জরায়ুর অস্বাভাবিক রক্তপাত (অ্যাবনরমাল ইউটেরাইন ব্লিডিং) কি?
এটা প্রকৃতিরই আইন যে প্রত্যেক মেয়ে বা নারীরই নিয়মিত প্রতি মাসে তিন থেকে সাত দিন জরায়ু থেকে মোটামুটি পরিমাণে রক্তপাত হয়, যাকে আমরা বলি ঋতুস্রাব বা মেনস্ট্রুয়েশন। নারীদেহের অভ্যন্তরে জটিল সব ক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশই এ ঋতুস্রাব।

যতক্ষণ পর্যন্ত এটা পরিমিত পরিমাণে থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত সবকিছুই ঠিক থাকে। কিন্তু স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি রক্তপাত হলেই দেখা দেয় জটিলতা। বার বার মাসিক হওয়ার অভিজ্ঞতা, মাসিক চক্রের সময় বেশি রক্তের প্রবাহ এবং দীর্ঘ সময় ধরে রক্তপাতকে জরায়ুর অস্বাভাবিক রক্তপাত হিসেবে গণ্য করা হয়।

যেহেতু সব মহিলাদের মাসিকের সময় নির্ধারিত তারিখে আসে না, তাই ২ টি মাসিকের মধ্যে ২১ এবং ৩৫ দিনের একটি সীমাকে স্বাভাবিক ধরা হয়। যদি এটা অতিক্রম করে যায় বা খুব শীঘ্র হয়ে যায়, তাহলে এই রক্তপাতের কারণগুলি জানার জন্য একটি পরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে।

জরায়ুর অস্বাভাবিক রক্তপাতের প্রকারভেদ:
এ ধরনের অস্বাভাবিকতাকে আমরা প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করতে পারি। একটি হচ্ছে জননতন্ত্রের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গের শারীরবৃত্তিক অসুবিধা, যেমন: প্রদাহ, টিউমার অথবা ক্যানসার। আর অন্যটিকে আমরা বলতে পারি ডিসফাংকশনাল ইউটেরাইন ব্লিডিং, যেখানে শারীরবৃত্তিক কোনো অসুবিধা থাকে না, সমস্যাটা থাকে ঋতুচক্রের কার্যকলাপে। এ ক্ষেত্রে নিয়মিত ঋতুস্রাবের ব্যাঘাত ঘটে এবং রক্তপাত হয় প্রচুর পরিমাণে।

প্রথমোক্ত ক্ষেত্রে ওভারি বা ডিম্বাশয়, জরায়ু ও ভ্যাজাইনা বা যোনিপথ—এসবের যেকোনো স্থানে যেকোনো ধরনের রোগই অস্বাভাবিক রক্তপাত ঘটায়। তবে এ ক্ষেত্রে ঋতুস্রাব থাকে নিয়মিত। আর এসব স্থানে প্রধানত যে রোগ দেখা যায়, তা হচ্ছে সার্ভাইকাল পলিপ, সার্ভাইকাল ইরোসন, ক্যানসার, জরায়ুর টিউমার, রিটেইনড প্ল্যাসেন্টা, এন্ডোমেট্রাইটিস, ওভারিয়ান টিউমার ইত্যাদি।

জরায়ুর অস্বাভাবিক রক্তপাতের প্রধান লক্ষণ এবং উপসর্গগুলি কি কি?
যদিও চিকিৎসকেরা মাসিকের সময় নির্দিষ্ট তারিখ থেকে কিছুটা সরে গেলে মহিলাদের অস্বাভাবিকতার নির্দেশ দেন, তাও আরো কিছু নির্ধারিত লক্ষণ আছে যা জরায়ুর অস্বাভাবিক রক্তপাতকে নির্দেশ করে, সেগুলি হল:

  • এমন একটি মাসিক বা পিরিয়ড যা ৩ সপ্তাহের মধ্যে একবারের তুলনায় বেশি বার হয়, বা আবার হতে ৫ সপ্তাহেরও বেশি সময় নেয়।
  • মাসিক যদি একসপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে চলে বা ২ দিনের মধ্যে শেষ হয়ে যায়।
  • এক ঘন্টায় একবারের তুলনায় বেশিবার ট্যাম্পুন বা প্যাড বদলানো।
  • যৌনসম্পর্কের পরে বা মাসিকের মধ্যে রক্তপাত বা স্পটিং (ছোপ পরা)।


জরায়ুর অস্বাভাবিক রক্তপাতের প্রধান কারণগুলি কি?
এই অবস্থাটির জন্য সবচেয়ে সাধারন কারণটি হল হরমোনগুলির মধ্যে ভারসাম্যহীনতা। এছাড়া অন্যান্য কারণগুলি হল:

  • জন্ম নিয়ন্ত্রণের ওষুধ।
  • অবসাদ এবং উদ্বেগ।
  • বর্ধিত ওজন বৃদ্ধি বা ওজন হ্রাস।
  • একটি আইইউডি।
  • জরায়ুতে ফাইব্রয়েডের উপস্থিতি।
  • রক্ত পাতলা করার ওষুধ।
  • সারভাইকাল ক্যান্সার বা ইউটেরাইন ক্যান্সার।
  • থাইরয়েড বা কিডনির অসুস্থতা।
  • সারভিক্স বা জরায়ুতে সংক্রমণ।


জরায়ুর অস্বাভাবিক রক্তপাত রোগ কিভাবে নির্ণয় এবং চিকিৎসা করা হয়?
তাৎক্ষণিকভাবে হয়ত রোগটি নির্ণয় সম্ভব নয়, কারণ চিকিৎসক শারীরিক পরীক্ষা করবেন, এবং পরবর্তী চক্র এবং মাসিককে নিরীক্ষণ করারও সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। গর্ভাবস্থার পরীক্ষা এবং চিকিৎসার ইতিহাস হল প্রাথমিকভাবে রোগ নির্ণয় করার অপর পদক্ষেপ। এরপর হরমোনের ভারসাম্যহীনতা, লৌহ বা আয়রনের অভাব বা রক্ত সম্পর্কিত রোগের জন্য রক্ত পরীক্ষা করা হয়। চিকিৎসক গর্ভাশয় পরীক্ষা করার জন্য একটি আল্ট্রাসাউন্ড করবেন, বা গর্ভাশয় গ্রীবা বা সারভিক্সের পরীক্ষা করার জন্য হিস্টারোস্কোপি করবেন। যদি ক্যান্সার বা অন্য কোনো রোগ সম্পর্কে সন্দেহ থাকে, তাহলে বায়োপসি করা যেতে পারে।

ডায়াগনোসিস বা রোগ নির্ণয় কি নির্দেশ করছে তার উপর নির্ভর করে, এই সমস্যাটির মোকাবিলা করার জন্য এবং দ্রুত আরাম দেওয়ার জন্য চিকিৎসার একটি কোর্স বা পদ্ধতি বেছে নেওয়া হয়। চিকিৎসার কিছু পদ্ধতি হল:

  • পিরিয়ড বা মাসিক নিয়মিত করার জন্য এবং রক্তপাতকে স্বাভাবিক করার জন্য হরমোনের ওষুধ, যার মধ্যে জন্ম নিয়ন্ত্রণের ওষুধ গোনাডোট্রপিন - রিলিজিং হরমোন অ্যাগোনিস্ট অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
  • রক্তপ্রবাহ কম করার জন্য অ্যান্টি-ইনফ্লেম্যাটরি বা প্রদাহ কমানোর ওষুধ।
  • রক্ত জমাট বাধা এবং রক্তপাত কম করতে ট্রানেক্সামিক অ্যাসিড।
  • এন্ডোমেট্রিয়াল বিমোচন যা জরায়ুর আস্তরণ ধ্বংস করে দেয়, তবে কার্যত পরে মাসিক বন্ধ করে দেয়।
  • মায়োমেক্টমি - যা ফাইব্রয়েডগুলিকে সরিয়ে দেয় বা তাদের মধ্যে রক্ত সরবরাহ বন্ধ করে দেয়।
  • বড় ফাইব্রয়েড বা জরায়ুর ক্যান্সারের জন্য হিস্টারেক্টমি।


শেষ কথা
অস্বাভাবিক জরায়ু রক্তপাত একজন নারীর জীবনকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। কখন রক্তপাত শুরু হবে তা পূর্বাভাস দিতে না পারা সর্বদা উদ্বিগ্ন করতে পারে। এছাড়াও, ভারী মাসিক রক্তপাত পিরিয়ড চলাকালীন নারীর দৈনন্দিন কাজকর্ম সীমিত করতে পারে।

আক্রান্ত নারী খাদ্যে যথেষ্ট আয়রন পাচ্ছেন কিনা তাও নিশ্চিত করা উচিত। রক্তস্বল্পতা যাতে না হয় তা নিশ্চিত করতে ডাক্তার একটি আয়রন সাপ্লিমেন্ট লিখে দিতে পারেন।

জরায়ুতে অতিরিক্ত রক্তপাত সব সময় অজানা কারণে নাও হতে পারে তাই এই ব্যাপারে জানা ও এমন পরিস্থিতিতে অবশ্যই ডাক্তার এর সাথে যোগাযোগ করা জরুরী।


শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে