবিডি সাধারণত এন্ডোস্কোপি অথবা কোলোনোস্কোপি এবং ইমেজিং স্টাডিসের একটি সমাহারের সাথে নির্ণয় করা হয়, যার মধ্যে রয়েছে এমআরআই, সিটি স্ক্যান এবং কনট্রাস্ট রেডিওগ্রাফি। রোগ নির্ণয় নিশ্চিত করার জন্য মল পরীক্ষা এবং রক্ত পরীক্ষা করা হয়।

চিকিৎসাঃ
চিকিৎসা প্রধান উদ্দেশ্য হল অন্ত্রের প্রদাহ কমানো এবং উপসর্গগুলি থেকে স্বস্তি দেওয়া। আইবিডি রোগটি যেমন দীর্ঘমেয়াদী তেমনি এর চিকিৎসাও দীর্ঘমেয়াদী। আইবিডির চিকিৎসায় দীর্ঘদিন স্টেরওয়েড, স্যালাজিন, মিথোট্রিক্সেট, সাইক্লোস্পরিন, এন্টাই টিএনএফ ইত্যাদি শক্তিশালী ঔষধ ব্যবহার করা হয়। এ জন্য এ রোগের চিকিৎসা নিয়মিত চিকিৎসকের সান্নিধ্যে থেকে করতে হয়। তদুপরী যাদের ৮ বছরের বেশী সময় ধরে আইবিডি রোগ থাকে তাদের অন্ত্রে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এ কারণে এ রোগের ব্যাপারে অবহেলা করার ন্যূনতম সুযোগ নেই।

ইনফ্লামেটরি বাওয়েল ডিজিজে করণীয়:
‘আইবিডি’ সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য রোগ না হলেও নিয়মিত বিভিন্ন ধরনের ওষুধ সেবনের মাধ্যমে এ রোগ সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণযোগ্য। ক্ষেত্রবিশেষে ‘আইবিডি’তে আক্রান্ত রোগীদের সার্জারিও প্রয়োজন হতে পারে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কখনোই ওষুধ বন্ধ করা বা ডোজ পরিবর্তন করা উচিত নয়। ওষুধের সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে চিকিৎসককে জিজ্ঞেস করবেন। ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। রোগের কোনো লক্ষণ না থাকলেও নিয়মিত চিকিৎসকের ফলোআপে থাকবেন। জটিলতা দেখা দিলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। রোগের তীব্রতা এবং লক্ষণগুলোর ওপর নজর রাখবেন। চিকিৎসায় নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় রোগের লক্ষণ/উপসর্গ ফের দেখা দিলে চিকিৎসককে অবহিত করবেন।

ইনফ্লামেটরি বাওয়েল ডিজিজ প্রতিরোধে করণীয়:
জন্মগত কারণ প্রতিরোধ করা সম্ভব নয় তবে এ রোগ হওয়ার ঝুঁকি কমানোও প্রতিরোধ করা সম্ভব।

  • স্বাস্থ্যসম্মত ও খাদ্য খাওয়া।
  • নিয়মিত শরীরচর্চা করা।
  • ধূমপান বন্ধ করা।

শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে