ওভারিয়ান ক্যান্সার বা ডিম্বাশয়ের ক্যান্সার কি?
মহিলাদের ডিম্বাণু (ওভাম) সৃষ্টিকারক অঙ্গ (ওভারি)-এর টিস্যুর ক্যান্সারকে ওভারিয়ান ক্যান্সার বা ডিম্বাশয় ক্যান্সার বলে। ওভারিয়ান টিউমার বিনাইন (ক্যান্সারবিহীন) অথবা ম্যালিগন্যান্ট (ক্যান্সারযুক্ত) হতে পারে। গাইনোলজিকাল বা স্ত্রীরোগসম্বন্ধীয় ক্যান্সারের মধ্যে এটি সবচেয়ে বিপজ্জনক এবং সাধারণত বয়স্ক মহিলাদের মধ্যে দেখা যায়।
এটি একটি কোষের অস্বাভাবিক ফলাফল যা শরীরের অন্যান্য অংশে আক্রমণ বা বিস্তারের ক্ষমতা রাখে। যখন এই প্রক্রিয়া শুরু হয়, যে কোনো বা শুধুমাত্র অস্পষ্ট উপসর্গ থেকে। তবে শরীরের কোনো অংশ ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে কিছু লক্ষণ দেখা যায়।
তবে সাধারণত পঞ্চাশোর্ধ নারীরা এই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। বাংলাদেশে ওভারিয়ান ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়লেও এ নিয়ে তেমন কোন গবেষণা এখনো হয়নি।
ওভারিয়ান ক্যান্সারের প্রধান লক্ষণ ও উপসর্গগুলি কি কি?
ওভারিয়ান বা ডিম্বাশয়ের ক্যান্সার খুব ধীর গতিতে বিকশিত হয় বলে প্রাথমিক পর্যায়ে সনাক্ত করা খুব মুশকিল। এই ক্যান্সার যতক্ষণ পর্যন্ত পেলভিক জোনে (শ্রোণি এলাকা) এবং পেটে না ছড়ায় ততক্ষণ পর্যন্ত এটি বুঝা যায় না। চিকিৎসকদের মতে- এই ক্যান্সারের প্রাথমিক উপসর্গ একেবারে নাই বললেই চলে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যথা হয় না। কিছু সাধারণ লক্ষণ ও উপসর্গগুলি হলো:
- অনিয়মিত ঋতুস্রাব অথবা ঋতু প্রবাহ ও চক্রে পরিবর্তন।
- যৌনমিলনের সময় ব্যথা।
- বুকজ্বালা।
- পিঠ ও পেলভিক বা শ্রোণীচক্রে ব্যথা।
- শ্রোণী অঞ্চল ফুলে ওঠা।
- ক্ষুধামান্দ্য।
- ওজন হ্রাস।
- বমিভাব।
- কোষ্ঠকাঠিণ্য।
- পেটফাঁপা।
- শ্বাসকষ্ট।
- ক্লান্তি।
- ঘনঘন প্রস্রাব।
- ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম (আইবিএস) ওভারিয়ান ক্যান্সারের লক্ষণ ও উপসর্গগুলি অনুকরণ করে।
কারা ওভারিয়ান ক্যান্সারের ঝুঁকিতে রয়েছে?
যেসব মহিলা তাদের আয়ুষ্কালে অধিক ডিম্বাণু উৎপাদন করেন তাদের ডিম্বাশয় ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি। এটি অন্তর্ভুক্ত করে সেসব নারীকে যাদের সন্তান ছিল না, যারা অল্প বয়সে বাচ্চা নেয়া শুরু করে এবং যারা অধিক বয়সে রজোবন্ধে পৌঁছায়। অন্যান্য ঝুঁকির কারণগুলি হল রজোবন্ধ, প্রজনন চিকিৎসার ওষুধ এবং স্থূলতার পরে হরমোন থেরাপি নেওয়া। আর ঝুঁকি হ্রাসকারী কারণগুলি অন্তর্ভুক্ত করেছে হরমোনাল জন্ম নিয়ন্ত্রণ, টিউবালাইজেশন এবং বুকের দুধ খাওয়ানো।
ওভারিয়ান ক্যান্সারের প্রধান কারণগুলি কি কি?
বেশিরভাগ ওভারিয়ান ক্যান্সারের প্রকৃত কারণ পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় না। সাধারণ কিছু বিপজ্জনক কারণ হলো:
- আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী ১৫ থেকে ২০ শতাংশ নারী জিনগত কারণে এ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন।
- সন্তান হয়নি এমন মহিলা।
- মানসিক চাপ।
- বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া।
- ডিম্বাশয় অথবা স্তন ক্যান্সার থাকার পারিবারিক ইতিহাস।
- অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ কারণগুলির মধ্যে রয়েছে ধূমপান, পশ্চিমা খাদ্যাভাস, স্থুলকায় রোগ, ডিওড্রেন্ট ব্যবহার, ট্যালকম পাউডার ব্যবহার, পরিবেশ দূষণ, দারিদ্রতা এবং শৈশবস্থা থেকে খারাপ খাদ্যাভাস।
ওভারিয়ান ক্যান্সার কিভাবে নির্ণয় ও চিকিৎসা করা হয়?
ওভারিয়ান ক্যান্সারের নির্ণয়ের জন্য চিকিৎসকেরা বিভিন্ন পদ্ধতি গ্রহণ করেন, যেমন:
- তলপেট এবং পেলভিকের আল্ট্রাসাউন্ড: ডিম্বাশয় সংক্রান্ত কোনওরকম অসুখের ক্ষেত্রে আলট্রাসাউন্ডকে সর্বাধিক প্রাধান্য দেওয়া হয় প্রথম টেস্ট হিসেবে।
- সিটি স্ক্যান: বড়ো আকারের টিউমার সনাক্ত করতে ব্যবহৃত হলেও, এতে কিন্তু ছোটো আকারের টিউমার ধরা পড়ে না।
- এমআরআই স্ক্যান: এটি মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ডে ক্যান্সার ছড়িয়েছে পড়া সনাক্ত করতে সাহায্য করে।
- রক্তপরীক্ষা: পরীক্ষা করা হয় সিএ-১২৫ এর মাত্রা জানার জন্য, যা ডিম্বাশয়ের ক্যান্সারযুক্ত কোষগুলি উৎপন্ন করে।
- ল্যাপারোস্কপি (Laparoscopy)।
- সিরাম টিউমার মার্কার টেস্ট।
- ইমিউনোলজিক্যাল (Immunological) টেস্ট।
ক্যান্সার নির্ণয় হলে, এর চিকিৎসা নিম্নলখিত উপায়ে করা হয়:
- কেমোথেরাপি।
- অপারেশন।
- রেডিয়েশন থেরাপি।
- এছাড়াও, আকুপাংচার, ভেষজ ওষুধ, ধ্যান এবং যোগব্যায়ামের মতো কিছু পরিপূরক চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে, যা প্রচলিত চিকিৎসার সঙ্গেই ব্যবহৃত হয়।
প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত হলে চিকিৎসা সফল হবার সম্ভাবনা বেশি। এই রোগে আক্রান্ত হলে চিকিৎসা নেওয়া উচিত। কেমোথেরাপি বা রেডিয়েশন কতটুকু কার্যকর সেটা অনকোলজিস্ট বলতে পারবেন। তবে যাদের শরীরে ওভারিয়ান ক্যান্সার হবার ঝুঁকি বেশী, তারা আরো বড় একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, আর তা হলো ওভারি এবং ফ্যালোপিয়ান টিউব অপসারণ। ইউরোপ-আমেরিকায় অনেকেই এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন কারণ ওভারিয়ান ক্যান্সার রোধে এটি একটি কার্যকরী পদ্ধতি। গবেষণায় দেখা যায়, যেসব নারী সন্তানকে বুকের দুধ দেন তাদের মাঝে ওভারিয়ান ক্যান্সার হবার প্রবণতা কম।
তাহলে, জেনে নিলেন তো ওভারিয়ান ক্যান্সার সম্পর্কে। পরিমিত ঘুম, ব্যালেন্স ডায়েট, শারীরিক পরিশ্রম আর নিজের প্রতি একটু সচেতনতা সবকিছু মিলিয়ে সুস্থভাবে জীবন যাপন করুন। মেডিকেল সাইন্স অনেক এগিয়ে গেছে, এই রোগের সাথে যুদ্ধ করে অনেকেই আগের চাইতে সুস্থ জীবন যাপন করছেন। সুতরাং ওভারিয়ান ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে মানসিকভাবে ভেঙ্গে না পড়ে সঠিক চিকিৎসা নেওয়াটাই গুরুত্বপূর্ণ।